হাতে নেই আর গোটা এক মাসও। তারপরেই বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো। থিম-যুদ্ধে তাই এখন থেকেই সরগরম উৎসবের ময়দান। কলকাতার ‘হেভিওয়েট’ পুজোগুলির চমকের অপেক্ষায় মহানগরী তথা দূর-দূরান্তের মানুষ। কোথাও টাইম মেশিন, তো কোথাও আস্ত লাইব্রেরি। কোথাও প্রাচীন খেলনা, তালপাতার পাখা, পুতুলনাচের সামগ্রী দিয়ে মেলার ধাঁচে মণ্ডপসজ্জা; কোথাও আবার পুরনো শিল্প-সংস্কৃতি। কোথাও কাগজ-সুতোয় সেজে উঠছে মণ্ডপ, কোথাও বা মণ্ডপকে ঘিরে কাচ, রাংতার মায়াবী পরিবেশ। সবমিলিয়ে প্রতিবারের মত এবারও পুজোয় চমকের শেষ নেই। গোটা শহরজুড়েই শিল্পীরা এখন ভীষণ ব্যস্ত তাঁদের শিল্পকর্ম ফুটিয়ে তুলতে। তাঁদের একটাই কথা, হাতে আর বেশি দিন নেই। তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে।
থিম পুজোর গোড়ায় উঠে এসেছিলেন দুই শিল্পী অমর সরকার ও ভবতোষ সুতার। প্রথমে জুটি বেঁধেই কাজ শুরু করেছিলেন তাঁরা। পরে আলাদা হয়েও নিজেদের জাত চিনিয়েছেন দু’জনে। ভবতোষ সুতারের পুজোয় হাতেখড়ি ২০০০ সালে। বেহালার জনকল্যাণের দুর্গাপুজোয় ভাবনা শিল্পী ছিলেন তিনি। পরের বছর শিল্পী অমর সরকারের ভাবনায় গড়া মণ্ডপের জন্য দুর্গামূর্তি গড়েন ভবতোষ। তাঁর কাজ সকলের নজর কাড়ে। তাঁর মতো নয়ের দশকে থিম পুজোর শুরু থেকেই উঠে এসেছিলেন একঝাঁক নতুন শিল্পী। মহানগরীকে উপহার দিয়েছিলেন নতুন নতুন ভাবনা। বাঙালির পুজোর নস্টালজিয়াকে উস্কে দেন তাঁরাই।
দক্ষিণ কলকাতার যোধপুর পার্ক ৯৫ পল্লির পুজো এখন আর আলাদা করে কাউকে চিনিয়ে দিতে হয় না। শুধু বয়সের ভারে নয়, অপরূপ মণ্ডপসজ্জা এবং মাতৃমূর্তিতে যোধপুর পার্ক দুর্গাপুজোর মানচিত্রে এক বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। এবার যোধপুর পার্ক ৯৫ পল্লির পুজোর শিল্পী ভবতোষ সুতার। আয়োজকরা জানালেন, এখন থেকেই পুরোদমে কাজ করছেন তিনি ও তাঁর সহশিল্পীরা। নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই যেন তাঁদের। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে যে কাজ শেষ করতে হবে। আর অর্জুনপুরের পুজোর কাজ শেষ করে ফেলতে হবে চতুর্থীর মধ্যে। ভবতোষবাবু জানালেন, এবারের পুজোয় যোধপুর পার্কের পুজোর থিম মায়ার বাঁধন। সেখানে মূর্তিও তিনি তৈরি করছেন। এখানে শুধু মাটি নয়, একাধিক উপাদানে তৈরি করা হচ্ছে মায়ের মূর্তি। আবার অর্জুনপুরে হচ্ছে একেবারে অন্যরকমের কাজ। সেখানে সাবেকি মূর্তি থেকে বেরিয়ে এসে অন্যরকম এক প্রতিমা উপহার দিতে চলেছেন ভবতোষবাবু। অর্জুনপুরের থিম নাদ। অর্থাৎ শব্দতরঙ্গ। তাই এই পুজোমণ্ডপের নির্মাণেও ভবতোষবাবু ব্যবহার করবেন নানা রকমের সাউন্ড এফেক্ট। সেগুলির সঙ্গে থাকবে হাতের কাজ।
আবার যাঁর হাত ধরে গত কয়েক বছর ধরে একের পর এক সেরা পুরস্কার দক্ষিণ কলকাতার সুরুচি সঙ্ঘের ঝুলিতে গিয়েছে, সেই শিল্পী সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় এবার রাজডাঙা নব উদয় সঙ্ঘের পুজোয় নিজের সেরাটা তুলে ধরতে ব্যস্ত। অক্লান্ত পরিশ্রমে কাজ করে চলেছেন। তবে শুধু রাজডাঙা নয়, ভবানীপুরের অবসর ও সুরুচি সঙ্ঘের থিমও তাঁর হাতে তৈরি হচ্ছে। যদিও থিমের বিষয় এখনই প্রকাশ্যে বলতে চাইছেন না সুব্রতবাবু। বললেন, থিম জনসমক্ষে আনার এখনও সময় আসেনি। তবে আমি শিল্প নিয়ে গবেষণা করতে ভালোবাসি। তাই দর্শকদের সামনে নতুন নতুন ভাবনা উপস্থাপিত করি। ২০১৬ বাদে ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল সাত বছর সুরুচি সঙ্ঘের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন সুব্রতবাবু। একাধিক পুরস্কার তাঁর নামের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে। শিবমন্দির, ট্যাংরা ঘোলপাড়া, টালা বারোয়ারির মতো বড় পুজোগুলিতেও সাড়া জাগানো থিম তৈরি করে বড় বড় শিল্পীদের রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছেন সুব্রতবাবু। রাজডাঙা নব উদয় সঙ্ঘের পুজো উদ্যোক্তাদের কথায়, আমরা কী করছি, তা আর কিছুদিনের মধ্যেই জানাব। তবে সেরা শিল্পীকে দিয়ে সেরা আবিষ্কার তুলে ধরে দর্শকদের মনে জায়গা তৈরি করে নিতে আমরা বদ্ধপরিকর। প্রতিবারের মতো এবারও সেরাটা দিতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন শিল্পী সুশান্ত পাল। গত কয়েক বছর ধরে নানা ধরনের বিস্ময়কর থিম দর্শকদের উপহার দিয়ে চলেছে নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘ। ঝুলিতে তুলে নিয়েছে সেরার সেরা পুরস্কারগুলি। এ বছর তাঁর হাতে নাকতলার থিম ‘কাল’। ১৯৯৮ সালে বড়িশা সহযাত্রী ক্লাবের থিম দিয়ে হাতেখড়ি সুশান্তবাবুর। বললেন, মানুষের মনকে নাড়া দিতে পারে, এমন থিম তৈরি করেই সার্থকতা। সময় হচ্ছে গতিশীল প্রকৃতি। যেহেতু প্রকৃতি কখনওই স্থির থাকে না, তাই সময়ও কখনও থেমে থাকে না। তাঁর মতে, সময় এক বাস্তবিক ঘটনা। যার পরিবর্তন ক্রমাগত চলতে থাকে। সময়ের কোনও স্বাধীন অস্তিত্ব নেই। প্রকৃতির গতির ফলেই সময়কে অনুভব করা যায়। সেই অর্থে সময় প্রবাহমান। সময়ের সেই অসীম, অনন্ত ধারণাই এক অতিবাস্তব উপস্থাপনার মাধ্যমে নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘের পুজোতে তুলে ধরা হচ্ছে। তবে সুশান্তবাবুর হাতে শুধু নাকতলাই নয়, শিল্পের ছোঁয়া পাচ্ছে ঠাকুরপুকুরের সিস্টার নিবেদিতা সঙ্ঘের পুজোও।
বেশ কয়েকবছর ধরেই পুজোর থিমে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করে শ্রীভূমি স্পোর্টিং- এর উদ্যোক্তারা। তাঁদের এবারের থিম হিসেবে তাঁরা বেছে নিয়েছে সঞ্জয়লীলা বনশালীর বিতর্কিত সিনেমা ‘পদ্মাবত’-এর সেই ঐতিহাসিক সেট। শুধু রাজস্থানী ঘরানার মণ্ডপসজ্জা নয়, আলোকসজ্জাতেও থাকবে রানি পদ্মাবতীর স্পর্শমাখা সেই রাজপ্রাসাদ। ১০০ ফুটেরও বেশি উচ্চতার লোহার কাঠামো, হাতে আঁকা ছবি, প্লাইউডের মাধ্যমে গড়ে উঠছে সুফি কবি মহম্মদ জয়সীর বর্ণনায় থাকা সেই চিতোর প্রাসাদ। রাজপুত-সুলতানদের কাহিনীর ঘনঘটা যাতে মণ্ডপে ঢুকলেই পরখ করা যায়, চলছে তার প্রস্তুতি। মূর্তিতে থাকছে সাবেকিয়ানা। তবে চমক থাকছে গণেশকে ঘিরে। হাতির পিঠে গণেশের আবির্ভাব। যেখানে কার্তিক হবেন ঘোড়সওয়ার। দেবদেবীর সব গয়নাই সোনার। ফিরোজাবাদ থেকে আসছে ১৫১টি বিশেষ ঝাড়বাতি। মণ্ডপের বাইরে ছোট ছোট আলোকমালায় ফুটে উঠবে পাখি, ফুল, হ্যামলিনের বাঁশি, জাদুর নানা ঘটনা। এখানে আবার মণ্ডপসজ্জার দায়িত্বে আছেন নবাগত শিল্পী রোমিও।
বিশ্বকর্মার সৌজন্যে আজই সবে কাঠি পড়েছে ঢাকে। ইতিমধ্যেই সারা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে বড় বড় পুজো কমিটিগুলির ব্যানার। আশা করা যাচ্ছে, মহালয়ার আগেই তাঁদের থিম নিয়ে মুখ খুলবেন উদ্যোক্তারা। আর তখনই প্রকাশ্যে আসবে এই হেভিওয়েট পুজোগুলির হেভিওয়েট চমক।