ডাক্তারি পাশ করে রেলে চাকরি পেয়ে পোঁটলা, বেডিং নিয়ে হাওড়ায় পৌঁছে তারাশঙ্করের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার ঘটনা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল সুকুমার চন্দ্রের। সুকুমার অর্থাৎ তারাশঙ্করের বিশু ডাক্তার বলেন, ‘আমি টালা পার্কের বাড়িতে তারাশঙ্করবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। উনি বললেন, তোকে চাকরি করতে হবে না। লাভপুরে ফিরে যা। ডাক্তারি কর। এলাকার মানুষের উপকার হবে। দেশের উপকার হবে। তোরও উপকার হবে। সেই ১৯৫৭-তে লাভপুরে ফিরে এসে ডাক্তারি শুরু করি। আজও করছি।’ আজও তিনি তার প্রথম রুগীর ‘ফি’ উৎসর্গ করেন ধাত্রীদেবতার জন্য৷
তারাশঙ্করের সাহিত্যের সেই বিশু ডাক্তার এখনও চিকিৎসা করেন। লাভপুরেই তাঁর চেম্বার। লাভপুরই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। চেম্বারে রোগী, ওষুধ ছাপিয়ে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিঠির তাড়া। ব্যক্তিগত চিঠি সবই। এখন ৯০ উত্তীর্ণ সুকুমার চন্দ্রই আসলে তারাশঙ্করের সাহিত্যের বিশু ডাক্তার চরিত্র।
সুকুমারকে পাঠানো কিছু চিঠিতে তাঁকে ‘প্রিয় বিশু’ নামেই সম্বোধন করেছেন ধাত্রীদেবতার স্রষ্টা। সম্পর্কের অন্তরঙ্গতা ফুটে উঠেছে চিঠিগুলির ছত্রে ছত্রে। কোথাও লিখেছেন, ‘প্রিয় বিশু, মায়ের হঠাৎ কিছু হয়ে গেলে ১০০/১৫০, যা লাগে তুমি দিও। বাবাকে উদ্বারনপুর ঘাটে দাহ করা হয়েছিল। মায়ের ইচ্ছা, সেই চিতাতেই তাঁকে দাহ করার। আমি এসে তোমাকে দেব।’
জগন্নাথের রথ’ কিংবা ‘সুখসারি’ ছোট গল্পে তারাশঙ্কর যে ডাক্তার চরিত্রের চিত্রণ করেছিলেন, তিনিই এই সুকুমার চন্দ্র। আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আমার সাহিত্য জীবন’-এও বিশু ডাক্তারের কথা আছে। কথা সাহিত্যিকের সেই চিঠির প্রতি ছত্রে দু’জনের ব্যক্তিগত সম্পর্কের ছোঁয়া। শুধু ব্যক্তিগত প্রয়োজন নয়, গরিবের চিকিৎসার জন্যও যে ডাক্তার সুকুমারের কাছে তারাশঙ্কর ঋণী, তারও স্বাক্ষর আছে সেই চিঠিগুলিতে। এই বয়সেও রোগী দেখার ফাঁকে তারাশঙ্করে বুঁদ হয়ে থাকেন সুকুমার চন্দ্র।
ধাত্রীদেবতার জন্য তাঁর দিনের প্রথম রোগীর দেওয়া ফি-টা বরাদ্দ। ওটা তিনি জমা করেন বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনীর তহবিলে। ওই বাহিনীই ধাত্রীদেবতার রক্ষণাবেক্ষণ করে। কিন্তু বাড়িটি দেখভাল ও প্রতিদিনের খরচ জোগাতে হিমশিম দশা বাহিনীর। ২০১৬-তে নতুন করে ধাত্রীদেবতা চালু হওয়ার পর থেকে তাই নিজের রোজগারের সামান্য অর্থ ‘বিশু ডাক্তার’ দিয়ে চলেছেন তাঁর স্রষ্টার স্মারককে বাঁচিয়ে রাখতে।