ইন্টারনেটের রাজ্যে পৃথিবী ‘ভুয়ো খবর’ময়। যে কোনও রকম ভাইরাল ফিভারের চেয়েও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ভুয়ো খবরগুলি যে আরও বেশি সংক্রামক, তা এখন একবাক্যে স্বীকার করেন যে কোনও সচেতন মানুষই। তবে শুধু সংক্রামকই নয়, একইসঙ্গে তা যথেষ্ট প্রাণঘাতীও বটে। সদ্য নিহত পুলিশ ইন্সপেক্টর সুবোধকুমার সিংহ, ২০১৫ সালের ৩০ মে এবং ২৮ সেপ্টেম্বর গণপিটুনিতে মৃত আব্দুল গফফর কুরেশি ও মহম্মদ আখলাক, সকলেই এই ভুয়ো খবরেরই শিকার।
উত্তরপ্রদেশের বুলন্দশহর, রাজস্থানের জয়পুর থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে বীরলোকা গ্রাম এবং ফের উত্তরপ্রদেশেরই দাদরি, এই তিন জায়গাতেই দেখা গিয়েছিল একই চিত্রনাট্য। গোহত্যা নিয়ে ভুয়ো খবর, গুজব, উন্মত্ত জনতা এবং গণপিটুনি। হুবহু একই ঘটনাক্রম, শুধু বদলে যাচ্ছে স্থান, কাল এবং পাত্র। তবে এই রঙ্গমঞ্চ শুধু বুলন্দশহর, দাদরি বা বীরলোকা নয়। মারণ ভাইরাসের মতো তা দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দেশেই। অসম থেকে কর্নাটক, ত্রিপুরা থেকে গুজরাত। ছবিটা সব জায়গাতেই প্রায় এক। হিসেব বলছে, শেষ এক বছরে সারা ভারতে ভুয়ো খবর বা ‘ফেক নিউজ’ সংক্রান্ত ঘটনার জেরে ৩৩টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এবং সেই সংখ্যা আরও বাড়ছে।
কিন্তু ভুয়ো খবর ছড়ানোর এই সব ঘটনা কি বিচ্ছিন্ন? তাৎক্ষণিক স্বতঃস্ফূর্ত উত্তেজনাই কি এর এক মাত্র কারণ? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে কোনও পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র? সমস্যা কি শুধুই আধুনিক প্রযুক্তির কারণে? উত্তর খুঁজতে গিয়ে অতীতে ঢুঁ মারলেই অবশ্য দেখা যাচ্ছে, এই ধরনের ঘটনা আদৌ নতুন নয়। সাধারণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যখন ভিন্ন মতের মোকাবিলা করা সম্ভব হয় না, যখন রাজনৈতিক উপায়ে প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করার যুক্তি বা ধৈর্য্য থাকে না, তখন বেছে নেওয়া হয় এমনই সব অপেক্ষাকৃত সহজ রাস্তা।
ভুয়ো খবর ছড়িয়ে প্রতিপক্ষকে খতম করা, ভিন্ন মতকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার এই পন্থাকেই হাতিয়ার করে সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থী অংশ। ভারতের সাম্প্রতিক হিংসাও আসলে সেই ধারারই অংশ। সেই ইঙ্গিতই মিলল বিবিসি প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক রিপোর্টে। দীর্ঘদিন সমীক্ষা চালানোর পর সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত কয়েক বছর ধরেই ভারতে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে উগ্র জাতীয়তাবোধ। ভুয়ো খবর ছড়ানোর পিছনে প্রভাবশালী ভূমিকা নিচ্ছে এই উগ্র জাতীয়তাবোধই। আর তা ছড়ানোর কাজে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে বিজেপির মতো বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী হিন্দু সংগঠন ও তাদের নেটওয়ার্ক।
কী ধরনের ভুয়ো খবর ছড়ায় বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী হিন্দু নেটওয়ার্ক? সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের দ্বারা প্রচারিত ভুয়ো মেসেজগুলি বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, মূলত চারটি বিষয়কে হাতিয়ার করে ছড়ানো হচ্ছে ফেক নিউজ। সেগুলি হল অপরাজেয় হিন্দু শক্তি, ভারতের গৌরবময় ঐতিহ্য ও তার পুনরুদ্ধার, মোদীর ব্যক্তিত্ব ও ক্ষমতা, প্রগতি ও জাতীয় গর্ব। রিপোর্টে স্পষ্ট ভাবেই বলা হয়েছে, অধিকাংশ ফেক নিউজ বা ভুয়ো খবরের পেছনেই আছে রাজনৈতিক অভিসন্ধি। এক্ষেত্রে যে বিবিসির ইঙ্গিত মোদী-শাহর দিকেই, তা বুঝতে বাকি নেই কারও।
ইন্টারনেট আসার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় কীভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে এই প্রোপাগান্ডা? তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়েছে বিবিসি-র এই গবেষণায়। এই জন্য ১৬,০০০ টুইটার অ্যাকাউন্ট, ৩২০০ ফেসবুক পেজ এবং ৪৭, ৫৪৩টি ফেক নিউজ সংক্রান্ত প্রবন্ধ বিশ্লেষণ করেছে তারা। তাতে জানা গেছে, প্রথমে বানানো হয় ভুয়ো খবরের মেসেজ। ভিডিয়োর থেকে ছবি ব্যবহারেই সাফল্য আসে বেশি। সেই ছবি-সহ মেসেজটি বানানোর পর আসরে নামে অ্যামপ্লিফায়ার প্রোফাইল। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় যে অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ভুয়ো খবরগুলি, তাকেই বলা হয় অ্যামপ্লিফায়ার প্রোফাইল।
তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই অ্যাকাউন্টগুলি হয় ভুয়ো। সেইসব অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সম মতাদর্শী বিভিন্ন গ্রুপে পোস্ট করা হয় এই মেসেজ। এ ভাবেই ধীরে ধীরে ভাইরাল হয়ে ওঠে ভুয়ো মেসেজ। ভাইরাল হওয়ার পর গোয়েবেলের থিওরি মেনে তা এতটাই ‘সত্যি’ হয়ে ওঠে, যে মূল ধারার প্রতিষ্ঠিত সংবাদ মাধ্যমও হয়ে পড়ে এই ভুয়ো খবরের শিকার। সে ক্ষেত্রে আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে এই ভুয়ো খবর। একদম শেষ পর্যায়ে সাধারণ মানুষও এই খবর বিশ্বাস করে তা ছড়াতে শুরু করেন। এভাবেই মিথ্যা হয়ে ওঠে সত্যি।
এই মুহূর্তে দেশে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০ কোটি ছাড়িয়েছে। গ্রাম থেকে গ্রামান্তর, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে যাচ্ছে ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া। সারা পৃথিবীতে হোয়াটসঅ্যাপের বৃহত্তম বাজারও এখন ভারতই। ফলে ভুয়ো খবর ছড়াতে হোয়াটসঅ্যাপকে সব থেকে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে পিছিয়ে নেই ফেসবুক, টুইটারের মতো অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়াও। ফলে লোকসভা নির্বাচনের আগে ভুয়ো খবরকে কেন্দ্র করে বেড়েই চলেছে হিংসা-হানাহানির ঘটনা। সোশ্যাল মিডিয়াকে প্রোপাগান্ডা হাসিল করার অন্যতম অস্ত্র হিসেবে সারা পৃথিবীতে ব্যবহার করা হলেও এ দেশে ভুয়ো খবরের কারণে যে ভয়াবহ হিংসা জন্ম নিচ্ছে তা এক কথায় নজিরবিহীন।