পাইন গাছের আড়ালে ঘন কুয়াশা। সকাল থেকেই। কনকনে ঠান্ডাও। সঙ্গে হিমেল বাতাস! দার্জিলিঙের ম্যাল থেকে কয়েক বিঘত দূরে বসেছিল ওরা। এত ভিড়, জায়গা পায়নি। মঞ্চের কাছেই নেপালি কবি ভানুভক্ত আচার্যের মূর্তি। একটু আগেই কবিকে মালা দিয়ে সম্মান জানিয়ে মঞ্চে উঠে গেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । হিম ঠান্ডায় গরম চায়ে ওম্ নিচ্ছিলেন ওই যুবকেরা। বক্তৃতায় মমতা তখন বলছেন নেপালিতেই ‘পাহাড়কো উন্নতি চাইনছঁ। বিকাশ, শান্তি চাইনছঁ…’ শুনেই উচ্ছ্বসিত, করতালি ওদের।
আর এভাবেই শান্তি এবং উন্নয়নের বার্তা দিয়ে পাহাড়বাসীর ঘরের মেয়ে হয়ে উঠলেন মুখ্যমন্ত্রী। হবেন না-ই বা কেন! সাত দশকের অপেক্ষা শেষে স্বপ্নপূরণের কাণ্ডারী সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দার্জিলিঙে কোনও বিশ্ববিদ্যালয় না থাকার আক্ষেপ মিটিয়ে দিলেন তিনিই। শিক্ষক দিবসে ম্যালের মঞ্চ থেকে দার্জিলিং হিল ইউনিভার্সিটির নির্মাণকাজের শুভ সূচনা করে পাহাড়ের বুকে ইতিহাস রচনা করলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর এই পদক্ষেপে আপ্লুত গোটা পাহাড়। শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, পড়ুয়া থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মহলও মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বিনয় তামাংয়ের আক্ষেপ, স্বাধীনতা–পরবর্তী দেশের কোনও সরকার তাঁদের এই আর্জিতে কর্ণপাত করেনি। যা করে দেখালেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি পাহাড়বাসীর হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে ধন্যবাদবার্তা জানান মুখ্যমন্ত্রীকে। মমতা বলেন, ‘তেনজিং নোরগে, নেপালি কবি ভানুভক্ত ও কাঞ্চনজঙ্ঘার নামে তিনটি পৃথক ক্যাম্পাস থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়ে। হিমালয়ান স্টাডিজ, হিউম্যানিটিস, সোশ্যাল সায়েন্স, সাংবাদিকতা, বিজ্ঞান, পর্যটন ও প্রযুক্তির বিভিন্ন ধারায় পড়াশোনার সুযোগ থাকবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়ানো হবে ভোকেশনাল কোর্সও’। রাজ্যে ক্ষমতায় এসে ২৩টি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছে রাজ্য সরকার। আরও ৯টি তৈরি হচ্ছে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। দার্জিলিং হিল ইউনির্ভাসিটিকে কেন্দ্র করে মংপু এলাকায় পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজও শুরু হয়েছে।
২০১৭ সালের জুন মাস থেকে পাহাড়ে টানা আন্দোলনের পর দার্জিলিঙে এটাই মুখ্যমন্ত্রীর প্রথম প্রকাশ্য সভা। এর আগে জুন মাসে শিল্প সম্মেলনে এলেও সেবার প্রকাশ্য সভার কর্মসূচি ছিল না। এদিন তাই পাহাড়ের প্রতি তাঁর আবেগকে তুলে ধরতে কসুর করেননি মুখ্যমন্ত্রী। জানিয়ে দেন, পাহাড় বরাবরই তাঁর হৃদয়ের কাছাকাছি। সুযোগ হলে পাহাড়ে এসেও থাকতে চান তিনি। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘পরবর্তী সফরের সময় একসঙ্গে ২৮ হাজার ছাত্রছাত্রীকে ব্যাগ ও বর্ষাতি তুলে দেওয়া হবে।’ পাহাড়ের বনবস্তির বাসিন্দাদের হাতে পাট্টার নথিও এদিন তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী। মোট ৪৩১ জনকে এই সংক্রান্ত নথি তুলে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা, প্রথম দফায় যাঁরা ফরেস্ট রাইটের নথি পেলেন, তাঁরা পরবর্তীকালে জমির অধিকারও পাবেন। দুটি ধাপে আইন মেনে এই কাজ হবে। যাঁরা সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন, তাঁরা না জেনেই এমনটা করছেন বলে কটাক্ষ মুখ্যমন্ত্রীর। পর্যটন দপ্তর থেকে হোম স্টে–র পরিকাঠামো নির্মাণে গাইডলাইন ঠিক করে দেওয়া হবে বলেও ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এর পাশাপাশি দার্জিলিং শহরকে সাজিয়ে তুলতে ক্যাপিটাল হলের ঘড়িটি সংস্কার করে হলটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি, শহরের নেহরু রোডকে পায়ে চলার জন্য বিশেষভাবে সাজিয়ে তুলতে দার্জিলিং পুরসভাকে পরামর্শ দেন তিনি। লালকুঠি সংলগ্ন এলাকাকে কীভাবে পর্যটনের বিকাশে কাজে লাগানো যায়, তাও দেখার নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী।