শহরে উৎসবের আমেজ। আর কয়েকদিন পরেই শুরু বাঙালির ১৩ পার্বণের সেরা পার্বণ দুর্গাপুজো। অন্যান্য বছরের মত এবারও বাজার ধরার লক্ষ্যে বাগরি মার্কেটের ব্যবসায়ীরা এখন থেকেই কম-বেশি জিনিসপত্র মজুত করতে শুরু করেছিলেন। বিগত কয়েক ঘন্টায় তার সবই জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গেল।
রবিবার সকালে বিষণ্ণ মুখে সেই কথাই বলছিলেন এক জুয়েলারি দোকানের কর্মী হীরেন দেশাই। সংস্থার কর্ণধার কেতন দেশাই ততক্ষণে বাকরুদ্ধ। বাগরি মার্কেটেই দেশাইদের দোকান এবং গোডাউন। শনিবার রাত ২টো ৩০ নাগাদ বড়বাজারের ৭১, ক্যানিং স্ট্রিটের বাগরি মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের জেরে এমনই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন শ’য়ে শ’য়ে ব্যবসায়ী। ক্যানিং স্ট্রিটের ঘিঞ্জি এলাকায় এই মার্কেট। ৬ তলার এই বাড়িতে মোট ৮টি ব্লক। প্রতিটি ব্লকে ৮০ থেকে ১০০ করে দোকান। স্বাভাবিকভাবেই পুজোর আগে প্রতিটি দোকানই মালপত্রে ঠাসা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে এখনও আগুন জ্বলছে। আর তাতেই পুড়ে ছাই হচ্ছে সেসব মালপত্র। ফুটপাথে ভিড় করে থাকা ব্যবসায়ীদের চোখের সামনেই পুড়ে যাচ্ছে তাঁদের কোটি কোটি টাকার মজুত জিনিস। এমনকি জাভেরি জুয়েলার্সের কর্ণধারও ৮ জন কর্মী নিয়ে পথে বসে রয়েছেন। চোখের সামনে আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে নিচ্ছে ৪০ বছর ধরে একটু একটু গড়ে তোলা ব্যবসার ইমারত। তাঁদের মতোই অসহায় হয়ে পথে বসেছেন বাগরি মার্কেটের অন্তত ১২০০ ব্যবসায়ী।
মার্কেটের ছ’তলা পর্যন্ত দাউ দাউ করে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। দমকল কর্মীরা এখনও প্রাণপণে চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে তাঁরা এক জায়গার আগুন নেভাচ্ছেন তো মার্কেটের অন্য কোনও অংশ থেকে উঁকি মারছে আগুনের শিখা। ঘিঞ্জি এলাকা হওয়ায় দমকল কর্মীদের আগুন আয়ত্তে আনতে যথেষ্টই বেগ পেতে হচ্ছে। মার্কেট এলাকার আকাশে হাজার হাজার তার জট পাকিয়ে থাকায়, হাইড্রোলিক ল্যাডার এনেও তা কাজে লাগানো যায়নি। খবর পাওয়া গেছে আগুন নেভাতে গিয়ে ৮ জন দমকলকর্মী আহত হন। এমনকি ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্ট শুরু হয় কয়েকজনের। যদিও প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
চোখের সামনে দাউ দাউ করে গোটা মার্কেট জ্বলতে দেখে ব্যবসায়ীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন মালিকপক্ষের ভূমিকা নিয়ে। এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘মার্কেটে মেডিসিন, জুয়েলারি, প্লাস্টিক খেলনা, ব্যাগ, কাপড়, কসমেটিক সহ নানা মাল থাকে। অগ্নিনির্বাপণের জন্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে খরচ নেওয়া হয়। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা করেনি মালিকপক্ষ।’ আগুন লাগার পর মার্কেটের জলের লাইন কেন কাজ করল না, সেই প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে। কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ও ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকলে কি এই অবস্থা হত?’ তবে এর পাশাপাশিই তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীদেরও একটা দায়িত্ব আছে। কী করে আগুন লাগল, তার বিস্তারিত তদন্ত হবে।’
বাগরি মার্কেটের মোট ৫টি গেট রয়েছে। লিফ্ট রয়েছে ২টি। স্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠনের আধিকারিক আশুতোষ সিং এদিন বলেন, ‘রোজ মার্কেটে প্রচুর মানুষ আসেন রুজির জন্য। আগুনের জন্য ব্যবসায়ীদের কয়েকশো কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।’ এরই মধ্যে যাঁদের দোকান কোনওক্রমে বেঁচে গেছে, সেই ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্র গুটিয়ে নিচ্ছেন। বেশিরভাগ মুখ অবশ্য নাচার, অসহায় এবং হতাশ। যেমন শনিবার রাত সাড়ে ৩টে থেকে মার্কেটের উল্টো দিকে বিষণ্ণ মুখে বসে রয়েছেন ওষুধের হোলসেল ব্যবসায়ী মিলন সিং। তিনি বলেন, ‘অনেকের রুজিরুটি জড়িয়ে রয়েছে এখানে। আগুনে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। জানি না কীভাবে ঘুরে দাঁড়াব।’ শুধু ব্যবসায়ী নন। বাগরি মার্কেটের ওপর নির্ভরশীল ২০০–রও বেশি কুলি ও মুটে। ব্যবসা সংক্রান্ত পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত আরও অসংখ্য মানুষ।
চারদিকে পোড়া, কটু গন্ধ। মাঝেমধ্যে শোনা যাচ্ছে বাজারের ভেতর থেকে আসা বিস্ফোরণের আওয়াজ। ব্যবসায়ীরা জানালেন, শব্দ করে ফাটছে পারফিউমের সিলিন্ডার। কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে আশপাশের আকাশ। উল্টোদিকের বাড়ির ছাদ থেকে জল দিচ্ছেন দমকল কর্মীরা। আশপাশের বাড়িতে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। যদি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে গোটা মার্কেটটাই! রাত থেকে ভোর। ভোর থেকে দিন গড়িয়ে রাত। জ্বলছে বাগরি মার্কেট। পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে একের পর এক ব্যবসায়ীর পুঁজি। যার অঙ্ক কয়েক কোটি।