ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! শেষে কিনা মাটির উপর অনাদরে পড়ে, ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে দেবী চৌধুরানীর ভস্মীভূত মূর্তির টুকরো। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে, রঙপুরের মন্থনার রানী ছিলেন জয়দুর্গা দেবী চৌধুরানী।
দেবীর মতই করুণ অবস্থা সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নায়ক ভবানী পাঠকেরও। শিকারপুর চা বাগানের মাঝে বেলাকোবার মন্থনির হাটে মাস কয়েক আগে এক নিঝুম সন্ধ্যায় হঠাৎই আগুন লেগেছিল দেবী ও ভবানী পাঠকের মন্দিরে। মাটির বানানো মূর্তিগুলি পুড়ে গেলেও ধড়দুটি অক্ষত ছিল। তা-ই এখন শুধু ঐতিহাসিক এই মন্দিরের স্মৃতি হিসাবে বেঁচে আছে। আগুনে পুরোপুরি পুড়ে গিয়েছিল দিবা, নিশা আর রঙ্গরাজের কাঠের মূর্তিগুলি। দেবী আর ভবানীর মূর্তির চারপাশে যারা এতদিন প্রহরায় ছিল।
ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানী, দিবা, নিশা বা রঙ্গরাজ-এই নামগুলি সাহিত্যপ্রেমী বাঙালির কাছে খুবই পরিচিত। এঁরা হলেন বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরানী উপন্যাসের অমর সব চরিত্র। তখন ১৭৭৩ সাল। মন্বন্তরে বাংলার মানুষ অনাহারে মারা যাচ্ছে। তখনই মন্থনা এস্টেটের রানী জয়দুর্গা ইংরেজের বিরুদ্ধে ঘোর বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন।
উত্তরবঙ্গের নামী ইতিহাসবিদ উমেশ শর্মার বক্তব্য, ‘দেবী’ উপন্যাসের কল্প নায়িকা নন। তিনি ছিলেন রক্তমাংসের নারী। সে অর্থে স্বামী পরিত্যক্তাও ছিলেন না। বঙ্কিম তাঁকে নিয়ে উপন্যাসের অন্তরালে এক শ্যাডো হিস্ট্রি বা ছায়া ইতিহাসের রচনা করেছিলেন। যেখানে মিথ ও বাস্তব মিশেছে। দেবী বৈকুণ্ঠপুর এস্টেটের তৎকালীন শাসক দর্পদেব রায়কতের সঙ্গে একযোগে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। দর্পদেবকে আবার সহায়তা করেছিলেন মজনু শাহের নেতৃত্বে ফকির ও ভবানী পাঠকের নেতৃত্বে সন্ন্যাসীরা।’
তিনি আরও জানান, স্থানীয় মানুষ ঔপোনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে মন্থনার রানীর লড়াইয়ের ইতিহাস ভোলেনি। ফলে কালক্রমে দেবী থেকে তাঁর ‘দেবীত্বে’ উন্নীত হতে দেরি হয়নি। তাই শিকারপুরে ঘোর জঙ্গলের মধ্যে তৈরি হয়েছিল দেবীর মন্দির। উমেশের ব্যাখ্যা, ‘উত্তরপূর্ব ভারত ও উত্তরবঙ্গের এই অঞ্চলের মানুষ শিব ভক্ত। তাই তাদের ভক্তির মায়া জড়ানো কল্পনায় দেবী পার্বতী ও ভবানী শিব। কিন্তু ভবানীর মূর্তিতে কোন বাঘের ছাল জড়ানোর রূপকল্প ছিল না। ওই মন্দিরে শিবের পুজোর মন্ত্রে ভবানীর নামও উচ্চারিত হয়। আর দেবির স্বামী ইংরেজদের হাতে চরম অত্যাচারিত হয়েছিলেন। বৈকুন্ঠপুরের শাসক দর্পকেও ইংরেজরা প্রায় ১৮ বছর বন্দী করে রেখেছিল।’
খবর পেয়েই রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী গৌতম দেব আশ্বাস দিয়েছেন শীঘ্রই মন্দির ও মূর্তিগুলির পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু হবে। ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে পুরনো রূপটানেই বানানো হবে দেবীর মন্দির। সেদিকেই চেয়ে রয়েছেন উত্তরবঙ্গের মানুষজন। আবারও বৈকুন্ঠপুর অরণ্যে আগের মতই স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হবেন দেবী, এমনটাই আশা করছেন তাঁরা। সূত্র থেকে পাওয়া খবর, শীঘ্রই শুরু হবে মন্দির নির্মাণের কাজ। এখন জোরকদমে চলছে পরিকল্পনার কাজ।