ভোররাত থেকে রবিবার সারাদিন আগুনের সর্বগ্রাসী চেহারা এবং তা নেভানোর চেষ্টায় মানুষের লড়াইয়ের সাক্ষী রইলেন বড়বাজারের ক্যানিং স্ট্রিট, আমড়াতলা স্ট্রিটের সংযোগস্থলে উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ। গতকাল দিনভর আগুনের সঙ্গে লড়াই চালালেন দমকল ও পুলিশকর্মীরা। বস্তুত, শনিবার রাত আড়াইটে থেকে বাগরি মার্কেটের আগুন নেভানোর যে কাজ শুরু হয়েছিল, রবিবার সারাদিন পেরিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত চলেছে সেই লড়াই। দমকল বাহিনীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরিশ্রম করেছেন কলকাতা পুলিশের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের কর্মীরা। ডিজি (ফায়ার) জগমোহন এবং কলকাতা পুলিশের নগরপাল রাজীব কুমার দীর্ঘক্ষণ ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে আগুন নেভানোর কাজ তদারকি করেছেন। একটা সময়ে দেখা যায়, নগরপাল নিজে লাফিয়ে দমকলের একটি ইঞ্জিনের ওপর উঠে ৬ তলা বাজারের কোন কোন তলায় আগুন রয়েছে, তা দেখছেন এবং দেখাচ্ছেন দমকল কর্মীদের। বেলা বাড়ার আগেই বড়বাজার থানা এবং লালবাজার থেকে বিশাল পুলিশবাহিনী নিয়ে গিয়ে মোতায়েন করা হয় ঘটনাস্থলের আশেপাশে। ক্যানিং স্ট্রিট এবং পগেয়াপট্টির দিক থেকে যানচলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। মহাত্মা গান্ধী রোডে যে অংশ দিয়ে পগেয়াপট্টি হয়ে ক্যানিং স্ট্রিটে আসা যায়, সেখানেও পুলিশবাহিনী মোতায়েন ছিল। তবে শুধু কলকাতা পুলিশ বা দমকলই নয়, কলকাতার এই বিপদের দিনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এলাকার বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরাও। ‘তেরাপন্থ টাস্ক ফোর্স’–এর সদস্যরাও দমকলের কর্মীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আগুন নেভানোয় হাত লাগিয়েছেন। কলকাতার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক সাধারণ মানুষও ছুটে এসেছিলেন। যাঁরা আগুনের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন, তাঁদের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছেন জলের বোতল। কালো বিষাক্ত ধোঁয়ায় নাকমুখ ঢাকার জন্য নিয়ে এসেছেন পাতলা মুখোশ। হাতেহাতে সেগুলি বিলি করেছেন অসহায় মানুষের মধ্যে।
দফায় দফায় আগুন নিভেছে। আবার জ্বলেও উঠেছে। একদিকের আগুন নেভানোর সঙ্গে সঙ্গে সিলিন্ডার ফাটছে। বিভিন্ন পার্টিশন জ্বলছে। কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে নিকষ কালো ধোঁয়া। এর ফলে দলকল কর্মীদের আগুন নেভানোর কাজ ব্যাহত হয়েছে তো বটেই, কিন্তু তাঁরা তার তোয়াক্কা করেননি। জলের তোড়ে ভেজা পোশাকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করেছেন। এক সঙ্গে ৩০টি দমকলের ইঞ্জিন জল ঢেলে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছে। জল ফুরিয়ে গেলে ছুটছে জল আনতে। আগুনের সঙ্গে এক অসম লড়াই চলেছে রাত পেরিয়ে দিন। তারপর আবার রাতেও।
রবিবার ছুটির দিন থাকায় বাগরি মার্কেটে হাজার হাজার ক্রেতার ভিড় ছিল না। কিন্তু ব্যবসায়ী ও তাঁদের পরিচিতদের ভিড় ছিল। বাজারে আগুন লাগার খবর পেয়ে তাঁরা ছুটে এসেছেন ভোর হওয়ার আগেই। এসেছেন তাঁদের পরিজনেরাও। একদিকে তাঁদের সামাল দেওয়া। অন্যদিকে, আগুন লাগার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ঘটনাস্থলে আসা অজস্র কৌতুহলী মানুষকে নিবৃত্ত করা। সেও তো একরকম যুদ্ধই। আগুন নিভতে যত দেরি হচ্ছে, ততই বাড়ছে দুশ্চিন্তা। কৌতুহলী সাধারণ মানুষের জটলা থেকে এলাকার ব্যবসায়ী, দোকানদারদের মুখে ফিরে ফিরে এসেছে ১০ বছর আগের নন্দরাম মার্কেট অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহ স্মৃতি।
বাজারের ভেতরে ঢুকতে ১০ ঘন্টা সময় লেগেছে। তার আগে দমকল কর্মীরা মই লাগিয়ে আশপাশের বাড়ির ছাদ থেকে বিভিন্নভাবে আগুন নেভানোর লড়াই করেছেন। গ্যালন গ্যালন জল ঢেলেছেন। বিষাক্ত ধোঁয়া সামলাতে অক্সিজেন মাস্ক পরে যেতে হয়েছে বাজারের কাছে। তবুও তাঁরা গ্যাসকাটার দিয়ে দোকানের শাটার কেটে, জানলা ভেঙে জল দিয়ে আগ্রাসী আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছেন। জলের তোড়ে আগুন খানিক নিভছে। ফের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ছে। একটা সময়ে পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে, আগুন কোথা থেকে বেরিয়ে আসবে, তা বোঝাও দুষ্কর হয়ে পড়েছিল। বাজারের দেওয়ালে ফাটল ধরেছে। প্লাস্টারও খসে পড়েছে অনেক জায়গায়। আতঙ্ক ছড়িয়েছে, পাছে বাড়ির কোনও অংশ ভেঙে পড়ে। তার মধ্যেই ব্যবসায়ীদের অনেকে বাজারের অক্ষত মালপত্র বার করে আনতে ভিড় জমিয়েছেন। দমকলের ডিজি এবং কলকাতা পুলিসের বিশেষ নগরপাল (২) জয়ন্তকুমার বসু ঘটনাস্থলে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। বিভাগীয় উপনগরপাল এবং সহকারি কমিশনার পদমর্যাদার অফিসাররা চলে এসেছেন ঘটনাস্থলে। মাঝেমাঝে রটে যাচ্ছে, বাজারের পেছনদিকেও আগুন দেখা যাচ্ছে। আশপাশের বাড়ির লোকজনদেরও নিরাপত্তার জন্য অন্যত্র সরে যেতে বলা হচ্ছে। যেন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি। অগ্নিযুদ্ধ এখনও জারি আছে বড়বাজারে। ফুটপাতের একটি স্টল থেকেই বাগরি মার্কেটের বিল্ডিংয়ে আগুন ছড়িয়েছে, এমনটাই মনে করছেন দমকলের অফিসাররা। বিল্ডিং লাগোয়া ওই স্টলে আগুন লাগতে দেখেছেন স্থানীয় এক বাসিন্দা। ওই প্রত্যক্ষদর্শীর খোঁজও পেয়েছেন তদন্তকারী অফিসাররা। প্রাথমিকভাবে এটিকেই আগুনের উৎসস্থল বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও আগুন নিভলে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের মতমতের উপর ভিত্তি করেই শুরু হবে তদন্ত।