ক্রিকেট মাঠে পেল্লাই ছক্কা হাঁকিয়েছেন। বল হাতে তিনি ছিলেন বিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের কাছে ত্রাস। দেশের একমাত্র সীমিত ওভারের বিশ্বকাপটি এসেছে তাঁর অধিনায়কত্বেই। এবার নতুন ইনিংস শুরু করলেন ‘কাপ্তান’ ইমরান খান। শনিবার পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন তিনি। প্রেসিডেন্ট হাউস আওয়ান-ই-সদরে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ প্রধান ইমরান খানকে শপথবাক্য পাঠ করান প্রেসিডেন্ট মামনুন হুসেন। শনিবার সকাল সাড়ে ন’টায় তাঁর শপথ অনুষ্ঠান শুরুর কথা ছিল। তবে অনুষ্ঠান ৪০ মিনিট দেরিতে শুরু হয়।
প্রথামাফিক পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত দিয়ে শুরু হয় শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। এরপরেই পবিত্র কোরান পাঠ করা হয়। ছাইরঙের শেরওয়ানি পরে শপথ নিতে গিয়ে কিছুটা আবেগতাড়িত হয়ে ইমরান কেঁদেও ফেলেন। ঘাবড়ে গিয়ে শপথ বাক্যের উর্দু শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়ে হোঁচটও খান একদা ক্রিকেট মাঠের ‘বাঘ’ অলরাউন্ডার ইমরান খান। তবে ইরমানের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান ঘিরে উৎসাহের কমতি ছিল না। অনুষ্ঠান দেখতে উপস্থিত হয়েছিলেন ওয়াসিম আক্রম সহ ১৯৯২ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপজয়ী দলের অধিকাংশ সদস্য। দেশ বিদেশের বহু কূটনীতিকও উপস্থিত ছিলেন। শপথ অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামের জাভেদ বাজওয়া। ইমরানের বিশেষ আমন্ত্রণে শপথ অনুষ্ঠানে গিয়েছেন প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার নভজ্যোত সিং সিধু। বন্ধু ইমরানের শপথ নেওয়া দেখে আপ্লুত সিধু বলেছেন, ‘নতুন সরকারের সঙ্গে পাকিস্তানের এক নতুন সকাল শুরু হল। দেশকে নতুন দিশায় নিয়ে যেতে পারবে এই সরকার।’ এদিকে, পাকিস্তান সংসদে বিরোধী দলনেতা নির্বাচিত হতে চলেছেন পিএমএল-এন প্রধান প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ভাই শাহবাজ শরিফ। জাতীয় সংসদের ১১১ জন সদস্য শাহবাজকে ওই পদে চেয়ে আবেদন করেছেন। ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির স্পিকার আসাদ কাইজার বলেছেন, শাহবাজকে ১১১ জন সদস্য বিরোধী দলনেতা হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন। সোমবার এই সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় কঠিন সময়ে দেশের দায়িত্ব পাচ্ছেন ইমরান খান। প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসে পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্কের হাত বাড়িয়ে দেন। ২০১৬ সালে পাক জঙ্গিদের আক্রমণের পর থেকেই ইসলামাবাদ নিয়ে আগ্রহ হারিয়েছে নয়াদিল্লি। প্রাক্তন নৌসেনা আধিকারিক কূলভূষণ যাদবকে চরবৃত্তির অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে সে দেশের সেনা আদালত। যাদবের মৃত্যুদণ্ড রদের দাবিতে আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়েছে ভারত। এই নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের আরও অবনতি হয়েছে। সীমান্ত পার সন্ত্রাস নিয়ে আফগানিস্তানের সঙ্গেও পাকিস্তানের টানাপোড়েন চলছে। সবচেয়ে বড় কথা, পাকিস্তানের পাশ থেকে ক্রমশ সড়ে যাচ্ছে এক সময়ের ‘বন্ধু দেশ’ আমেরিকা। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার মসনদে বসার পর থেকেই সন্ত্রাস প্রশ্নে পাকিস্তানের উপর চাপ বাড়িয়েছে। সন্ত্রাস নিয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেওয়ায় পাকিস্তানকে প্রতিশ্রুত প্রতিরক্ষা সহায়তা না দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। তাছাড়া, আন্তর্জাতিক অর্থ সংক্রান্ত সংস্থা এফএটিএফের কড়া নজরদারির মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান। গত জুনে পাকিস্তানকে ‘ধূসর তালিকা’য় স্থান দেয় এফএটিএফ। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পাকিস্তানকে ‘টেন পয়েন্ট অ্যাকশন প্ল্যান’ বেঁধে দিয়েছে প্যারিস ভিত্তিক এই সংস্থা। সেপ্টেম্বরের মধ্যেই পাকিস্তানকে প্রমাণ করতে হবে, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে তারা সংস্থা নির্ধারিত শর্ত পালন করছে। নাহলে, আরও বড় আর্থিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে পারে পাকিস্তান। গত সপ্তাহেই পাকিস্তান ঘুরে গিয়েছেন এফএটিএফের প্রতিনিধিরা। তাছাড়া, ডলারের তুলনায় পাকিস্তানের মুদ্রার দাম ক্রমশ পড়ছে। মুদ্রাস্ফীতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাণিজ্য ঘাটতিও বেড়েই চলেছে। আর্থিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে ২০১৩ সালের পরে আবার ইমরান প্রশাসনকে আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের কাছে বেল আউটের আবেদন করতে হতে পারে। নতুন সরকারের পক্ষে এই সিদ্ধান্ত মোটেই ভালো বিজ্ঞাপন হবে না।
ইমরান অবশ্য এসব নিয়ে এখন ভাবছেন না। নির্বাচনী প্রচারে দেওয়া দুর্নীতিমুক্ত পাকিস্তান গড়ার উপরই তিনি জোর দিয়েছেন। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ আলি জিন্নাকে তাঁর হিরো জানিয়ে ইমরান বলেছেন, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র’কে কল্যাণমূলক ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান তিনি। তার কাজও শুরু করে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পরে তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ফোন করেছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে। পাক সংবাদ মাধ্যমের খবর, অর্থ তছরুপ নিয়ে মে-র সহযোগিতা চেয়েছেন ইমরান।