একটি উচ্চপর্যায়ের বাণিজ্য সম্মেলন বলতে আপনি কী বোঝেন? সেই বাণিজ্য সম্মেলন যদি পশ্চিমবঙ্গের মতো একটি রাজ্য ইউরোপের বাণিজ্য রাজধানী ফ্রাঙ্কফুর্টে শোকেস করতে চায় তাহলে চেহারাটা কী দাঁড়াবে? বাণিজ্য সম্মেলন বলতে আমরা নিশ্চয়ই বুঝব পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন, সংখ্যাতত্বের ছড়াছড়ি,বিশিষ্ট শিল্পপতি ও অর্থনীতিবিদ, সমাজতাত্ত্বিকদের স্ট্যাটিসটিক্যাল ডায়াগ্রাম, দেড় বা দু’ঘন্টা ধরে বকে যাওয়া একজন কমপিয়ারের নিজেকে সম্ভাব্য সেরা প্রমাণ করার মরীয়া চেষ্টা, উপস্থিত শিল্প প্রতিনিধিদের নোটবুকে অন্যমনস্ক আঁকিবুকি, একটানা ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টের ইংরেজি এমনটি হয়ে আসছে গত বিশ বছর ধরে। কোনও নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধ চারণভূমিতে মমতা পা রাখেন না। অভ্যস্তই নন তিনি। প্রতি মুহূর্তে বেড়া ভাঙাই তার নেশা, তার জেদ, মানুষের কল্যাণে ঝাপিয়ে পড়া, তার লাফ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া, সমগ্র পরিবেশকে নিজের মতো করে নেওয়া। বিদেশে গত ছ’টি সফর ঘিরেই আস্তে আস্তে গড়ে উঠছিল, সপ্তমে এসে সুর যেন পারফেকশনের ধারেকাছে পৌছে গেল। গ্যামো দার্শনিক গণিতবিদ বলেছিলেন পারফেকশন বলে কিছু হয় না, শতকরা একশোয় কখনও একশো হয় না। অনন্তে পৌঁছাতে গেলেও তার ভাগ আছে। তাই প্রকৃতি তথা প্রকৃতির অবদান মানুষ তথা জীবজগৎ ওই পারফেকশনের কাছে পৌঁছচ্ছে অনন্তকাল ধরে, আরও অনন্তকাল ধরে তাকে এগোতে হবে। সেকারণেই আমি বলেছি পারফেকশনের দিকে যাত্রা শুরু হয়েছে।
রাজ্য সরকারের কোনও প্রতিনিধিকেই কিছু বলতে হল না, কেবল মুখ্যমন্ত্রী ছাড়া যেন তিনি শেষ বক্তা হিসেবে বাগান থেকে তুলে আনা ফুলগুলিকে মালায় গেঁথে দিলেন। যা বলার তা বললেন শিল্পপতিরাই। বাংলাকে নিয়ে গর্ব, গর্ব বলব কেন বাংলাকে নিয়ে আবেগ। শুধু আবেগ বা বলব কেন, একটি বাণিজ্য সম্মেলনকে কীভাবে একটি সাহিত্য ও শিল্পের পর্যায়ে তুলে নিয়ে আসা যায় তা দেখার জন্যে নিরপেক্ষ শিক্ষাবিদ পর্যবেক্ষকদের দরকার ছিল। আহা, আমার মনে হচ্ছিল এই সাইনার্জি যদি হাইডেলবের্গের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে করা যেত, যদি সেখানে শ্রোতারা হতেন পিএইচডি’র ছাত্র ছাত্রী তাহলে হয়তো তাদের কাছে একটি গবেষণার বিষয় হতে কীভাবে অঙ্কে ও মননে অন্ধকারে ডুবে থাকা পশ্চিমবঙ্গ গত সাত বছরে তাঁর হাত ধরে আলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ‘প্রভু, আমি অন্ধকারের যাত্রী, আমায় আলাের পথ দেখাও।’
কোনও আবেগের কথা বলছি না, বলছি তত্বের কথা। রাজ্য ভারী শিল্পের দিকে চেষ্টা করছে, নাকি অনুসারী শিল্পের কথা ভাবছে তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করুক বিজনেস স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা। আমি চমকিত তখনই যখন রিলায়েন্সের প্রতিনিধি মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, বিশিষ্ট আভাগার্ড সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস (দ্য টিন ড্রাম-এর রচয়িতা) কলকাতায় বসে বলেছিলেন, যদি কলকাতাকে মৃত নগরী বলে কারও মনে হয় তবে মনে রাখতে হবে, ভারতের অন্য শহরগুলি কবেই মরে গেছে। ওই প্রতিনিধি জানালেন, ম্যাকেঞ্জির সাম্প্রতিক রিপাের্টে বলা হয়েছে কলকাতার আইটি হাব, কলকাতা যেভাবে বদলাচ্ছে তাতে এই শহরের আইটি হাব অদূর ভবিষ্যতে হংকং ও সিঙ্গাপুরকে কড়া প্রতিযােগিতার মধ্যে ফেলে দিয়ে শুরু করে দেবে আন্তর্জাতিক স্তরের অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ। একটি দীর্ঘ সময়। তিনি মন খুলেই বললেন, অনেকটাই পিছিয়ে গিয়েছিল বাংলা। অনেকটাই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিহাস পুনর্নির্মানে নেমেছেন। ফিরিয়ে আনতে চলেছেন বাংলার ব্যবসার ঐতিহ্য। রিলায়েন্স স্বীকার করল বাংলা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে চতুর্থ স্থানে উঠে এসেছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে কোট করলেন রিলায়েন্স, ‘আমার সােনার বাংলা’। সেই সােনার বাংলাই গড়ে তােলার পথে মমতা। আমি জানিনা কোন শীর্ষ শিল্প সম্মেলনের গুন্টার গ্রাস বা রবীন্দ্রনাথের কবিতায় উল্লেখ হয় । একবারও ব্ল্যাকবোর্ড নোই । প্রমান করে দিলেন সাত বছরে বাংলা এগিয়েছে অনেক। হর্স নেওটিয়া বললেন, ‘গ্রাম থেকে শহর সব মানুষের মুখে হাসি । আমরা এমন একটি সরকার দেখেছি, যারা করোও কথা ভেবে গোটা দেশের উন্নয়নের মানচিত্র থেকে ছিটকে ফেলে দেয় বাংলাকে । সেখানে মমতা যেভাবে শৃঙ্খলা ও উন্নয়নের মোড়কে বেঁধে দিলেন সেই বাংলাকেই, এখন সেখানে আমরা শিল্পপতিরা নিশ্চিত বোধ করছি ।’ একই কথা হলদিয়া পেট্রোকেমের পূর্ণেন্দু চ্যাটার্জির মুখে। ‘চ্যালেঞ্জ, প্রতিভা হলো বাংলার সবচেয়ে বড় সম্পদ। এক সময় শুধু শ্রমকে সম্পদ ভাবে হতো । প্রতিভাকে সম্পদের জায়গায় তুলে নিয়ে আসার ক্ষমতা দেখালো মমতার বাংলা। আমরা ওই প্রতিভাকে ব্যবহার করতে চাইছি। এবং দ্বিগুন করতে চাইছি আমাদের বিনিয়োগ।’ এ যেন এক ধ্রুপদী সিম্ফনি, প্রতিটি শিল্পপতি, প্রতিটি উদ্যোগপতি, প্রতিটি বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট মানুষ, যাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে বাংলা সম্পর্কে, অথচ কোনও কন্ডাক্টরের চুরি-কাঁচি নেই। কেভেন্টার্সের মায়াঙ্ক জালান বললেন,’ ৬৪ দিনের মাথায় আমি আমার জমির অনুমোদন পেয়েছি। সত্যম রায়চৌধুরী বললেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির পরিকাঠামো পেতে কোনোও সময় লাগেনি।’ গলা মেলালেন কোমল মিত্তল, রবি পোদ্দার , রুদ্র চ্যাটার্জি।
একটি ধ্রুপদী সিম্ফনি তখনই কালজয়ী হয়ে ওঠে যখন তার সুরবিন্যাস কন্ডাক্টরের প্যাটার্নকে অনুসরণ করে। একবারের জন্যও রসভঙ্গ করে না। মমতার শিল্পসম্মেলনে সেই উচ্চাঙ্গের স্তরে পৌঁছেছে।
(সৌজন্যে- খবর ৩৬৫দিন)