চে গুয়েভারার জন্মদিনে সোশ্যাল মিডিয়া সরগরম। সংগ্রাম, বিপ্লব, আত্মত্যাগের সুবাদে চে বরাবরই পৃথিবীর সবদেশের ছাত্রযুবদের চোখের মণি। তার সম্পর্কে কিছু না জানা ছেলেমেয়েরাও টুপি, টিশার্টে, লকেটে, পকেটে তার ছবি নিয়ে দাপিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চে যেন শুধুই চেয়ে চেয়ে দেখার মত একটা ব্যাপার। লেনিন, মাও, চে-র মত মানুষরাই একসময়ে বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছিল আমার মত আরও অনেককে। বাংলার সেই সত্তর দশক এখন ইতিহাসের পাতায় ঢুকে পড়েছে। একটা অভিযোগ সবসময় ওঠে যে, সবাই তাদের নিজেদের সময়কে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। বিশ্বাস করুন, আমি তেমন কোন রাস্তায় হাঁটছি না। আমাদেরও অনেক ভুলভ্রান্তি ছিল, বোঝার অস্পষ্টতা ছিল। কিন্তু আজকের মত চে র টিশার্ট পরে নেশা বা মেয়েদের অসন্মান করা, শুধুই নিজের স্বার্থ নিয়ে বাঁচার মত কোন দ্বিচারিতা আমাদের ছিল না।
একটা সময়ে বাঙালি কাছের এবং দুরের সব ভাল দৃষ্টান্তগুলোকেই আত্মস্থ করেছিল। এখন হয়েছে ঠিক উল্টো। স্বদেশের ঠাকুরকে ফেলে বিদেশের কুকুর ধরার মত আমরা সবসময়ই দূরের উদাহরণ দিই। কথায় কথায় বলি, আমেরিকা কত ভাল, চিন কত এগিয়ে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের ঘরের কাছের সাফল্য, অগ্রগতি, বীরত্ব কোন কিছুই আমাদের চোখে পড়েনা! ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার অসংখ্য শহীদ প্রাণ দিয়েছেন। কিন্তু আমরা ক জন সূর্য সেন কিংবা প্রীতিলতার জন্মদিনে তাঁদের শ্রদ্ধা জানিয়ে পোস্ট দিই। রাধানাথ শিকদারের মত মানুষদের কৃতিত্ব ও মেধার ফসলকে বেমালুম আত্মসাৎ করেছেন সাহেবরা, জগদীশ বসু তার প্রাপ্য সন্মান পান নি। জন্মদিনে তাঁদের স্মরণ করে তেমন তো কোন পোস্ট দেখি না। কেন আমরা নীরব থাকি সত্যেন বোসের মত বিজ্ঞানীর জন্মদিনে! তার একটাই কারণ এতে চটকদারি কম, এদের সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে বা লিখতে গেলে একটু জানতে হবে। শুধু ফেসবুক পড়লে চলবে না। তারচেয়েও বড় কথা ভবের বাজারে চে-র বিক্রি সূর্য সেন, বিনয়-বাদল-দীনেশ কিংবা প্রীতিলতার থেকে বেশি। বিদেশী গন্ধ আছে, ভালো ছবিও আছে তাই এদের প্রতি ঝুঁকি আমরা।
আমাদের রাজনৈতিক চেতনাতে এই বিদেশীদের নিয়ে মাতামাতি করার একটা হাস্যকর প্রশ্রয় আছে। এমনকি যাদের নিয়ে মাতামাতি তারাও এতে বিব্রত হন। চিনে যাওয়া নকশালপন্থী নেতাদের চিনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারাই বলেছিলেন, আপনাদের চিনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান স্লোগানটা ভুল। আমার নিজের অভিজ্ঞতাই বলি। গরীব নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে আমি। বাবা, মা কষ্ট করে ছেলেকে মানুষ করার জন্য বীরভূম এর রামকৃষ্ণ শিক্ষাপীঠে পড়তে পাঠিয়ে ছিল। রামপুরহাট থেকে দুমকা যাওয়ার পথে তুমবনি ফরেস্ট এলাকার লাল পাহাড়ি গ্রাম। চারিদিক টিলা ও জঙ্গল। এখানেই আমাদের স্কুল। পাশেই সাঁওতাল আদিবাসীদের বাস। ওদের দেখে বারবার আমার বাড়ির কথা মনে পড়ত।
অভাবের সংসার, বাবা রেলের খালাসি, মা দিনরাত একাকার করে ধান সিদ্ধ করত। কারণ, ধানকে চাল করলে খরচা কম লাগে। ৬৮-৬৯ সালে বর্ধমানে চালের দাম ছিল ৮০ পয়সা। ভাল হলে ১.১০ পয়সা। ভাতের সঙ্গে ডোবার ধারের শাকপাতা আর ডাল, আলু এই ছিল আমাদের খাবার। একটা ডিম সুতো দিয়ে কেটে চার টুকরো করে খাওয়া হত। বাড়িতে ফলানো লাউ, কুমড়ো, নটে শাক বিক্রি করে বছরে তিনবার মাংস আসত। এই অবস্থা তো কারুরই ভালো লাগে না। আমারও লাগতো না।
অবস্থা বদলে দেওয়ার রাস্তা দেখালো আমাদের ক্লাসের প্রভাত, সুবীররা। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। স্কুলের হস্টেলে থাকতাম। সুবীররা বললো, লেনিন, মার্ক্স, মাও সে তুং এরাই মানুষকে এই অবস্থা থেকে মুক্ত করবে। এরাই পথ দেখাবে আমাদের। দেশে আর কোন গরীব থাকবে না। বড়লোকের চামড়া দিয়ে তৈরি হবে গরীবের জুতো। আমি একই সঙ্গে উত্তেজিত ও আনন্দিত হলাম। প্রভাস, সুবীরদের বললাম, আমায় নাও না তোমাদের দলে। আমিও নকশাল করবো।
ঢুকে পড়লাম রাজনীতিতে। আমার কাজ ছিল পাথরখাদান থেকে পাথর ভাঙার গানপাউডার নিয়ে স্কুলের ব্যাগে করে দাদাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। রামকৃষ্ণ আশ্রমের ছাত্র হয়েও শিখলাম রামকৃষ্ণ, সারদা মা, বিবেকানন্দ-এরা গরীবদের জন্য কিছু করবেন না, এসব হচ্ছে ভাববাদ। রাতের অন্ধকারে আশ্রমের বেদী থেকে রামকৃষ্ণ, সারদা মা, বিবেকানন্দের ছবি ও শাঁখ, প্রদীপ ও পুজোর নানা সরঞ্জাম বিছানার চাদরে মুড়ে দূরে একটা পরিত্যক্ত ইদারায় ফেলে দিয়ে আসা ছিল আমার প্রথম অ্যাকশন।
এই রাজনীতি করতে করতেই একসময় ধরা পড়লাম। ধরা পড়ার পরেও নিস্তার নেই। সেখানেও বিদেশী নেতাদের কথা। স্থানীয় থানার বড়বাবু মারার সময় বলতেন, মাও সে তুং তোর লাল বাবা না কালো বাবা, বল শুয়োরের বাচ্চা, শালা খানকির ছেলে। তিনমাস রামপুরহাট জেলে থাকার পর ছাড়া পাই।
এতগুলো বছর পেরিয়ে এসে আজ মনে হয় বিদেশী নেতাদের পুজো করার ভাবনা আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ভাবতাম ওরাই বিপ্লব আনবে। বাবা, মা, ভাই, পিসিদের মত ওরাও আমাদের পরিবার। এখন এর কারণটা বুঝতে পারি। চারিদিক থেকে মার খাওয়া নিরুপায় মানুষ কাছের সবকিছুর ওপরেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। সে তখন ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া বা বাইরের থেকে আমদানি করা একটা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। সাধারণ খেটে খাওয়া গরীব মানুষদের কমিউনিস্টরা এই স্বপ্নটাই খাওয়াতো।
গরীব মানুষদের এই স্বপ্নটা একটা অজ্ঞতা। এতে কোন দোষ নেই। এর সঙ্গে কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার বিপ্লবীদের তফাৎ রয়েছে। এরা স্থানীয় বিষয়, উদাহরণ, দৃষ্টান্ত এড়িয়ে কোন বিদেশী বড় নামের বন্দনার মধ্যে দিয়ে নিজেদের অকর্মণ্যতার আশ্রয় খোঁজে। চারপাশের কোন সাফল্যের উদাহরণ না দেখা আসলে এদের কোন কাজ না করার একটা ছুতো। এই সোশ্যাল মিডিয়ার ‘বিপ্লবীদের’ হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার একটাই উপায় এদের অগ্রাহ্য করুন তাহলেই দেখবেন এদের বিপ্লব বন্ধ হয়ে যাবে। তাহলেই হয়তো এরা একটা কল্পিত স্বর্গ থেকে বাস্তবের মাটিতে নেমে আসবে। বিপ্লব স্পন্দিত বুকে নিজেকে লেনিন ভাবার চাইতে একজন স্বাভাবিক মানুষ হওয়া আজ আরও বেশি জরুরি।