প্রীতম মিত্রকে আপনারা অনেকেই হয়তো চেনেন না। আমিও চিনি না। আজ সকালের খবরের কাগজ এই নামটার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। আপনাদের মধ্যে অনেকে আজকের কাগজেই দেখেছেন তার নাম। যাই হোক, আমি প্রীতমের পাশে আছি। এবং আমি মনে করি আপনাদের প্রত্যেকের তার পাশে থাকা উচিৎ। কারণ, যে কাজটা আমাদের সবার করা উচিৎ কিন্তু নানা অজুহাতে আমরা তা এড়িয়ে যাই সে কাজটাই করেছেন প্রীতম। নিজের মত করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় লাগাতার নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। তাই তিনি ফোনে গত কয়েকদিন ধরে খুনের হুমকির শিকার হচ্ছেন। এই ঘটনা ঘটছে প্রগতিশীলতার বড়াই করা আমাদের প্রিয় শহরে।
প্রীতম মিত্র বছর আঠাশের এক যুবক। পেশায় আলোকচিত্রী। আগে ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি করতেন, এখন করেন ওয়েডিং ফটোগ্রাফি। এই যুবকটির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মত ঘটনাকে যারা অন্যায় বলে মনে করেন তাদের সবারই তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। কিন্তু আজ প্রীতমের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম, ভালো কাজের এমন প্রতিক্রিয়ার জন্য তিনি তৈরি ছিলেন না। বারবার আমার কাছে তিনি জানতে চাইছিলেন, ব্যাপারটা ঠিকঠাক মিটে যাবে তো? বোঝা গেল তিনি ভয় পেয়েছেন। আমার মনে হয়, ভয় পাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হল পুলিশ পাশে এসে দাঁড়ালেও নাগরিক সমাজ ও প্রতিবেশীরা তার পাশে সেভাবে দাঁড়ান নি। পুলিশের চেয়ে এই নাগরিক সহমর্মিতাটুকু তার কাছে আরও বেশি জরুরি ছিল।
একজন ফটোগ্রাফার হিসেবে আমি জানি, যে কোন পেশাদার তার নিজস্ব দক্ষতাটুকু দিয়ে জীবনের সব সমস্যাগুলিকে স্পর্শ করতে চান। প্রীতমও তাই করেছেন। ছবির মাধ্যমে তিনি করেছেন ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনার বিরুদ্ধে একটা শিল্পিত প্রতিবাদ। দীর্ঘদিন আমি খবরের কাগজে চিত্র সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছি। লক্ষ্য করেছি, নিয়মিত রুটিন অ্যাসাইনমেন্ট করতে করতে আমাদের নিজেদের চিন্তাধারাও কেমন যেন একটা বাঁধা গতে বইতে শুরু করে। তার বাইরে আর যেন ভাবতেই পারিনা। আমার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। ছবি তোলা মানে যেন দীর্ঘদিন একরকম ভাবে একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি। তার ভেতরে ঢোকা নয়, যা ঘটছে তাকে বদলে দেওয়া নয়, তাতে ইনভলভ হওয়া নয়। শুধু আমি নয়, আমার অনেক সহযাত্রী বন্ধুরাই এই ভাবনার শিকার হয়েছেন। এই মানসিকতা থেকেই কেউ ট্রেনে কাটা পড়ে আর্তনাদ করলেও আলোকচিত্রী ছবি তোলা ছাড়া আর কিছুই করেন না। তার সামনেই আহত লোকটি মারা যান। আমরা আলোকচিত্রীরা কেমন যেন সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। আমার ভাবতেও ভাল লাগছে কলকাতার একজন তরুণ আলোকচিত্রী এই ভাবনার বাইরে বেরিয়েছেন।
প্রীতমের ছবিতে ধরা পড়েছে এক নগ্নিকা, যার মাথায় টোপর, কপালে সিঁদুর, চিবুক ছুঁয়ে আছে হাতে ধরা জোড়া পানপাতা। বুক ঢাকা পড়েছে হাত ও চুলে। যৌনাঙ্গ আড়াল করে রয়েছে লক্ষ্মীর গাছকৌটো। এই ছবির মধ্যে উদ্ভাবনী প্রতিবাদ ছাড়া কোন যৌনতা আছে বলে আমার মনে হয় নি। কিন্তু একশ্রেণীর নীতিবাগীশ লুম্পেনদের মনে হয়েছে এবং প্রতিবাদের নামে তারা অশ্লীল গালিগালাজ ও ফোনে প্রীতমকে হুমকি দিয়ে চলেছেন। প্রীতম খোলাখুলিই জানালেন, কোনরকম যৌনতার প্রদর্শনী করা তার উদ্দেশ্য ছিলনা। যদি কেউ এরফলে আহত বা অপমানিত বোধ করে থাকেন, তার জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশও করেছেন, কিন্তু তারপরেও হুমকি থামেনি।
ভেবেছিলাম শহরের আলোকচিত্রীদের বিভিন্ন সংগঠন এই ঘটনার প্রতিবাদ জানাবে এবং প্রীতমের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু তেমন কিছু এখনও ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। নাগরিক অধিকার রক্ষার স্বপক্ষে যারা সরব হন তারাও নিশ্চুপ। অবস্থা এমন হলে প্রীতমের মত তরুণরা কিন্তু আর প্রতিবাদের সাহস দেখাবেন না। নারী নির্যাতনের ঘটনা বাড়বে। যে কোন অন্যায়কারীরাই ঠিক এই জিনিসটাই চায়। তারা মানুষের প্রতিবাদ ও নৈতিকতার বোধটাই মুছে ফেলতে চায়। প্রতিবাদ ও হুমকির ভাষা শুনে এবং প্রীতমের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে, এটা একটা সংগঠিত চক্র। যারা চায় না মানুষ নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরব হয়। এমন ঘটনার পিছনে আদতে মেয়েদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ভাবা কোন রক্ষণশীল রাজনীতির প্রশ্রয় থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায় প্রীতম অন্যায় করেছেন, তার ছবি অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট তাহলেও কি কেউ আইন হাতে নিতে পারে? অন্যকে হুমকি দিতে পারে? নিন্দুকরা এই শহরটার যত সমালোচনাই করুন তা কোন খাপ পঞ্চায়েত নয়। সেখানে কিছু অমানুষ এই হুমকি দেওয়ার সাহস পান কী করে? এটা মোটেই কোন ছোট ঘটনা নয়। প্রশ্রয় পেলে এবং প্রতিবাদ না হলে এটা এমন একটা মানসিকতার জন্ম দেবে যেখানে প্রকাশ্য রাজপথে নারী নিগ্রহের কোন প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা সেটাকে রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করছে মানুষ কিংবা মুখ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছে। এমন একটা শহরে আপনি আমি সবাই বিপদে পড়ে যাবো। কলকাতাও হারাবে তার প্রতিবাদী ঐতিহ্য। অন্যায় সহ্য করা মানে কিন্তু অন্যায়কে মেনে নেওয়া। আসুন, আমরা সবাই প্রীতমের পাশে দাঁড়াই।