প্রথমে যা ছিল ব্লু হোয়েল- এর মতই মারণ গেম, সেটাই এখন নতুন প্রজন্মের কাছে নিছক ‘ফান গেম’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত কয়েকদিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় যে ব্যাপারটি নিয়ে, তা হলো ‘মোমো চ্যালেঞ্জ’। ফেসবুক বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা প্রতিনিয়ত নিজেদের অবসাদের কথা লিখছিলেন, তাদেরই মূলত পাঠানো হচ্ছে এই মোমো গেমের লিঙ্ক। বেশ কিছুদিন ধরেই বহু মানুষের হোয়াটসঅ্যাপে আসছে একটি মেসেজ, ‘হাই দিস্ ইস্ মোমো’। তারপরেই তাদের পাঠানো হচ্ছে মোমো গেমের লিঙ্ক বা ফাইল এবং একইসাথে তাদের প্রণোদিত করা হচ্ছে এই খেলায় অংশ নেওয়ার জন্য। গুজব রটেছিল, লোভনীয় মোমো কথাটির ফাঁদে পড়ে খেলা শুরু করলেই নাকি পরিণতি হবে মৃত্যু। এখনও তেমন কিছু ঘটেনি বলেই খবর।
রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে মোমো এখন কার্যত ছেলেমানুষির স্তরে নেমে আসায় সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় পড়েছে পুলিশ। গত এক সপ্তাহে কলকাতা এবং রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে মোমো গেমের ভয়ে শিশু থেকে বৃদ্ধরা ছুটে গিয়েছেন থানায়। কলেজ পড়ুয়া এক যুবতী থানায় অভিযোগ জানান, তার মোবাইলে একটি অচেনা নম্বর থেকে ফোন করা হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে খবর দেওয়া হয় সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞ বিভাস চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। তিনি দেখেন, নেটকল থেকে ওই ফোন কল করা হয়েছিল। ফলে যে নম্বর থেকে ফোন এসেছে, তাতে +৯১ নেই। তবে এটা যে নিছকই দুষ্টুমি করার জন্য করা, তা বুঝতে পারেন তাঁরা। বিভাসবাবু জানান, ‘শুধু এখানেই নয়, রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে এ রকম অভিযোগ আসছে। অনেকেই এটা জানেন না, নেটকল করতে গেলে, যে নম্বর থেকে ফোন বা হোয়াটসঅ্যাপ করা হবে, তার নম্বর ইচ্ছেমত সেট করে নেওয়া যায়। যেমন, বহু মোমো গেমের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে +১(৩১৫) নম্বরটি আগে সেট রাখা হচ্ছে। চাইলে এটিকে ১২৩-ও করা যেতে পারে।’
পুলিশ কর্তাদের বক্তব্য, সাধারণ মানুষ ভয় পেয়ে তাদের কাছে এলে, প্রাথমিক ভাবে খোঁজখবর করতেই হয়, কিন্তু শেষে যদি কোনও রসিকতার বিষয় সামনে আসে, তাহলে সময় এবং শ্রম দু’য়েরই অপচয় হয়। এমনই একটা ঘটনা ঘটেছে ফুলবাগানের বাসিন্দা, দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী মধুমিতা চক্রবর্তীর ক্ষেত্রে। তার মোবাইলে রবিবার একটি নম্বর থেকে মোমো খেলার আমন্ত্রণ আসে, হোয়াটসঅ্যাপেই। স্বাভাবিক ভাবেই ভয় পেয়ে যায় মধুমিতা। স্নাতকোত্তরের ছাত্রী, তার দিদি মঞ্জুরি চক্রবর্তী কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজের ইনবক্সে গিয়ে গোটা ঘটনাটি জানায়। পুলিশ সাথে সাথেই একটি ভিডিয়ো পাঠিয়ে কী করা উচিত, সে সম্পর্কে পরামর্শ দেয়। ভিডিয়োয় দেওয়া নম্বরে ফোন করলে, সেখান থেকে নানারকম পরামর্শ দিয়ে তাদের দুই বোনকে বলা হয় আতঙ্কিত হবেন না। পুলিশের ভূমিকায় ওই দুই ছাত্রী খুব খুশি। রবিবার সকালে নিজের হোয়াটসঅ্যাপে এমনই একটি বার্তা পান বিশরপাড়ার বাসিন্দা সমাপন মিশ্র। তাকেও এই গেম খেলার আমন্ত্রণ পাঠানো হয়। তবে সমাপন মজা করেই সেই বার্তার ইংরেজিতে ভুল ধরা শুরু করেন। বেশ কয়েকবার তাঁকে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট-সহ অন্যান্য ডেটা হ্যাক করার হুমকি দেওয়া হয়, কিন্তু সমাপন সেসবে আমল না দিয়ে, মা কালীর একটি ছবি পাঠিয়ে মজা করায়, বড় বড় চোখের কিম্ভুতকিমাকার ‘মোমো’ আর উত্তর দেয়নি।
কেন এমন ঘটছে? মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সাগ্নিক মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘দেখুন, হয়ত যাঁরা হোয়াটসঅ্যাপে মোমো খেলার জন্য হুমকি দিচ্ছেন, তাঁদের এতে কোনও সেকেন্ডারি গেইন আছে। ‘মোমো’- কে সামনে রেখে, সেইসব মিটিয়ে নিতে চাইছে তাঁরা। এটাকে স্যাডিস্টিক ফিলিং বলা হয়। আসলে এখন বহু মানুষ’ই একাকিত্বে ভোগেন। সেটারও সুযোগ নেওয়া হচ্ছে এতে।’ রবিবার এক সিআইডি অধিকর্তা বলেন, ‘এ নিয়ে অযথা ভয় পাওয়ার কারণ নেই। আমাদের কাছে খবর আছে, এখন এই গেম নিয়ে মজা করা হচ্ছে। তাতেই অযথা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।’ তবে মোমো নামধারী, ডিপিতে এমন অদ্ভুতুড়ে ছবি লাগানো হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্টগুলোই যে এখন পুলিশের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।