ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ। গান্ধীজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ উঠেছে গোটা দেশে। তিনি প্রস্তাব দিলেন বিদেশি দ্রব্য বর্জন করুক প্রতিটি ভারতবাসী। তাঁর প্রস্তাব মেনে নিল অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার অনুশীলন সমিতি। সেখানের সদস্য, একঝাঁক বিপ্লবী তরুণদের নিয়ে শুরু করা দুর্গাপুজোয় ব্যবহার করা হল না কোনও বিদেশি দ্রব্য। বদলে প্রতিমার বস্ত্র, অলঙ্কার, সবই হল মাটির। অস্ত্র দেশীয় লোহা, তামার।
১৯৩১, ১৯৩২, ১৯৩৩ পরপর এই তিন বছর মেদিনীপুর শহরে বিপ্লবীদের হাতে খুন হন তিন অত্যাচারী জেলাশাসক যথাক্রমে পেডি, ডগলাস এবং বার্জ। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অনুগামী বেঙ্গল ভল্যান্টিয়ার দলের বিপ্লবীদের হাতে পরপর তিন ম্যাজিস্ট্রেট খুন হওয়ার পর মেদিনীপুরের পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, কোনও কর্মরত আইসিএস এখানে আসতে চাননি। তখন একপ্রকার বাধ্য হয়েই পিজে গ্রিফিথ নামে অবসরপ্রাপ্ত এক আইসিএস-কে জেলাশাসক করে মেদিনীপুরে পাঠানো হয়।
পাশাপাশি, মেদিনীপুরে জারি হয় সন্ধ্যা আইন। ফলে সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে বেরানো বন্ধ হল। কংগ্রেস-সহ সমস্ত ক্লাব, স্কাউট, সংগঠন, লাঠিখেলা, কুস্তি, আখড়াও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এমনকি দমন পীড়ন চালাতে ১৮০০ পাঠান সেনা আনা হয়েছিল মেদিনীপুরে। তাদের খরচ চালাতে মেদিনীপুরের বাসিন্দাদের ওপর বছরে অতিরিক্ত ৬৮ হাজার টাকা কর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কার্যত জেলখানায় পরিণত হওয়া মেদিনীপুরকে এই অবস্থা থেকে বের করে আনতে ব্যারিস্টার বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, ক্ষিরোদবিহারী দত্ত, দেবেন্দ্রনাথ খান, অক্ষয় দাশগুপ্ত দুর্গাপুজো করার উদ্যোগ নেন।
সেটা ১৯৩৪ সাল। বিপ্লবীদের প্রাণকেন্দ্র কর্নেলগোলায় পুজো করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পুজোর পিছনে উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত যুবকদের উদ্বুদ্ধ করা। কিন্তু ব্রিটিশদের পুলিশ পুজোর অনুমতি দেয় না। এবং ঘোষণা করা হয় যিনি তাঁর জমিতে পুজোর জন্য ‘নো অবজেকশন’ দেবেন, তাঁকেই গ্রেপ্তার করা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তৎকালীন ব্রাহ্ম সমাজ কর্তৃপক্ষ তাদের জমিতে পুজো করার নো অবজেকশন দেয়।
তারপর থেকে এখনও অবধি ধারাবাহিক ভাবে চলছে অনুশীলন সমিতির দুর্গাপুজো। গান্ধীজির বিদেশি দ্রব্য বর্জনের নীতিকে সমর্থন জানিয়ে মৃন্ময়ী মূর্তিকে পরানো হত না কোনও রকম শোলার বা ইমিটেশনের অলঙ্কার, বস্ত্র। সবই মাটির। শুধু অস্ত্র দেশীয় লোহা এবং তামার। এখনও এই রীতি সমান তালে চলে আসছে।
পুজো কমিটির সম্পাদক তীর্থঙ্কর ভকত জানান, বিপ্লবীদের নিয়ম ও প্রথা মেনেই পুজো হয়ে আসছে এতদিন। বংশ পরম্পরায় একই পরিবার মূর্তি গড়েন, পুজো করেন। এ বছরের পুজো তাঁরা মহাত্মা গান্ধীর জন্ম সার্ধশতবর্ষ, স্বামীজির শিকাগো বক্তৃতার ১২৫ বছর এবং ভগিনী নিবেদিতাকে উৎসর্গ করেছেন। এবারে সমিতির এই পুজো ৮৪ বছরে পা দিল।