পুরুলিয়া। ছৌ নাচ, অযোধ্যা পাহাড়, শাল-পিয়ালের ভূমি, পলাশের দেশ। ছোটবেলা থেকেই যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু হয়ে ওঠেনি কারণ অনুকূল পরিস্থিতি ছিল না। অতিবাম রাজনীতিতে ফলে জঙ্গলমহল তখন হত্যালীলার মুক্তাঞ্চল। রাতের অন্ধকারে করা কেন এসে খুন করে দিয়ে যায় বিরোধী ভাবাদর্শে দীক্ষিত রাজনৈতিক কর্মীদের। মুখ্যমন্ত্রী কারখানা উদ্বোধন করতে গেলে সারা জঙ্গল কাঁপিয়ে ফেঁটে ওঠে ল্যান্ডমাইন। তাই প্রকৃতিকে অপেক্ষা করতে হয় পর্যটকদের। ব্রাত্যই থেকে যায় জয়চন্ডী কিংবা দোলাডাঙ্গা।
ছবিটা বদলাতে শুরু করে ২০১১ সালে। বিপুল জনসমর্থনে জিতে আশা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাখির চোখ ছিল লাল রক্তে রাঙা এই লালমাটির দেশে শান্তি ফেরানো। মমতা অনুধাবন করেছিলেন মাওবাদীদের জব্দ করতে শক্তিপ্রয়োগ করলে হিতে বিপরীত হবে। তাই তিনি মনোনিবেশ করলেন এলাকার উন্নয়নের দিকে। বিশ্বাস জিতলেন স্থানীয় মানুষের। জনতা দেখল দিদির দেখানো পথে দু’বেলা পেট ভরা ভাত, রোজগার, শান্তি আছে। কমতে শুরু করল মাওবাদীদের প্রকোপ।
তারপরের ঘটনাও সবার জানা। কুখ্যাত এক মাওবাদী নেতার মৃত্যু আর তার সূত্র ধরে বহু বিপথগামী যুবাদের মূলস্রোতে ফেরা শুরু হল। জঙ্গলমহল জুড়ে তখন উন্নয়নের বৃহৎ কর্মযজ্ঞ শুরু হল। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে পানীয় জল, সেতু নির্মাণ থেকে স্কুল-কলেজ – মমতা দেখিয়ে দিলেন ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। বছরে বারবার তিনি ছুটে গেছেন পুরুলিয়া-ঝাড়গ্রাম-বাঁকুড়ায়। মানুষের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়েছেন। মানুষ ২০১৬ তে ঢেলে আশীর্বাদ করেন তাকে। কার্যত একঘরে হয়ে গেলেন বিরোধীরা। জঙ্গলমহল জুড়ে শুধুই জোড়াফুলের দাপট।
তাই, কয়েক সপ্তাহ আগে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ভোটবাক্স গুলো খুলতেই ঝটকা লাগল। এত কাজ, এত উন্নয়নের পরও কি করে বিরোধী শক্তি এতটা প্রবল হল এই অঞ্চলে? সংবাদমাধ্যমে দেখলাম এক রিপোর্টার স্থানীয় মানুষদের সাথে কথা বলে এক প্রতিবেদন লিখেছেন। বেশিরভাগ মানুষের একটাই বক্তব্য – তারা মমতাকে ভালোবাসেন এবং শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু স্থানীয় কিছু নেতাদের বাড়বাড়ন্তের ফলে বীতশ্রদ্ধ দলের ওপর। তাই জোড়াফুলের জনসমর্থনে ভাটার টান। আর এই সুযোগটাই নিচ্ছে বিরোধীশক্তি।
গত সপ্তাহে পুরুলিয়ার বলরামপুরের সুপুরডি গ্রামে জনৈক বিজেপি কর্মী ত্রিলোচন মাহাতোর ঝুলন্ত মৃতদেহ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। তার তিনদিন পরেই ঝুলন্ত লাশ পাওয়া যায় দুলাল মাহাতো নামে এক ব্যক্তির। বিজেপির দাবি দুলালও তাদের কর্মী, এবং এই মৃত্যুগুলির পেছনে হাত রয়েছে তৃণমূলের (যদি ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বলছে দুলাল আত্মহত্যাই করেছিল)। এই দুটি মৃত্যুর মধ্যে মিল রয়েছে। দুই নিহতের জামায় লিখে দেওয়া হয় খুনের কারণ। লাশের পাশে পড়ে থাকা কাগজের টুকরোতেও একই কথা লিখে রেখে যায় আততায়ীরা।
ত্রিলোচন মাহাতোর মৃতদেহ উদ্ধারের পরদিনই আমি সোশ্যাল মিডিয়াতে লিখেছিলাম ঘটনাগুলি আমায় মনে করে দিচ্ছে ২০০৯-২০১০ সালে মাওবাদীদের হাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মীর খুনের ঘটনার কথা। মাওবাদীরা খুন করার পর ঘটনার দায় স্বীকার করে যেমন পোস্টার রেখে জেট কিংবা লাশ ঝুলিয়ে রেখে দিত, ঠিক তেমনই। তাই বেড়ে উঠছে উৎকণ্ঠা। সাত বছরের শান্তির হাসি কি তবে ম্লান? জঙ্গলমহলকে অশান্ত করার কি পরিকল্পনা চলছে?
গত কয়েক বছরে, দেশের বদলে যাওয়া রাজনীতির কিছুটা প্রভাব পড়েছে জঙ্গলমহলেও। আদিবাসীদের অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করেছে বেশ কিছু উগ্র-হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। ২০১৯-এ আদিবাসীদের ভোটব্যাঙ্ক বানিয়ে লোকসভায় আসন বাড়ানোর স্বপ্নে চুড় বিজেপি পঞ্চায়েত ভোটে এক কুখ্যাত মাওবাদী সংগঠনের সাথে হাত মেলাতেও কুন্ঠিত হয়নি।
ত্রিলোচন কিংবা দুলালের মৃত্যুকে হাতিয়ার বানিয়ে শান্তির জঙ্গলমহলে হিংসার বিষ ছড়ানোর সুচতুর এই ষড়যন্ত্রকে বিফল করতে পারেন জঙ্গলমহলের বাসিন্দারাই। সেই সঙ্গে, সময় এসেছে তৃণমূলের আত্ম-সমালোচনার। দিদির উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ সত্ত্বেও মানুষ অখুশি কেন? বিশ্লেষণ করতে হবে দলকেই। নিতে হবে দ্রুত পদক্ষেপ। ফিরে পেতে হবে জনতার আস্থা।
ঈশাণ কোণে মেঘ জমেছে। সামনে সমূহ বিপদ। ডুবন্ত মানুষকে বাঁচাতে প্রয়োজন বাংলার কান্ডারী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)