নেটফ্লিক্স, হাল আমলে বিনোদনের এক অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠেছে নতুন প্রজন্মের কাছে। এখানেই ইদানীং মুক্তি পাচ্ছে একের পর এক সাড়া জাগানো সব ওয়েব সিরিজ, যেগুলি রীতিমত উচ্চ প্রশংসিত এবং সমাদৃত হচ্ছে দর্শকমহলে। মূলত ব্যস্ত নাগরিক জীবনের দোরগোড়ায় বিনোদন পৌঁছে দিতে, নেটফ্লিক্সের যে প্রচেষ্টাটি শুরু হয়েছিল অনলাইন স্ট্রিমিং- এর মাধ্যমে, তা যে এখন অন্যরকম একটা উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছেছে, তা বলাই বাহুল্য। নেটফ্লিক্স এখন নিজেরাই একের পর এক সিনেমা প্রযোজনা করছে, ওয়েব সিরিজ বানাচ্ছে ‘নেটফ্লিক্স অরিজিনাল’ এর ব্যানারে। কোনও সিনেমা হল বা টিভি প্রিমিয়ারের পরিবর্তে সেগুলো মুক্তি পাচ্ছে নেটফ্লিক্সের অনলাইন প্ল্যাটফর্মেই।
গত ২৪ আগস্ট, মুক্তি পেয়েছে নেটফ্লিক্সের নতুন ‘অরিজিনাল’, তিন এপিসোডের মিনি হরর সিরিজ ‘ঘুল’ এবং মুক্তি পাওয়ার মাত্র তিনদিনের মধ্যেই যার ভিউ বিলিয়ন পেরিয়েছে। ‘ঘুল’ ওয়েব সিরিজটি নিয়ে বিশদভাবে কথা বলার আগে, এই ঘুল নামকরণের কারণ এবং এই নামটি নিয়ে প্রচলিত কিংবদন্তীটির উপর আলোকপাত করা যাক। ‘Ghoul’ বা ‘ঘুল’ শব্দটির উৎপত্তি আরবি শব্দ ‘ghul’ থেকে হয়েছে। আরবি লোকগাথায় ‘ঘুল’ এমন এক বিশেষ জিন, যা কবরস্থান অথবা নির্জন স্থানে আস্তানা গড়ে। ইবলিশের শিষ্য হিসেবে এই ঘুল প্রজাতির জিনেরা পশুপাখি থেকে শুরু করে মানুষের রূপও ধারণ করতে পারে। মানুষখেকো বলে পরিচিত এই জিনের অস্তিত্ব পারস্যের লোকগাথাতেও বিদ্যমান। এছাড়া আরবি ভাষায় মাঝেমধ্যে লোভাতুর ব্যক্তিবর্গকেও ‘ঘুল’ বলে ভূষিত করা হয়। কোনও মানুষ নিজের রক্ত দিয়ে একটি নির্দিষ্ট নকশা বানিয়ে ঘুল-কে আমন্ত্রণ জানাতে পারে তার নিজের আত্মার বিনিময়ে। সাধারণত কারও ক্ষতিসাধনের জন্যই ঘুল-কে ডাকা হয়। কিংবদন্তী রয়েছে, এরা মৃত মানুষের লাশে ঢুকে তার দেহ ধারণ করে বা জীবন্ত অথচ মানসিকভাবে দুর্বল কোনও মানুষের শরীরেও প্রবেশ করতে পারে। তবে ঘুলের বিপরীত সত্তা হিসাবে ইনলামি লোকগাথায়, আলো ও আগুন থেকে উৎপন্ন শুভ শক্তি ঘায়েব-এর কথাও রয়েছে।
এই ঘুল-কেই একপ্রকার প্রোটাগনিস্ট করে, প্যাট্রিক গ্রাহাম নামের মুম্বাইকেন্দ্রিক এক ব্রিটিশ ফিল্মমেকার বানিয়েছেন তার নতুন হরর থ্রিলার। ঘুল- এর বিষয়বস্তু রাষ্ট্রের সম্ভাব্য রাজনৈতিক পরিবেশ। যেন এ এক অস্থিতিশীল ও অরাজকীয় ভবিষ্যতের অরূপকথা। সেই ভবিষ্যতে দেখা যায়, সন্ত্রাসবাদ ও দেশদ্রোহ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। আর দেশের এমন এক সংকটাবস্থায় দেশ শাসনের গুরুভার যাদের উপর অর্পিত ও দেশের সার্বিক তত্ত্বাবধানে যারা নিযুক্ত, তাদের ক্রমশ কঠোর হয়ে উঠতে হচ্ছে প্রতিমুহূর্তেই। এমন সময়ে সন্ত্রাসবাদী ও দেশদ্রোহীদের শক্ত হাতে নির্মূল করতে, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন মিলিটারি ব্যবস্থার অধীনে ‘ন্যাশনাল প্রোটেকশন স্কোয়াড’ গঠন করা হয়। সারা দেশের আনাচে কানাচে গড়ে ওঠে একের পর এক ডিটেকশন সেন্টার। আসলে নামেই সেগুলি ডিটেনশন সেন্টার, চরিত্রে এক একটি হিটলার আমলের আস্ত কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। এই সমস্ত সেন্টারগুলিতেই নিয়ে আসা হয় কিছু দেশদ্রোহী এবং দেশদ্রোহী সন্দেহে আটক করা হাজার হাজার নির্দোষ আম জনতাকে। তারপর চলে তাদের উপর পাশবিক অত্যাচার এবং একটা সময়ের পর খুন করে গুম করে দেওয়া হয় তাদের লাশ। তাদের ব্যবহৃত সরঞ্জাম পড়ে থাকে এক বন্ধ কুঠুরিতে।
গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে নিদা রহিম নামক সৎ, দায়িত্ববান এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে অঙ্গীকারবদ্ধ এক এনপিএস(ন্যাশনাল প্রোটেকশন স্কোয়াড)- এর সদস্য। তাকে ঘিরেই চলতে থাকে চিত্রনাট্যের ঘটনাপ্রবাহ। গল্পের প্রায় শুরুতেই আমরা, রাষ্ট্র নামক যন্ত্রের মাধ্যমে নিদার মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়া অন্ধ দেশপ্রেমের পরিচয় পাই, যা আসলে একপ্রকার নির্বুদ্ধিতারই লক্ষণ। নিজের পিতাকে সন্দেহভাজন মনে করে রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে তুলে দেওয়া নিদাকে, ন্যাশনাল প্রোটেকশন স্কোয়াডের মিলিটারি অফিসার হিসেবে মেঘদূত-৩১ নামে একটি মিলিটারি ডিটেনশন সেন্টারে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয়। শাসনতন্ত্র ও প্রশাসনের উপর অগাধ আস্থা রাখা নিদা, দেশের মঙ্গলের জন্য নিজের স্বার্থ, পরিবার, এমনকি জীবন দিতেও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। কিন্তু মেঘদূতে পা দেওয়া মাত্রই তার দীর্ঘদিনের লালন করে আসা আস্থা ও বিবেকের গায়ে চিড় ধরতে শুরু করে যখন সেখানে ভয়ংকর ও কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদী আলি সাঈদের আগমন ঘটে। এখান থেকেই ঘুরে যায় গল্পের মোড়। ঘটনাপ্রবাহে আমরা জানতে পারি, আসলে আলি সাঈদ নয়, তার দেহ ধারণ করে মেঘদূতে পা রেখেছে ঘুল; যাকে এই ডিটেনশন সেন্টারে ডেকে এনেছে এখানেরই কোনও একজন। এরপর চিত্রনাট্য আরও জোরালো হয়ে ওঠে, পর্দায় তখন একের পর এক খুন। রক্তে ভেসে যাচ্ছে এই বিশাল কয়েদখানার অলিগলি, প্রতিটা বন্ধ কুঠুরি। নিদার চোখের উপর, অন্ধ দেশপ্রেমের কালো পটির বাঁধনটি ক্রমশই আলগা হতে থাকে। ধীরে ধীরে নিদার নজরে পড়ে, স্কোয়াড শুধু কুখ্যাত সন্ত্রাসী ও দেশদ্রোহীদের নয়, বরং অনেক মুক্তমনা ও স্বাধীন চিন্তাচেতনার পৃষ্ঠপোষকদেরও অবলীলায় ধরে নিয়ে নির্মম বিচার ব্যবস্থার সম্মুখীন করে, তাদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালায়। এরপর? নাহ, হরর থ্রিলারের ক্ষেত্রে এর থেকে বেশি না বলাই ভাল।
ইতিমধ্যেই প্রচুর আন্তর্জাতিক অ্যাক্লেমেশন পেয়ে গিয়েছে এই ওয়েব সিরিজটি। চিত্রনাট্য এবং সংলাপ লেখার ভার নিজের হাতেই নিয়েছিলেন গ্রাহাম। যে কোনও হরর থ্রিলারের মত প্রতিমুহূর্তেই ‘কী হয়? কী হয়?’ ভাবটা চিত্রনাটে খুব জোরালো ভাবেই ছিল। এছাড়াও ভয় পাওয়ার আরও নানা উপদান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। জয় ওঝা ও জয় প্যাটেলের ক্যামেরা যেন সরীসৃপের মতই বুকে হেঁটে ঘুরে বেড়িয়েছে গোটা কয়েকখানার অন্ধকার ও রক্তে ভেজা গলিপথ এবং চোরাকুঠুরিগুলিতে। নরেন চন্দভাকর আর বেনেডিক্ট টেলরের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর শুনে গা শিউরে ওঠে বেশ কয়েক জায়গায়। রাধিকা আপ্তের উচ্চমানের অভিনয়, নিদা চরিত্রটিকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। এক কথায় বলতে গেলে, এই ওয়েব সিরিজে তাঁর উপস্থিতি লার্জার দ্যান লাইফ। এছাড়া আলি সাঈদ- এর চরিত্রে অভিনয়কারী মহেশ বালরাজ, খুব অল্প সময়ের জন্য পর্দায় হাজির থেকেও নিজের অভিনয়শৈলীর গুণে দর্শকের মনে দাগ কেটে যায়।
শেষে আলাদা করে বলতেই হয় পরিচালক প্যাট্রিক গ্রাহাম- এর কথা। যেভাবে তিনি এই গোটা সিস্টেমটাকেই ঘুল- এর রূপে হাজির করেছেন দর্শকের সামনে বা দর্শকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন ঘুল এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যেকার সাদৃশ্যগুলো, তা যথেষ্ট প্রশংসনীয়।