“ক্ষমতায় এলে পশ্চিমবঙ্গেও এন আর সি হবে, বাংলাদেশী মুসলমানদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করব”- বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে হুঙ্কার ছাড়লেন দিলীপ ঘোষ। রিষড়া এবং বাংলায় অন্যান্য জায়গায় বিজেপি মিছিল করল এন আর সির দাবিতে। মিছিলের স্লোগান হিন্দিতে, ৯০ শতাংশ অবাঙালি, প্রসঙ্গত বাংলায় ৮৬ শতাংশ বাঙালি। বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলিমদের ফেরত পাঠানো হবে, চারিদিকে রটিয়ে দেওয়া হল। দিলীপ ঘোষ শুধু একা বিদ্বেষ ছড়াতে পারেন না, আরও বড় বড় স্যাম্পেল আছে বিজেপির অস্ত্রাগারে। কিছুদিন অন্তর্ধানের পর আবার আবির্ভূতা হলেন রূপা গাঙ্গুলী, তিনি দিলীপ বাবুকে এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়তে রাজি না। তাই কয়েক কদম এগিয়ে বলে দিলেন, মুসলমানদের দেশ বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ হিন্দুদের।
বর্তমানে বিজেপি নখ দাঁত বের করা হিংস্র জন্তুর মতো। বাংলার মুক্ত বাতাসে বিষ চড়াচ্ছে, দাঙ্গাবাজরা ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। বাংলার মাটি বিজেপির জন্য সবচেয়ে শক্ত জমি! এখানে সাম্প্রদায়িকতার চাষ এতটা সহজ নয়। তাই তাদের কুখ্যাত আইটি সেল সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে, ফেসবুক ও হোয়াটস্যাপের মাধ্যমে মানুষের মাথায় ধর্মবিদ্বেষ ঢোকানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টা চলছে। মিথ্যে তথ্য, মিথ্যে ইতিহাস, অন্য জায়গার দাঙ্গার ভিডিও- এসব ছড়িয়ে কার্যসিদ্ধি করতে চাইছে। একটা অংশের যুব সমাজ প্রভাবিত হচ্ছে, দাঙ্গাবাজদের স্থানীয় কিছু ঠিকাদার তৈরিও হয়েছে, তারা আগুন নিয়ে খেলতে চায়। কিন্তু বাঙালিও পালটা প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। মানুষ উত্তর ভারতীয় হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীদের হিসাব নিতে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে।
আসামে এন আর সি র মাধ্যমে অবৈধ বাংলাদেশি মুসলমান তাড়ানোর মিথ্যে গল্পকে ঢাল করে বাংলায় হিন্দু-মুসলিমে বিভাজন করতে নেমেছিল। আসাম ল্যাবরেটরি, সফল হলেই বাংলায় হবে। তাই বাংলায় এন আর সি র হুমকি দিচ্ছিল বিজেপি। কিন্তু আস্তে আস্তে ঝোলা থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়ছে। আসামে এন আর সি র চূড়ান্ত খসড়ায় ৪০ লাখ মানুষের নাম নেই, অধিকাংশই বাঙালি। বিভিন্ন জায়গায় কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে এর মধ্যে ২২-২৫ লাখ হিন্দু বাঙালি। মিথ্যের বেশাতি খসে পড়ছে, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে অত্যাচারিত হচ্ছে। বাঙালিই আসল টার্গেট, এই এন আর সি বাঙালিকে শেষ করার আইনি শিলমোহর মাত্র। আতঙ্কে বহু হিন্দু বাঙালি আত্মহত্যা করেছেন। ডিটেনশন ক্যাম্পে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালি মহিলাদের উপর পাশবিক অত্যাচার চলছে। ডিটেনশন ক্যাম্পে রেহাই নেই ৭ বছরের বাচ্চা থেকে ১০২ বছরের বৃদ্ধর। বাঙালিকে বেছে বেছে ডি-ভোটারের নোটিশ দেওয়া হচ্ছে।
অবৈধ বাংলাদেশি মুসলমান তাড়ানোর মুখোশ পড়ে, প্রথমে বাঙালিকে হিন্দু-মুসলমান ও ঘটি-বাঙালে ভাঙতে চায়। বাংলা ভাগের যে যন্ত্রণা, সে ক্ষতটাকে খুঁচিয়ে রাজনীতি করাই লক্ষ্য। ঘটিদের মধ্যে মিথ্যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি এবং উদ্বাস্তু হিন্দুদের মধ্যে ওপার বাংলার বাস্তবতা নিয়ে ইতিহাসকে নতুন ভাবে পরিবেশন করার চেষ্টা চলছে। লক্ষ্য করুন, ঝাড়গ্রাম-পুরুলিয়ার মতো আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় আদিবাসী বনাম বাঙালি লড়াই লাগানো বিজেপির আশু লক্ষ্য। আদিবাসীদের প্রতি যে ঐতিহাসিক বঞ্চনা, তাকে কাজে লাগিয়ে কায়েমী স্বার্থে বিভেদ চায় হিন্দুত্ববাদীরা। কিন্তু গত কয়েকবছরে বাংলার আদিবাসীরা নানা সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে আলোকপ্রাপ্ত। আবার উত্তরবঙ্গে কামতাপুরী ইস্যুকে জীবন্ত করতে চায়, বিজেপি নেতা মুরলী দেওধর পশ্চিমবঙ্গের এক ম্যাপ ট্যুইট করেন, যেখানে উত্তরের আটটা জেলা ছিল না। অর্থাৎ উত্তরবঙ্গ বনাম দক্ষিণবঙ্গ করে উত্তরবঙ্গকে বাংলা থেকে আলাদা করতে চায়। উস্কানি দেওয়া হচ্ছে রাজবংশী, কোচ ও মেচ ইত্যাদি জাতির মানুষকে। গোর্খাল্যান্ড নিয়ে বিজেপির অবস্থান তো সর্বজনবিদিত, পাহাড়ে আগুন জ্বালাতে তারা সিদ্ধহস্ত।
বিহার ও ঝাড়খণ্ডের বর্ডার এরিয়ায় অবাঙালি দাঙ্গাবাজদের দাপট বাড়ছে, আরএসএস-বজরং দলের গুণ্ডাবাহিনী দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি করছে। বাঙালি বনাম অবাঙালি বিভাজন এখানেও, অবাঙালিদের দাপট বর্ডার এলাকার সব মফঃস্বল ও শহরে। বাঙালিরাদের কোনঠাসা করে ফেলা হচ্ছে, এমনকি দাঙ্গার সময় শুধু হিন্দিভাষী মানুষের ভিড়। আবার শোনা যাচ্ছে, বিজেপির টিম আসছে বাংলাদেশ বর্ডার সংলগ্ন এলাকায় এন আর সির মাহাত্ম্য প্রচারে।
পুরোটাই বুঝতে পারছেন, বাংলার প্রতিটা প্রান্তে নানা রকম বিভাজনের রাজনীতি করে বাংলায় ভোট বৈতরণী পার করতে চায় বিজেপি। কারণ তারা অন্য কোনো ভাবেই বাংলায় দুর্জয় ঘাঁটিতে স্থান পাবে না। হয়ত বিজেপি ভুলে গেছে, রাজ্যটার নাম বাংলা! সাম্প্রদায়িক শক্তির জন্য এ জমি বড়ই রুক্ষ্ম। ইদানীং কিছু দাঙ্গাবাজ গজিয়ে উঠছে বটে, কিন্তু উল্টোদিকে বাঙালি জাগছে, ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষ জাগছে। এই বিভাজনের রাজনীতিকে বাংলার মানুষ বঙ্গোপসাগরে বিসর্জন দেবে। বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়ে চোখে চোখ রেখে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত )