আবারও শহরের বুকে আর এক ‘বড় সত্যি’। তবে মা দুর্গা নয় বা মহিষাসুর নয়। সল্টলেকের পুজোয় এবার মাথা তুলবে ৪০ ফুটের রাবণ! তাও আবার একটা নয়, দুটো নয় দশটি মাথা।
সল্টলেকে, একে ব্লকের পুজোমণ্ডপে ঢুকলেই দেখা মিলবে বিশাল মূর্তিটির। লোহার মোটা পাত কেটে ঝালাই দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বিশালাকৃতির এই দশানন। মণ্ডপ নির্মাণেও ধাতুর ব্যবহার করা হয়েছে। এবার তাদের পুজোর থিম ‘সীতাহরণ’। তাই মণ্ডপসজ্জায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে রাম-রাবণের যুদ্ধের আখ্যান।
১৬ হাজার বর্গ ফুটেরও বেশি জায়গা জুড়ে তৈরি হয়েছে মণ্ডপ। অন্দরসজ্জায় থাকছে রামায়ণের বিভিন্ন পর্যায়ের ছবি। লোহার পাত কেটে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন মডেল। সঙ্গে থাকবে আলো ও শব্দের খেলা। রাবণের মূর্তি তৈরি শুরু হয়েছে জুলাই মাস থেকে। শিল্পী পূর্ণেন্দু দে-র বর্ধমানের কর্মশালায় তৈরি হয়েছে মূর্তির প্রাথমিক কাঠামো। প্রতিমাশিল্পী অরূপ কর। চতুর্থীর সন্ধেয় রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী মণ্ডপ উদ্বোধন করবেন।
থিমের বিষয়ে উদ্যোক্তারা জানালেন, গল্পের নায়ক রাম উত্তর ভারতের রাজপুত্র। মহাকাব্যে লেখকের পক্ষপাত তাঁর দিকেই রয়েছে, দ্রাবিড়রাজ রাবণের দিকে নয়। তবে রাবণের সবটাই খারাপ নয়। বাল্মীকি তাঁর সৃষ্টির মধ্যেই সেই সূত্র রেখে গেছেন। প্রবল পরাক্রান্ত রাবণ সীতাহরণ করলেও তাঁর ওপর কোনও অত্যাচার বা অসম্মান করেছেন, এমন কোনও তথ্য কিন্তু বাল্মীকির লেখায় পাওয়া যায়না। বরং পিতৃভক্ত, প্রজাবৎসল রামই কিন্তু নিজের স্ত্রীকে বিশ্বাস করেননি। যুদ্ধ করে ফিরিয়ে আনা স্ত্রীকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে পাঠিয়েছিলেন। এবারের থিমে তাই রাবণবধ এবং সীতাহরণের গল্পের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরা হবে সেই যুদ্ধের রাজনীতি।
পূর্ব ভারতে দেবতা হিসেবে রামের তেমন কদর না থাকলেও বাঙালির দুর্গাপুজোর গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রাম-রাবণের যুদ্ধের গল্প। পুরাণ মতে, শরৎকালে দেবতার আরাধনার সময় নয়। এ সময় দেবলোকে রাত্রিকাল। নিয়ম মতো দুর্গাপুজো হত বাসন্তীকালে। তাই অকালে দেবীর আরাধনা করার জন্য প্রথমে করণীয় ছিল তাঁর বোধন। তা মেনেই রাম করেছিলেন এই অকালবোধন।
কৃত্তিবাস তাঁর বাংলা রামায়ণে অকালবোধনের উল্লেখ করেছেন। আর কৃত্তিবাস বর্ণিত রামের অকালবোধনই বাঙালির শারদোৎসব। পয়ার ছন্দে লেখা কৃত্তিবাসী রামায়ণে তিনি বাল্মীকি রামায়ণকে বাংলার নানা সামাজিক প্রেক্ষিতের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিলেন। কিছু পরিবর্তনও এনেছিলেন। রামের পক্ষে শৈব, এবং প্রায় অমর রাবণকে হারানো সহজ ছিল না। তাঁর ওপর ছিল শিবের আশীর্বাদ ও ভদ্রকালীর রক্ষাকবচ। তাই দেবী দুর্গার আরাধনা করেছিলেন রাম।
বাঙালি কবিরা রামায়ণকে বারবার নতুন আলোয় বিশ্লেষণ করেছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্যে বীর মেঘনাদের মৃত্যুর বর্ণনা পাঠককে ব্যথিত করে। সীতা–উদ্ধারে গেছেন বলেই সব সহানুভূতি এবং সমর্থন পাননি লক্ষ্মণও। সেইসঙ্গে বাল্মীকির রাবণও পুরো ‘কালো’ নন। তিনি সীতাকে হরণ করেছিলেন বোন শূর্পণখার অসম্মানের প্রতিবাদে। এই পরম্পরার সূত্র ধরেই এবারের পুজোয় একে ব্লক দর্শনার্থীদের একবার ফিরে দেখাতে চায় সীতাহরণ ও তাকে কেন্দ্র করে হওয়া রাম-রাবণের যুদ্ধকে।
এখন থেকেই দর্শকদের মনে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে এই ৪০ ফুটের রাবণ। ক্রমেই উত্তেজনার পারদ চড়ছে। দু’বছর আগের ‘বড় সত্যি’-র অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে, ভিড় সামলাতে এখন থেকেই কোমর বেঁধেছে পুলিশ।