কলকাতা থেকে সামান্য দূরেই শ্রীরামপুর। আর শ্রীরামপুর স্টেশন থেকে উত্তরে চাতরা যাওয়ার রাস্তা ধরে কিছুটা এগোলেই মহেন্দ্র লাহিড়ী স্ট্রিটে দেশবন্ধু ভট্টাচার্যের বাড়ি। এই ভট্টাচার্যদের বাড়ি এখন এলাকার মানুষের কাছে রামমোহন রায়ের মামার বাড়ি হিসাবেই পরিচিত।
রাস্তার ধারে পাঁচিলের ভেতরে মস্ত দুর্গা দালান। সেখানে এখন পুজোর প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে। আগের তুলনায় পুজোর জৌলুস কিছুটা কমলেও নিয়মের কোনও পরিবর্তন হয়নি। নিষ্ঠার সঙ্গে প্রায় ৪০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে একই কাঠামোয় মা দুর্গা পূজিতা হচ্ছেন ভট্টাচার্য বাড়িতে।
পরিবারের বর্তমান সদস্য পিনাকী ভট্টাচার্য বলেন, প্রতিবছর রথের দিন আমাদের বাড়ির প্রতিমার কাঠামো পুজো হয়। মহালয়ার আগে কৃষ্ণ নবমীর দিন থেকে শুরু হয় মায়ের পুজো, চলে শুক্লা নবমী পর্যন্ত। নবমীর দিন কুমারী পুজো অনুষ্ঠিত হয়। একসময় পুজোর দিনগুলিতে গড়ে হাজারখানেক লোক খাওয়াদাওয়া করত।
তিনি জানান, পুজোর খরচের অধিকাংশটাই আসত উত্তর ২৪ পরগনার আমডাঙার জমিদার বাড়ি থেকে। পুরনো সেইসব স্মৃতি এখন অনেকটাই ফিকে। তবুও এখন প্রথা মেনে প্রতিবছর দশমীতে ভট্টাচার্য বাড়ির প্রতিমা বিসর্জনের পরেই এলাকার বাকি প্রতিমাগুলির বিসর্জন হয়।
প্রাচীন রীতি মেনে পুজোর দিনগুলিতে নিরামিষ খাবার খেলেও দশমীর দিন মাছভাত খেয়ে মায়ের বরণ করেন শ্রীরামপুরের গোঁসাই পরিবারের মহিলা সদস্যরা। কথিত আছে অদ্বৈত মহাপ্রভুর বংশধর রামগোবিন্দ বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়ে গোস্বামী উপাধি পান। রামগোবিন্দ তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে নৌকায় করে কলকাতায় যাচ্ছিলেন। যাওয়ার সময়ে শ্রীরামপুরের চাতরার কাছে রামগোবিন্দবাবুর স্ত্রী একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন।
ওই সময়ে শ্রীরামপুরের রাজা ছিলেন বাসুদেব রায়। তাঁর এলাকায় ব্রাহ্মণ পুত্রসন্তানের জন্ম হয়েছে খবর পান। এরপরেই খুশি হয়ে রাজা রামগোবিন্দবাবুকে বসবাসের জন্য গঙ্গা লাগোয়া এলাকায় বেশ কয়েক একর জমি দান করেন। দান পাওয়া প্রায় বিঘাখানেক জমির উপর বাড়ি ও ঠাকুরদালান তৈরি করে মা দুর্গার পুজো শুরু করেন।
পরিবারের বর্তমান সদস্য দেবাশিস চট্টোপাধ্যায় বললেন, পূর্বপুরুষদের রীতি মেনে রথের দিন কাঠামো পুজোর মাধ্যমে মূর্তি তৈরির কাজ শুরু হয়। সাবেকি একচালার প্রতিমা হয়। রীতি অনুযায়ী মহালয়ার দিন থেকে বৈষ্ণব মতে দেবীর বোধনের মধ্য দিয়ে গোঁসাইবাড়ির পুজো শুরু হয়। আমাদের পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল পুজোর দিনগুলি পরিবারের সদস্যরা নিরামিষ খেলেও দশমীর দিন মাছভাত খেয়ে তারপর মায়ের বরণ করেন।
একসময় পুজোর দিনগুলিতে এলাকার মানুষ মেতে থাকতেন। প্রতিদিন কয়েক হাজার লোক খাওয়াদাওয়া করতেন এ বাড়িতে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। প্রাচীন রীতি মেনে পুজো চললেও জৌলুস কিছুটা কমেছে। তবে এবারও ৪০০ বছর ধরে চলে আসা রীতিনীতি মেনেই পুজো হবে বলে জানিয়েছেন বাড়ির সদস্যরা।