সালটা ২০০২। দাঙ্গা বিধস্ত গুজরাতের আগুন তখনও নেভেনি। সেই আঁচে ধীরে ধীরে উতপ্ত হয়ে উঠেছিল ভারতের রাজনীতিও। স্বাভাবিকভাবেই সেই আগুনের হলকা লেগেছিল রাজধানীর সাউথব্লক ও নর্থব্লকেও। সেই মুহুর্তে দেশের সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুধাবন করে দ্রুত সাংবাদিক সম্মেলনের ডাক দিয়েছিলেন ক্ষমতাসীন এনডিএ সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। সেই সাংবাদিক সম্মেলনেই তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে পাশে বসিয়ে ‘রাজধর্ম পালনে’র উপদেশ দিয়েছিলেন বাজপেয়ী।প্রত্যুত্তরে নিচু স্বরে মোদী বলেছিলেন, ‘আমি সেটাই করছি যা আপনি করছেন’। সেদিন ওখানেই সাঙ্গ হয়েছিল বৈঠক।
এরপর কেটে গেছে প্রায় ১৬ বছর। গঙ্গা-যমুনা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। ইউপিএ১, ইউপিএ ২’ পেড়িয়ে ফের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার। সেদিনের গুজরাটের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীই দেশের কান্ডারী হিসেবে নিজেকে বসিয়েছেন পূর্বসূরিদের আসনে।
মোদীর শাসনে বিগত চার বছরে দেশকে চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে যথেষ্ট। জনপ্রিয়তার যে মোদী-ঝড় আদবানীকে সরিয়ে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর কুর্শিতে বসাতে সাহায্যে করেছিল, চার বছর পেরিয়ে সেই ঝড় কোথায় ম্লান। কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্ত হাওয়া বইলেও সেই উথাল-পাথাল হাওয়া আর নেই।দলের ভিতর-বাইরে সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে খোদ মোদীকেই। একদিকে উচ্চবর্ণের রোষ, অন্যদিকে তফসিলি জাতিদের অসন্তোষের জাঁতাকলে পড়ে কার্যত দিশেহারা বিজেপি। আডবানী, মুরলী মনোহরের মতো একাধিক বরিষ্ঠ নেতা দলে থেকেও প্রায় না থাকা অবস্থাতেই রয়েছেন। ফলে সমালোচিত হতে হয়েছে দলের মধ্যেও। বিরোধীদের আক্রমণ একের পর এক ধেয়ে এসেছে মোদীর দিকে। ‘স্বৈরাচারী’ এবং ‘অগনতান্ত্রিক’ তকমা তো আগেই ছিল। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে গো-রক্ষার নামে মানুষ খুন, কালো টাকা আদায়ের নামে বিমুদ্রাকরণ, ঋণ না শুধেই বিদেশে পালানো শিল্পপতিদের আটকাতে না পারা, রাফাল দূর্ণীতির মতো বিতর্ক। সবমিলিয়ে কোণঠাসা মোদী। দেশবাসীকে যে ‘আচ্ছে দিন’ এর স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন, তা পুরোপুরি ব্যর্থ।মোট কথা উন্নয়নের সামগ্রিকভাবে ফেল মোদী মডেল।
অবশ্যই মোদী এসব সমালোচনায় পাত্তা দেন না। তবে তাঁর রাজনৈতিক অস্তিত্বের পিঠে এতোগুলো অভিযোগ একধরনের বোঝা তো বটেই। এর মধ্যে ১৬ আগষ্ট মৃত্যু হয়েছে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর। সেই বাজপেয়ী, যিনি বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী হয়েও সহজেই কুড়িয়ে নিয়েছিলেন দেশবাসীর ভালবাসা, বিরোধীদের শ্রদ্ধা এবং যাঁর জাতীয়তাবাদী তেজের কাছে মাথা ঝোঁকাতে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্তান। এখন মোদী এবং দলের সংকট মুহুর্তে তাই বিজেপির ভরসা বা আশ্রয় সেই বাজপেয়ী।
বিজেপির দুদিনের কর্মসমিতির বৈঠকের পুরোটাই তাই ‘অটলময়’। আম্বেদকর ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের আশপাশে যত হোর্ডিং, প্রতিটিতেই বাজপেয়ীর হাসিমুখের ছবি স্লোগান উঠেছে ‘অজেয় ভারত, অটল বিজেপি’। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচন বৈতরণী পার হতে মোদীতে আস্থা হারিয়ে এভাবেই এখন বিজেপির একমাত্র আশা-ভরসা অটলে।
পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আগে এটাই বিজেপি-র শেষ কর্মসমিতির বৈঠক। লোকসভা ভোটের আগে আরও একটি বৈঠক হবে ঠিকই। কিন্তু তার আগে মূলত এই বৈঠকেই ঠিক হয়ে গেল বিধানসভা এবং লোকসভা ভোটের রণকৌশল। দলের এই সংকট মুহূর্তে কৌশলগত কারণেই উচ্চবর্ণের অটলবিহারী বাজপেয়ীকে সামনে রেখে অম্বেডকর ভবনে দুদিনের কর্মসমিতির বৈঠকের আয়োজন করেছিল বিজেপি। যা থেকে গেল ‘অটলময়’ হয়েই। বৈঠকে শাহনওয়াজ হোসেন বলেন, ‘এই প্রথম অটলজির অবর্তমানে বিজেপির কর্মসমিতির বৈঠক হচ্ছে। তাঁর পথে চলেই দল আজকের উচ্চতায় পৌঁছেছে’। বিরোধীদের কটাক্ষ, বেঁচে থাকতে অটলকে সম্মান দেননি মোদী। যেমন অটলের সঙ্গী লালকৃষ্ণ আডবাণী এখনও ব্রাত্য। বিরোধীরা যাই বলুক না কেন আগামী লোকসভা নির্বাচনের বৈতরনী পার করতে প্রয়াত অটলকেই বিজেপি যে রাজনৈতিক হাতিয়ার করবে তাতে সন্দেহ নেই। গত চার বছরে বিমুদ্রাকরন থেকে শুরু করে জিএসটি, দলিত শোষণ থেকে শুরু এনআরসি সব ইস্যুতেই মুখ পুড়িয়েছে শাষক দল। একজোট হয়েছে বিরোধীরা। তোড়জোড় চলছে আসন্ন লোকসভায় ফেডারেল ফ্রন্ট গড়ে বিজেপিকে ফের ক্ষমতায় আসা থেকে আটকাতে।বিগত কর্ণাটক নির্বাচন ও উপনির্বাচনগুলিতে তার প্রতিফলন পড়েছে। সেই কারনেই আগামী একবছর ব্যাপী অটল স্মরনে দেশব্যাপী কবিতা পাঠের আয়োজন থেকে ‘অটল অস্থি যাত্রা’-র মতো কর্মসূচির মাধ্যমে সাধারনের মনে অটল আবেগকে কাজে লাগিয়ে সুড়সুড়ি জাগানো যে কতটা আন্তরিক এবং কতটা রাজনৈতিক তা বোঝা খুব শক্ত নয়। তাই ১৬ বছর পর আজকের অভিভাবকহীন বিজেপি নির্বাচনী বৈতরণী পেরতে ‘জীবিত অটলে’ না হলেও ‘প্রয়াত অটলে’র পথই যে ‘অনুকরন’ করবে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।