হাঁটতে হাঁটতে কখন যে কালিম্পং এর হিলটপ গৌরীপুর হাউসের সামনে চলে এসেছি নিজেই জানিনা। আমার সঙ্গী উত্তরকন্যার ও এস ডি শুভাশিস ঘোষ। অনেকদিন পর এখানে এলাম। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি এই বাড়িটায় ছড়িয়ে আছে। পাহাড়ের পুরনো ঘরবাড়ির চেহারা কেমন ছিল তা এ বাড়িটাকে দেখলে বোঝা যায়। একেবারে পাহাড়চূড়ায় থাকা ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতির আদলে গড়ে ওঠা এই বাড়ির দোতলায় ব্যালকনিতে এসে বসতেন কবি। বারান্দা থেকে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা। ১৩৪৫ এ ২৫শে বৈশাখ এই বাড়ি থেকেই ‘জন্মদিন’ কবিতাটি আকাশবাণীর মাধ্যমে আবৃত্তি করেছিলেন বলে বাড়ির ফলকে লেখা আছে। কিন্তু এখন কী অবস্থা হয়েছে বাড়িটার! চমৎকার দেখতে বাড়িটার সর্বাঙ্গে এখন অযত্নের ছাপ, চারপাশে ধুলোময়লা আগাছায় ভরপুর, কোন জায়গায় খুলে নেওয়া হয়েছে টিন, ওপর থেকে জল পড়ছে, ভেঙে গেছে জানলার কাঁচ, দরজা ভাঙা, জল আলোর কোন ব্যবস্থা নেই – সবমিলিয়ে এক হতশ্রী চেহারা। বাড়িটার ইতিহাস জানা না থাকলে যে কেউ এটাকে একটা ভূত বাংলো ভাববে, মনটা খারাপ হয়ে গেল।
রবীন্দ্রনাথের পাহাড়ে আসা মানেই মংপু আর কালিম্পং। কখনও তিনি গেছেন মংপু থেকে কালিম্পং, কখনও কালিম্পং থেকে মংপু। পাহাড়ে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন চার পাঁচবার। প্রথমবার এসেছিলেন ১৯৩৮এর ২৬ এপ্রিল। সঙ্গী ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। এরপর ১৯৪০ সালেও রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন এখানে। যতদূর জানি আরও এক দুবার তিনি এবাড়িতে আসেন। কবি আসা মানেই তার সঙ্গে কিছু পরিচিত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদেরও আসা। কবির সঙ্গে এখানে এসেছিলেন সুধাকান্ত রায়চৌধুরী, অনিল চন্দের মত মানুষেরা। শরীর সারাতে আসা কবির চিকিৎসা করতেন স্থানীয় ডাক্তার গোপাল চন্দ্র দাশগুপ্ত। পাহাড়েও রবীন্দ্রনাথকে দেখতে ভিড় হত সেসময়। স্থানীয় মানুষজন তাঁকে দেখতে আসতেন, কবি তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতেন। এই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সেই পুরনো ছবিটা যেন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।
চমক ভাঙল সঞ্চিতা শর্মার কথায়- কাউকে খুঁজছেন দাদা? বাড়িটা নিয়ে তাকে দু চার কথা বলতেই সঞ্চিতা বললেন, এখন আর কেউ আসে না। আর যারা আসে তাদের বেশিরভাগই বাড়িটাকে হাতানো কিংবা এর মালপত্র বিক্রির ধান্ধায় আসে। এই পোড়ো বাড়ি আগলে আমিই পড়ে আছি কিন্তু আর কতদিন পারবো জানি না। সঞ্চিতা জানালেন, তিনি এই বাড়ির কেয়ারটেকার পদমলাল শর্মার মেয়ে। তার বাবাকে কেয়ারটেকার হিসেবে বহাল করেছিলেন বাড়ির মালিক ডি কে রায়চৌধুরী। সঞ্চিতার সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকেই দেখছিলাম বাড়ির চত্বরে তার ফুলের মত তিন ফুটফুটে মেয়ে ক্লাউডিনা, সোফিয়া আর সবচেয়ে ছোট তিরপুসার আনাগোনা। তিন মেয়েকে নিয়েই তিনি এই বাড়ি আগলে পড়ে আছেন।
মাঝে মধ্যে উদয় হন তার স্বামী মানিক খাদলে। তার আসার মতলব একটাই, বাড়ির কিছু মালপত্র খুলে বিক্রি করা কিংবা কোন খদ্দেরকে বিক্রির জন্য বাড়িটা দেখানো। সঞ্চিতা বললেন, এত বড় মানুষের স্মৃতি জড়ানো এমন একটা বাড়ি অযত্নে পড়ে আছে ভাবলেও খারাপ লাগে। জল, আলোহীন বাড়িতে তিনটি মেয়ে নিয়ে থাকার অসুবিধাও অনেক, কোনমতে পাশ থেকে একটা লাইন টেনে কাজ চলার মত আলোর ব্যবস্থা করেছেন। তার মতে এখনই বাড়িটার সংরক্ষণের প্রয়োজন। সরকারের কাছে চিঠি দিয়ে সে কথা জানিয়েছেনও তিনি। নিজেদের একটা থাকার ব্যবস্থা করে দিলে এখান থেকে চলে যেতেও তাদের আপত্তি নেই। তার একটাই কথা বাড়িটাকে এভাবে ফেলে রাখা ঠিক হচ্ছে না।
হিলটপ গৌরীপুর হাউস দেখে আমার মনে হয়েছে এই বাড়িটাকে একটা চমৎকার পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যায়। এতে কবির স্মৃতির সংরক্ষণ হওয়ার পাশাপাশি কালিম্পঙের পর্যটন আকর্ষণও বাড়বে। প্রশস্ত এই বাড়িটিতে পাহাড় ও রবীন্দ্রনাথ থিম নিয়ে একটি সংগ্রহশালাও গড়ে তোলা যেতে পারে। অবশ্য এসব আমার মত একজন সামান্য মানুষের ভাবনা। চলে আসার সময়ে ‘জন্মদিন’ কবিতাটা মনে পড়ল। কবি লিখেছিলেন, ‘আজ মম জন্মদিন। সদ্যই প্রাণের প্রান্তপথে/ ডুব দিয়ে উঠেছে সে বিলুপ্তির অন্ধকার হতে/ মরণের ছাড়পত্র নিয়ে। মনে হতেছে, কী জানি,/ পুরাতন বৎসরের গ্রন্থিবাঁধা জীর্ণ মালাখানি/ সেথা গেছে ছিন্ন হয়ে; নবসূত্রে পড়ে আজি গাঁথা/ নব জন্মদিন। জন্মোৎসবে এই-যে আসন পাতা/ হেথা আমি যাত্রী শুধু, অপেক্ষা করিব, লব টিকা/ মৃত্যুর দক্ষিণ হস্ত হতে- নূতন অরুণলিখা/ যবে দিবে যাত্রার ইঙ্গিত।।’
বিলুপ্তির অন্ধকার হতে বেঁচে উঠুক রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজরিত হিলটপ গৌরীপুর হাউস।