সিঙ্গল স্ক্রিনে ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকে।সেখানে যে ফিল্ম দেখলে স্ক্রিন ঝাপসা হয়ে আসে ও ফুঁপিয়ে কান্না ঝরে, সেই ছবি অসাধারণ। এটাই ছিল আমাদের বেঞ্চ মার্ক।
অন্ধকার হলে, প্রজেক্টারের দিকে একটানা তাকিয়ে থাকলে নাকি ম্যাজিক এর মতো টাইম মেশিনে চড়ে বসে যে কোন সময় নিয়ে আসা যায় সেলুলয়েডে।
আমার বাবা আমাকে প্রথম সিনেমা হলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় বান্টিতে। বান্টি একটি হলের নাম ছিল। ক্রমে গোটা এলাকার নাম হয়ে যায় বান্টি। নাকতলার পরের স্টপ। যেখানে হালে মেট্রো স্টেশন হয়েছে।
বান্টি তে জীবনের প্রথম চলচ্চিত্র দেখি ‘খুদা গাওয়া’! স্কুল জীবনের অশ্লীল সমাস ও জানতে পারি ‘খুদা গাওয়া’-র সৌজন্যে। “খুদা এসে #% নিয়ে হাওয়া”। অমিতাভ বচ্চন ছিলেন ছবিটায়। আফগানী পটভূমিতে মশলাদার মনোরঞ্জন।
টিকিটের দাম মনে নেই তবে বাবা-মার দাম্পত্য কলহ, পারিবারিক অশান্তির নিক্তি তে মাপলে খুব বেশি কিছু ছিল না। তিন ঘন্টা অপলক দৃষ্টিতে মানুষগুলো তাকিয়ে থাকতো স্ক্রিনের দিকে। আমার ও নেশা ধরিয়েছিল। ওখানেই শুরু।
তখন আইনক্স ছিল না। থাকার মধ্যে আমার দুনিয়া জুড়ে ছিল বান্টি, মহুয়া, পদ্মশ্রী,মধুবন, মালঞ্চ।মালঞ্চ মানে যেটা আর কয়েকদিন পরে বন্ধ হয়ে যাবে।
দক্ষিণ কলকাতার ছেলে আমি। আগাগোড়া গড়িয়া নাকতলা। তাই এ সমস্ত হলের বাইরে একটা পৃথিবী আছে থোড়াই বুঝতাম। অনেক পরে রক্সি মানে ব্লু ফিল্ম আর ভবানী মানে চর্বিওয়ালা ভোজপুরি নায়িকা। ওখানে প্রথম ছোলা দিয়ে বাংলা। না বাংলা সিনেমা না। রাজ্যও না।
কাঠের চেয়ার, ঘুটঘুটে অন্ধকার হল, টর্চ লাইট জ্বালিয়ে সিট দেখিয়ে দেওয়া, সস্তার টিকিট এ মার্কার দিয়ে লেখা সিট নম্বর, ইন্টারভ্যালে প্যাটিস। পয়সা না থাকলে স্রেফ চিপস।
আমার এক নিমেষে হিপনোটাইজ এর যন্ত্র ছিল সেলুলয়েড। আর যাঁরা তার সাথে যুক্ত ছিলেন তাঁরা স্টার। নবীনা তে যে বয়স্ক মানুষটি প্রজেক্টার রুমে বসে ফাইল দেখতেন উনি বেঁচে আছেন? ‘কাহো না প্যার হে’র পর হৃতিক ওর সাথে ছবি তুলেছিল। আমি জানতাম। চাড্ডিখানি কথা বাওয়া!
মেনকা ছিল শাহরুখ খানের। নবীনা সলমন আর মালঞ্চ হিট হলিউড ছবির হিন্দি ডাব্ড ভার্সনের। ওখানে আমি অ্যানাকোন্ডা, টাইটানিক দেখেছিলাম। ওখানে সুভাষ ঘাই এর ‘তাল’ ও দেখেছিলাম।
আমার দারুণ লাগতো সিনেমা হলের ওই বোঁটকা গন্ধ। হলে ওই যেখানে EXIT লেখা থাকতো লাল আলোতে আর তার চারপাশের অন্ধকার। ওখানে নাকি সপ্তাহে সপ্তাহে স্বপ্ন দেখা যায়। স্বপ্নে নায়ক অমর হয়ে যায় আর হল মালিক নিঃস্ব। আত্মহত্যা করেছিলেন কতজন সিনেমাওয়ালা? কোন অডিটে এঁদের সংখ্যা থাকতো না।
আইনক্সস, পিভিআর এর মতো বাঙালি হল মালিক পাঁচ টাকার পপকর্ন একশো টাকায় বেচতে কুন্ঠিত বোধ করতেন। যেরকম অনলাইনে টিকিট বেচলে জাত যায় পূরবী কর্তার। ও মালঞ্চ বন্ধ হবার খবর পায়নি?
হলে অমর থাকে হকারের আনা সামগ্রী, পাইল করে আনা মদ। আপিস কেটে ছবির নেশাও। আমার ইলেভেন-টুয়েলভে যেরকম ছিল ভবানী। স্কুল এর থেকে বেশি শিক্ষা পেতাম কাঠের চেয়ার ও ফ্যান এর শীতলতায়। বাকিটুকু উত্তেজনা ছিল।
ভবানীতে পাইল করে মদ আর ফ্যাপড়ার বড়া নিয়ে ঢুকতাম। গাদাখানেক সেদ্ধ ছোলাও গছিয়ে দিতো রাখালদা। ভিতরে তিন ঘন্টার ব্রা খোলা, আচঁল ফস্কানো,? লিপস্টিকের ঘষাঘষি। নরম যৌনতা ছবি জুড়ে। সোনামুখ করে দেখতাম।
শোনা যায় এই সব হল মালিকদের নাকি এখন নির্বাসন দেওয়া হয়েছে। এরা নাকি আইনক্সের কোলার ক্যানে আত্মহত্যা করেছে, ইন্টারভ্যালে যা খাই আমরা তাতে নাকি এদের রক্ত থাকে। মানে যে ঠান্ডা পানীয় বড় গ্লাসে খাই তাতে কয়েক ফোঁটা হল মালিকদের রক্ত থাকে। যে মোমোটা খাচ্ছি তাতে বন্ধ হয়ে যাওয়া হল মালিকের চামড়া পোড়া গন্ধ থাকে।
একদিন সমস্ত সিঙ্গল স্ক্রিনের সমস্ত কর্মী আত্মহত্যা করবে। ওটাই ভবিতব্য। বাতানুকূল আইনক্স এর প্রতিটা কোনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে সেলুলয়েড মাখানো লাশ। আপনি ভাববেন 25D এফেক্ট।
আমার নস্টালজিয়ার হলগুলো আজ ভেঙে বহুতল। এদের পেটেও হোম থিয়েটার লাগানো। কিন্তু এদের কারোর মধ্যে আজ সেলুলয়েড এর পাগলামি নেই। বেশিরভাগটাই ডিজিটাল আর সস্তায় ৭৭এমএম স্বপ্ন দেখার সুযোগ।
আজ মালঞ্চ, কাল প্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া স্রেফ নস্টালজিয়ার পচা ঢেঁকুর ছাড়া কি কোন কিচ্ছুটি হতে পারে? আপনিই তো উষা ফ্যাক্টরির শ্রমিকের দগদগে ক্ষততে পপকর্ন লাগিয়ে রাখেন। বিশাল সাউথ সিটি উঠেছে ওখানে। বাঙালির আড্ডাপীঠ। ওখানে বসে একবার ও দীর্ঘশ্বাস পরে মালঞ্চ বা মধুবনের জন্য?
আসলে আমরা নস্টালজিয়া নিয়ে শুনতে, পড়তে ভালোবাসি কিন্তু আদপে থাকি এর শতকোটি মাইল দূরে৷ মানে লোডশেডিং আর তালপাতার পাখার কথা লিখতে হবে এসিতে বসে, সিঙ্গল স্ক্রিনের জন্য রোদন করতে হবে মাল্টিপ্লেক্সের উষ্ণতায় থেকে। জনগনতান্ত্রিক বিপ্লব করতে হবে ফেসবুকে দেওয়াল লিখে।
সুতরাং পৃথিবীর গাড়িটা থামাও আমি যাবো বললেই পৃথিবীর গাড়ি থামে না। কালকের মালঞ্চ আজ মরুদ্যান হলেও না। আপনার হাতে বড় জোর কোন অটো ব্রেক থাকে। এসবের শোকসভা শেষ হলে নেটফ্লিক্সে কিছু বৈপ্লবিক সিরিজ দেখার। ওটাকেই ইদানীং সংশ্লিষ্ট মহল জন্মান্তর বলছে।