দশ বছর আগে সরকারের একটা সিদ্ধান্তে শান্ত সিঙ্গুর বদলে গিয়েছিল আন্দোলনের অগ্নিভূমিতে। এক দশকের লড়াইয়ের পর সেই মাটিই লিখে দিল কৃষক বিদ্রোহের অন্য আখ্যান। যাঁর নেতৃত্বে ছিলেন বাংলার অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কারখানা হবে। একলাখি গাড়ি কারখানা। বহুফসলি জমিতেই হবে। সঙ্গে আছে ব্রিটিশ আমলের কৃষক-বিরোধী জমি অধিগ্রহণ আইন আর বিধানসভা ভোটে বিপুল জয়ের আত্মবিশ্বাস।বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ভরসায় ২০০৬ সালের মে মাসে সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানা তৈরির কথা ঘোষণা করে টাটা।
সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক কৃষকরা তখনই জানিয়েছিলেন, গায়ের জোরে বহুফসলি জমি অধিগ্রহণ তাঁরা মানবেন না। শোনেনি তৎকালীন বাম সরকার। শুরু হল আন্দোলন। যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে কত প্রতিবাদই তো হারিয়ে যায়। সিঙ্গুরের প্রতিবাদের মন বুঝতে দেরি করেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি পাশে দাঁড়িয়েছিলেন অনিচ্ছুক কৃষকদের।
এ মাটি তেভাগার মাটি। জান কবুল, ছাড়ব না জমি। ধেয়ে এল রাষ্ট্রের লেঠেলরা। পিঠের হাড় গুঁড়িয়ে দেওয়া লাঠির বাড়ি। চোখে ধাঁধাঁ লাগিয়ে দেওয়া কাঁদানে গ্যাস। জমি না দিতে চাওয়া মানুষগুলোকে জমিতে ফেলে বেধড়ক মার- কিছুই ছিলোনা। এর পরেও আছে। তাপসী মালিক, রাজকুমার ভুলের মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা আজও ভোলেননি বাংলার মানুষ। সিঙ্গুরের লড়াইয়ের বার্তা কলকাতা-সহ গোটা দেশ তথা বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সিঙ্গুরের বিডিও অফিস থেকে তাঁকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে দিল প্রশাসন। ফিরে এসে মেয়ো রোডে অবস্থানে বসলেন তিনি। আড়াই মাস পর জোর করে জমি নেওয়ার প্রতিবাদে ধর্মতলায় তাঁর ২৬ দিনের অনশন সিঙ্গুরের আন্দোলনে এঁকে দিল ল্যান্ডমার্ক।
সোনার ফসল ফলানো মাটি আগলে রাখতে কঠিন লড়াই। সে দিন অকুতোভয় আটপৌরে গ্রামবাসীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের সাহস হারাতে দেননি মমতা। জানতেন সিসিফাসের কাজ কখনও ফুরোয় না। সিঙ্গুরের সানাপাড়ায় ধর্নায় বসলেন তিনি। ১৫ দিনের ধর্নায় অবরুদ্ধ দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে। কাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হল টাটারা। রাজভবনে তত্কাকলীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর মধ্যস্থতায় বুদ্ধদেব-মমতা মুখোমুখি হলেও ভেস্তে গেল আলোচনা।
এরপর আরও আড়াই বছর ক্ষমতায় ছিল বামফ্রন্ট সরকার। যদিও, অনেকেই মনে করেন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামই ছিল তাদের ওয়াটারলু। সিঙ্গুর সরণি বেয়েই মহাকরণে পৌছে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েই জানিয়ে দেন জমি ফেরাবেই তাঁর সরকার। জমি ফেরাতে দুহাজার এগারোর জুনে বিধানসভায় পাশ হল সিঙ্গুর জমি পুনর্বাসন ও উন্নয়ন বিল। টাটারা কলকাতা হাইকোর্টে গেলে সেপ্টেম্বরে সিঙ্গল বেঞ্চ রায় দেয় সিঙ্গুর আইন বৈধ। সিঙ্গল বেঞ্চের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে ডিভিশন বেঞ্চে যায় টাটা মোটর্স।২০১২ সালের জুনে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ সিঙ্গুর আইন অবৈধ বলে রায় ঘোষণা করে।
জমি ফেরাতে সুপ্রিম কোর্টে যায় রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক কৃষকদের জন্য দুটাকা কিলো দরে চালের ব্যবস্থা হয়। তারপর শুধুই অপেক্ষা। অবশেষে স্বাধীনতার মাসের শেষ দিনে এল আনন্দের বার্তা। সুখের সাগরে ভাসল সিঙ্গুর। সুপ্রিম কোর্ট রায় দিল, সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ অবৈধ। অধিগৃহীত সব জমিই কৃষকদের ফিরিয়ে দিতে হবে। সবুজ আবির, মিষ্টি মুখ। দুর্গতিনাশিনীর পুজোর আগেই যেন দুর্গতিনাশ হল সিঙ্গুরে। ক্ষমতায় আসার পর ঘন ঘন সিঙ্গুরে আসা ছেড়ে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হয়ত তিনি মনে করেছিলেন, জমি যেদিন ফিরিয়ে দিতে পারবেন সেদিনই তিনি ফিরে যাবেন আন্দোলনের ধাত্রীভূমিতে।
৮ বছর আগে এই সেপ্টেম্বরেই সিঙ্গুরের সানাপাড়ায় জোর করে জমি নেওয়ার প্রতিবাদে ধর্নায় বসেছিলেন মমতা। সেই একই জায়গায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মাথায় নিয়ে তিনি ফেরালেন কৃষকের জমি। এত বছর ধরে যাঁরা ক্ষতিপূরণ নেননি তাঁদের হাতে তুলে দিলেন চেক। সম্পূর্ণ হল বৃত্ত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে লেখা হল কৃষক বিদ্রোহের নতুন গল্প। কৃষি জমি আন্দোলনের নতুন নাম হল সিঙ্গুর।
