ফলের রাজা আম। আর আমের রাজা কোহিতুর। স্বাদে-গন্ধে সকল আমের সেরা মুর্শিদাবাদের এই কোহিতুর আম। এবার এই কোহিতুরকেই একান্ত নিজের করে পেতে উদ্যোগী হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ।
নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার রাজত্বকালে প্রথম এই আমের ফলন শুরু হয়। নবাবের তদারকিতে সেইসময় গুটিকয়েক জায়গায় এই আমের চাষ হতো। কারণ, এই আম সেই সময় সাধারণের জন্য ছিল না। কড়া নিয়ম ছিল, শুধু নবাবের বাগানেই এর চাষ করা যাবে। খেতেও পারবেন একমাত্র নবাব ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। ১৮ শতকের শেষ দিকে বাংলার শেষ নবাবের হাতে মুর্শিদাবাদে ব্যাপক হারে শুরু হয় এই আমের চাষ।
এখন অবশ্য সেই নবাব নেই। নেই তাঁর নবাবিয়ানাও। তবুও, এই আম কিন্তু আজও সাধারণের নাগালের বাইরেই থেকে গিয়েছে। এক-একটি কোহিতুর আমের বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১৫০০ টাকা। ফলে এত গাঁটের কড়ি খরচ করে কোহিতুরের স্বাদ পাওয়া মধ্যবিত্তের পক্ষে সম্ভব নয়। বরং আধুনিক ‘নবাব’ অর্থাৎ উচ্চবিত্ত সমাজই এই আম খাওয়ার বিলাসিতা দেখাতে পারে। এই ছবিটা বদলাতেই এবার উদ্যোগ নিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কোহিতুর আমের জিআই ট্যাগ পেতে ইতিমধ্যেই আবেদন করেছে রাজ্য সরকার। উদ্দেশ্য দু’টি। এক, নবাবের প্রিয় এই বিশেষ প্রজাতির আমকে রক্ষা করা। দুই, সারা বিশ্বের সঙ্গে এই আমের পরিচয় ঘটিয়ে তাকে সাধারণের নাগালের মধ্যে এনে দেওয়া। এ প্রসঙ্গে মুর্শিদাবাদ উদ্যানপালন বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর গৌতম রায় বলেন, ‘কোহিতুর প্রজাতির আম পশ্চিমবঙ্গেই পাওয়া যায়। মুর্শিদাবাদেই একমাত্র এই আমের ফলন হয়। একসময় এই আমের ১৪৮টি প্রজাতি ছিল। এখন কমে সেটা ৪২টিতে ঠেকেছে। আমরা এই বেঁচে থাকা প্রজাতিগুলিকে রক্ষা করতে চাইছি। আমরা কোহিতুরের জিআই ট্যাগ পেতে আবেদন করেছি। আশা করছি, সেটা আমরা পেয়ে যাব।’
উল্লেখ্য, কোনও নির্দিষ্ট প্রোডাক্টের নাম ব্যবহার যাতে শুধুমাত্র নথিভুক্ত সংস্থাই করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করে জিআই তকমা। বর্তমানে নয়াদিল্লির জনপথ এলাকায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার আয়োজিত আম মেলায় এই কোহিতুর আমের প্রদর্শনী করা হয়েছে। গৌতমবাবুর কথায়, ‘আম-প্রেমী নবাব সিরাজ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সেরা আমের চারাগাছ এনে নিজের বাগানে পুঁতে ছিলেন। তাঁর কয়েকজন প্রিয় আমচাষিও ছিলেন যাঁরা আকবরের নবরত্নের মতো নবাবের সমাদর পেতেন। তাঁদের উপর দায়িত্ব ছিল, এই সমস্ত চারার সংকর ঘটিয়ে উৎকৃষ্ট প্রজাতির আমের ফলন ঘটানো। এভাবেই নবাবের বাগানে একদিন কোহিতুরের জন্ম হয়।’ গৌতমবাবু জানালেন, জনশ্রুতি রয়েছে যে হাকিম আদা মহম্মদিয়া নামে এক আম চাষির হাতেই প্রথম কোহিতুরের জন্ম হয়। কালোপাহার নামে আমের এক প্রজাতির সঙ্গে আরেকটি প্রজাতির সংকর ঘটিয়ে কোহিতুর তৈরি করেছিলেন ওই চাষি। গায়ের রংয়ে কালো ছোপের কারণে নাম হওয়া কালোপাহার আম আজ বিলুপ্ত। কিন্তু, তার থেকেই উৎপত্তি হওয়া কোহিতুর আজও বহাল তবিয়তে রাজ করে চলেছে। তবে, তার সংখ্যা দিনদিন কমছে। কোহিতুর আমের উৎপাদনকারীদের দাবি, এখন গোটা মুর্শিদাবাদে মাত্র ১০-১৫ জন কোহিতুর আমের চাষি রয়েছেন। গাছ রয়েছে মেরে-কেটে ২০ থেকে ২৫টা।
কোহিতুর আম-চাষি আশাবুল মণ্ডল বলেন, ‘জেলায় ২০০টির মতো আমবাগান রয়েছে। কিন্তু, সেখানে কোহিতুর গাছের সংখ্যা নগণ্য। কয়েকটি গাছ তো ১৫০ বছরেরও বেশি পুরনো। একটি মরশুমে একটি গাছে ৪০টির বেশি ফল ধরে না। প্রতিবছর গাছে ফল হবে, তেমনটাও নয়। এর ফলেই কোহিতুরের এত চাহিদা।’ তিনি আরও জানান, এই আম অন্যান্য আমের থেকে অনেক আলাদা। এর চাষ খুব যত্ন নিয়ে করতে হয়। প্রতিটি আমকে হাত দিয়ে আলতো করে গাছ থেকে নামাতে হয়। নীচে পড়ে গেলেই তাতে পচন ধরতে শুরু করে। তাই প্রতিটি আমকে তুলোয় মুড়ে রাখতে হয়।