‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ’; অনুরাগ কাশ্যপের ‘আগলি’ দেখতে বসে প্রথমেই মনে পড়ে যায়, জীবনানন্দ দাশের কবিতার এই পংক্তিটি। ছবিতে, অন্ধকারাচ্ছন্ন পর্দা জুড়ে তখন হেঁটে চলে বেড়ায় গুটিকয়েক চরিত্র এবং একইসাথে তাদের ভিতরে চলতে থাকে, নানা আলো-আঁধারির খেলা। কখনও কখনও প্রতিটি চরিত্রকেই মনে হয় ধূসর, কখনও বা এক একটি ছায়ামানুষ। কোনও সময়ে পা ঢুকে যায় যায় পচা গলা আবর্জনায়; আবার ঠিক তার পরমুহুর্তেই রক্তে পিছলে যায় জুতোর সোল। ছবি নয়, এ যেন কোনও অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে গুহার দেওয়ালে, চারকোল দিয়ে আঁকা গুহাচিত্র!
ছবির প্রায় শুরুতেই আমরা দেখি, বছর দশেকের একটি বাচ্চা মেয়ে, দিনের আলোয় ভরা বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়। অতঃপর শুরু হয় তার খোঁজ এবং ক্রমশই তা নাটকীয় আকার ধারণ করে। ছবির পরতে পরতে জন্ম নেয় টানটান উত্তেজনা; যা একসময় বেশ অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে চিত্রনাট্যের জোরে।
এই ছবিতে কাজ করেছেন রণিত রায়, নবাগত রাহুল ভাট, বিনীত সিং, তেজস্বিনী কোলাপুরী, সুরভিন চাওলা, গিরীশ কুলকার্নির মতো কিছু দুর্দান্ত অভিনেতা, যারা তথাকথিত ‘তারকা’ নয়। প্রত্যেকেই নিজের নিজের অভিনীত চরিত্রটিকে নিজেদের অভিনয় গুণে, দক্ষতার সাথে ভয়ঙ্কর ভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। ফলে প্রতিটি চরিত্রকে এক একজন রক্তমাংসের মানুষ মনে করতে শুরু করে দর্শক। এক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে বলতে হয় রণিত রায়-এর নাম। এক সৎ এবং কঠোর পুলিশ কর্তার চরিত্রে, তাঁর লার্জার দ্যান লাইফ অভিনয় যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে। এই সকল চরিত্রের লোভ, হিংসা, ঘৃণা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং দম্ভের মতো ‘আগলি’ মানসিকতা এবং অনুভূতিগুলো দর্শকের সামনে আসতে থাকে ধাপে ধাপে। প্রতিটি দৃশ্যেই প্রধান প্লট থেকে খুলে যায় নতুন নতুন সাবপ্লটের দরজা; দানা বাঁধতে থাকে রহস্য।
সিনেম্যাটোগ্রাফি, এই ছবির সম্পদ। পর্দায় সর্বক্ষণ যে অন্ধকার, থমথমে পরিবেশ দেখা যায়, তা রূপায়নের দায়িত্বে ছিলেন গ্রীক সিনেম্যাটোগ্রাফার নিকস্ আন্দ্রিতসাকিস্। দিবাকর ব্যানার্জীর প্রায় অধিকাংশ ছবির ক্যামেরামান নিকস। অনুরাগ এই প্রথম জোট বেঁধেছেন তাঁর সঙ্গে। নিকসের ক্যামেরা, চলমান অশরীরীর মতো ধীর পায়ে পেরাতে থাকে একের পর এক শুনশান ফাঁকা বাই লেন; কখনও ছুটতে থাকে ঘিঞ্জি বাজারের ভিড় পেরিয়ে এঁকে বেঁকে। আলো-ছায়ার ব্যবহার ও কম্পোজিশনের গুণে, প্রতিটা ফ্রেমই আরও বেশি বাস্তবসম্মত হয়ে ওঠে।
আরতি বাজাজ-এর সম্পাদনা প্রতিটি দৃশ্যকে সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে এবং কোথাও ছিটেফোঁটাও মেদ জমতে দেয়নি। ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর এবং মিউজিকের দায়িত্বে থাকা জি.ভি. প্রকাশ কুমার-ও যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়েছেন তাঁর কাজে।
অনুরাগের বাকি ছবিগুলির মতোই ‘আগলি’-ও মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, তাদের মধ্যেকার অপরাধপ্রবণতা এবং অন্ধকার দিকগুলির হদিশ দেয় এবং কোথাও কোথাও এই ছবির ভয়াবহতা ও কালিমা, তাঁরই মুক্তি না পাওয়া ছবি ‘পাঁচ’-কেও ছাপিয়ে যায়। অনুরাগের গল্প বলার ধরণ, শেষমুহুর্ত অব্দি দর্শককে তার আসনে বসিয়ে রাখে এবং রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে বাধ্য করায়।
ছবির একদম গোড়ায় মনে হয়, এটি একটি ক্রাইম থ্রিলার; তারই খানিক পরে গল্প মোড় নেয় সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারের দিকে এবং অন্তিমে এসে মনে হয়, ‘আগলি’ একটি আদর্শ নোয়া ঘরানার ছবি, যার রেশ প্রেক্ষাগৃহ থেকে বাইরে বেরিয়েও, আরও কিছুক্ষণ রয়ে যায়।।