সাম্প্রদায়িকতা এবং দেশজুড়ে ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার ইস্যু এখন নিত্যদিনের বিতর্কের বিষয়। যা নিয়ে নিজেদের উদ্বেগ প্রকাশ করছেন দেশের বিদ্বজনেরাও। কিন্তু এর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম কেবল মমতার বাংলাই। এই মুহূর্তে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক টুকরো কোলাজ যেন বাবুঘাটে সাগরমেলার অস্থায়ী ‘ট্রানজিট ক্যাম্প’। এখানে এখন কালীঘাটের কালী, পুরীর জগন্নাথদেব থেকে শুরু করে সাগরের কপিলমুনির ছবি বিক্রি করছেন রাজাবাজারের বাসিন্দা মহম্মদ সোয়েব। আবার মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ডের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা চরণ যাদব, বাবুলাল দুবে, কমলা রানিদের হাতে সামান্য টাকার বিনিময়ে শাড়ি, রেশমি চুড়ির সেট তুলে দিচ্ছেন মেটিয়াবুরুজের কলিম শেখ, মহম্মদ নাসিরুদ্দিনরা।
দোরগোড়ায় মকরসংক্রান্তি। তাই সাগরে যাওয়ার জন্য ইতিমধ্যেই গোটা দেশ থেকে পুণ্যার্থী ও সাধু-সন্তরা এসে জড়ো হয়েছেন বাবুঘাটে। বিপুল জনস্রোতে যেন মিনি সাগরমেলার মেলার চেহারা নিয়েছে বাবুঘাট। সেখানেই দেখা গেল, মেটিয়াবুরুজের নুর আলমের কাছে সিফন-জর্জেটের পাতলা ফিনফিনে শাড়ি মিলছে মাত্র ১০০-১৫০ টাকায়। গ্রাম-ভারতের মহিলারা গোল হয়ে ঘিরে ধরেছেন তাঁকে। আবার, মহম্মদ নাসিরুদ্দিনের কাছে মাত্র ৫০-১০০ টাকাতেই মিলছে এই সিফনের শাড়ি। মহম্মদ সোয়েবের কাছ থেকে দরদাম করে কপিলমুনির মন্দিরের ছবি কিনতে দেখা গেল মধ্যপ্রদেশের পান্নাজেলার কিষাণ রমণী হীরাবাঈকে।
হিন্দু দেবদেবীদের ছবি মহম্মদ সোয়েব যে শুধু এই সময়টায় বিক্রি করেন, তা নয়। সারা বছরই তাঁর এই পেশা। সাধারণ ফটোগ্রাফ কিনে ল্যামিনেশন করে প্লাস্টিক দিয়ে বাঁধিয়ে ১০-২০ টাকায় বিক্রি করেন তিনি। সোয়েব বলেন, ধর্ম তো যে যার নিজের কাছে। তার আগে তো পেটের ভাত জোগাড় করতে হবে। সারা বছর কোনওভাবে সংসার চালিয়ে নিলেও সাগরমেলার সময় এই বাবুঘাটের মেলা উপলক্ষে এখন তাঁর রোজগার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। সাত-আটদিনে কয়েক হাজার ফটো বিক্রি করেন সোয়েব।
মেটিয়াবুরুজের নুর আলম বাঁশদ্রোণীর কাছে ফুটপাতে সারা বছর শাড়ি-সহ নানা পোশাক বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ফি-বছর জানুয়ারির ৭-৮ তারিখ থেকে ১৭-১৮ তারিখ পর্যন্ত এখানেই কোথাও বসে পড়ি। অস্বীকার করব না, প্রচুর বিক্রি হয়। গরিব মানুষকে আমাদের কাছেই আসতে হবে। সিফন-জর্জেটের পাতলা শাড়ির কার্যকারিতার কথা শোনালেন নাসিরুদ্দিন। তিনি বলেন, সাগরমেলাতেও শাড়ির বোঁচকা নিয়ে যাই। সেখানেও প্রচুর বিক্রি হয়।
বহু বছর ধরেই গঙ্গাসাগর মেলার সময় বাবুঘাট সংলগ্ন এই ময়দান চত্বরে তীর্থযাত্রীরা এসে বিশ্রাম নেন। এখান থেকেই সাগরস্নানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান। ফিরে এসে এখান থেকেই সদলবলে যাত্রা শুরু করেন পরবর্তী গন্তব্যে। গত কয়েক বছর রাজ্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এই অস্থায়ী ক্যাম্পও একটি মেলার রূপ ধারণ করেছে। যা আদতে বিশাল গঙ্গাসাগর মেলার এক টুকরো প্রতিবিম্ব বলা চলে। সাগরস্নানের পুণ্যদিনের আগের কয়েকটি দিনে নানা ভাষা-নানা মত, নানা পরিধানের মধ্যে ঐক্যের মিলনভূমি হয়ে ওঠে এই বাবুঘাট চত্বর।