অনেক কিছুর ভিড়ে আমার ‘নীপা’ যেন কোথাও হারিয়ে গেলো আমার থেকে। খবরের কাগজের পাতায় অনেক পুরনো দিনের নায়ক-নায়িকা কখনও দেখি, কিন্তু স্বয়ংসিদ্ধা-কে দেখতে পাইনি কোথাও।
তখন বয়স ওই এগারোর দোরগোড়ায়। নব্বই দশকের মাঝামাঝি ওই সময়টায় বাঙালি বাড়ির মাসিমা-জেঠিমারা রোববারের বিকেলে চারটে বাজলেই সমস্ত কাজকম্ম গুছিয়ে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে দূরদর্শনের সামনে বসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন কৃষ্ণেন্দু–রিনা ব্রাউনের জন্যে। কৃষ্ণেন্দু থুড়ি উত্তম কুমারের একটু হাসি আর মিস ব্রাউনের একটু ভ্রূ বাঁকিয়ে কথা বলার ‘ইইইস্টাইল’ জেঠিমাদের আগামী এক সপ্তাহের বাঁচার রসদ হয়ে থাকতো।
ধু ধু মরুভূমির মাঝে থিরুমলের জন্যে কুন্তির ডুকরে কেঁদে ওঠা দেখে (‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, ১৯৫৯), মাসিমারাও আঁচলে চোখ মুছতেন। সেই সময়ে যদি গৃহকর্তা একবার ভুল করেও বলে উঠতেন ‘‘কী গো একটু চা হবে নাকি?’’, নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্রকে মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়ে (কারণ আদরের সুরে ‘গো’ টা আর থাকতো না তখন মাসিমাদের মুখে) ঝাঁঝিয়ে বলে উঠতেন ‘‘জীবনে একটু শান্তি দিল না লোকটা, একটু শান্তিতে বইটাও দেখতে দেবে না। শেষ হয়ে গেল জীবনটা বিয়ে করে।’’
তার পরে যেদিন ছিপছিপে তরুণ সৌমিত্র সুন্দরী তনুজাকে দেখে গেয়ে উঠতেন ‘কে তুমি নন্দিনী, আগে তো দেখিনি’, পঞ্চাশের মাসিমাও যেন ‘সুইট সিক্সটিনে’ ফিরে যেতেন। আবার মিটিমিটি হাসতে হাসতে পাশে বসা ভদ্রমহিলাকে বলতেন ‘‘দেখো সৌমিত্রকে ঠিক যেন আমার ফুলমাসির বড়নাতির মতো দেখতে।’’ সে ফুলমাসির বড়নাতিকে যতই আমজাদ খানের মতো দেখতে হোক না কেন।
সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে এই সময়টা যেন একটা স্বপ্নের মতো ছিল। কত ছোট ছোট ঘটনায় কত ভাল লাগা যে ছিল। যেন মনে হতো দূরদর্শনের পর্দার বাইরেও একটা সুখ-দুঃখ-হাসিতে ভরা মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়ির শ্যুটিং হচ্ছে।
এখন বাড়ি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে নিউ জার্সির ফ্ল্যাটে বসে মাঝেমাঝে ভাবি এইসব। এখনকার এই নেটফ্লিক্স, সোশ্যাল সাইট চ্যাটিং, ইমিগ্রেশন আইনের চোখরাঙানি, বিটকয়েনের নাগরদোলার মাঝে খুব ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেইসব ‘নব্বই’-এর দিনগুলোয়।
আমার যদিও এইসব সিনেমা দেখার খুব একটা পারমিশন ছিল না। আমার জন্যে বরাদ্দ থাকত ‘গুপী-বাঘা’, ‘টেনিদা-ক্যাবলা’, ‘হীরক রাজা–উদয়ন পণ্ডিত’। আর হিন্দি সিনেমা তো নৈব নৈব চ। তাই প্রথমবার করপোরেট সেক্টরে কাজ করতে ঢুকে হিন্দিভাষী কলিগদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বলে ফেলতাম ‘‘কাল ম্যাঁয় বহুত এনজয় কিয়া থা।’’
কিন্তু বখাটেপনা আর পাকামিটা আমার মনে হয় হিমোগ্লোবিনের মধ্যেই ছিল জন্ম থেকে, তাই টয়লেট যাওয়ার অছিলায় বারে বারে জানলা দিয়ে টিভির পর্দায় উঁকি মারতাম। এই উঁকি মারতে মারতেই একদিন দূরদর্শনের সাদাকালো পর্দায় দেখেছিলাম এক অসম্ভব মিষ্টি মেয়ে ভীষণ দুষ্টমি মাখা চোখে গাইছে ‘বেশ করেছি প্রেম করেছি, করবই তো।’ মেয়েটির নাকটি ছিল টিয়াপাখির মতো, একেবারেই পাটকাঠির মতো না হয়ে তাঁর শরীর জুড়ে ছিল হালকা মেদের লালিত্য।
তখন আমিও ওই বায়ো-তেয়োর গণ্ডি পেরিয়ে গিয়েছি, তাই ইয়ে মানে পেরেম ব্যাপারটা বুঝতে শিখেছি। মনে মনে শোয়েব আখতারের প্রেমে পড়েছি, ফিজিক্যাল সায়েন্সের খাতার মলাটে শোয়েব আখতারের ছবিওয়ালা কাগজ দিয়ে মলাট করতে শিখেছি।
তাই গানটা বেশ মনে দাগ কাটলো। আর বেশি করে দাগ কেটে গেল নীপার থুড়ি মিঠু মুখোপাধ্যায়র দুষ্টুমি ভরা মিষ্টি অভিনয়। তারপর নীপাকে ‘মর্জিনা’ হিসেবে দেখলাম আবদাল্লার সঙ্গে। তারপর এলেন ‘স্বয়ংসিদ্ধা’ হিসেবে। অনেক প্রতিভাময়ী অভিনেত্রীকে আসতে যেতে দেখেছি। অনেককেই ভালো লেগেছে কিন্তু মর্জিনাকে আমার একটু অন্যরকমের লেগেছিল। ওই একটা ‘ এক্স ফ্যাক্টর’ খুঁজে পেয়েছিলাম।
তারপর ধীরে ধীরে পড়াশোনার কারণে বাইরে বাইরে থাকা, পড়াশোনার চাপে মায়ের সঙ্গে বসে পুরনো সাদাকালো যুগের সিনেমা দেখা কমে যেতে থাকল।
ইতিমধ্যে যদিও জীবনবোধ বদলাতে শুরু করেছিল ঘটক-সত্যজিৎ-মৃণালদের দেখে। তারপর আসেন ঋতুপর্ণ, অপর্ণা-রা। ইতিমধ্যে ইস্কুলের গণ্ডি পেরবার দৌলতে হিন্দি সিনেমা, গুটিকতেক ইংরেজি সিনেমাও জীবনে এন্ট্রি নিলো। সুধীর মিশ্রর ‘হাজারো খোয়াইশে অ্যায়সি’, ভিক্টর ফ্লেমিং -এর ‘গন উইথ দি উইন্ড’ দেখে মুগ্ধ হলাম।
তারপর রসায়নের রসে হাবুডুবু খেতে খেতে সুনীল-শক্তি-নবারুণে মজলাম। অনেক কিছুর ভিড়ে আমার ‘নীপা’ যেন কোথাও হারিয়ে গেলো আমার থেকে। খবরের কাগজের পাতায় অনেক পুরনো দিনের নায়ক-নায়িকা কখনও দেখি, কিন্তু স্বয়ংসিদ্ধা-কে দেখতে পাইনি কোথাও।
একদিন কেমিস্ট্রি ল্যাব থেকে ফিরে মর্জিনা থুড়ি মিঠু মুখোপাধ্যায়ের কথা খুব মনে হয়েছিল। তাই সেবার ল্যাপটপ খুলে উইকিপিডিয়া সার্চ করতে লাগলাম মিঠু মুখোপাধ্যায় লিখে। কিন্তু উইকি খুব বেশি কিছু খবর দিতে পারল না। কেমন আছেন, সুস্থ আছেন কিনা কিছুই বলতে পারল না। শুধু ওঁর কয়েকটা সিনেমার নাম দেখলাম। যেগুলো আমার দেখা হয়ে ওঠেনি নানা কারণে। বেশ কয়েকটা দেখেও ফেললাম। তার মধ্যে একটা ‘হোটেল স্নো ফক্স’। তিনি সেখানে ললিতা।
বাসু চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় হিন্দি সিনেমাও করেছিলেন। নিজের প্রযোজনায় ‘আশ্রিতা’ বানিয়েছিলেন। মনে পড়ল মেয়েবেলায় পাড়ার এক ভদ্রমহিলাকে বলতে শুনেছিলাম তাঁর কোনও পিসি নাকি ১১ বার আশ্রিতা সিনেমাটি দেখেছিলেন।
সেই দুষ্টু চোখের মিষ্টি মেয়েটি আজ কেমন আছেন, খুব জানতে ইচ্ছে করে। এই জেনারেশনের মেয়ে হয়ে আমি যে এখনও সাদাকালো যুগের কোনও নায়িকাকে নিয়ে এত কথা লিখলাম, অনেকেই মুখ টিপে হাসতে পারেন।
কিন্তু আমার বেয়াড়া মন, অনেক কিছু জিনিস খুঁজে বেড়ায়। তাই এই লেখাটিও লিখে ফেলা। হয়তো কালো অক্ষর দিয়েই কিছুক্ষণের জন্যে আমার অন্তরালে থাকা ‘নীপা’ কে দেখার চেষ্টা করলাম।
আরতি মুখোপাধ্যায়ের মতো আমারও গাইতে ইচ্ছে করছে ‘আমি তারেই খুঁজে বেড়াই যে রয় মনে আমার মনে’।