‘৭ নম্বর রামধন মিত্র লেন’। ‘হাতিবাগান পাড়ার শ্যামপুকুর স্ট্রিট’। টাউন স্কুলের পাশে সেই গলি ধরে একটু এগোলোই ‘রামধন মিত্র লেন’। সে-রাস্তায় আখাম্বা লম্বা হলদে রঙের ‘সাত নম্বর বাড়িটি’ নিজেই আস্ত একটা ইতিহাস! পাথরের ফলকে লেখা ‘বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর নাম’। আর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ তথা বাংলা সংস্কৃতিতে তাঁর অবদানের কথা। তিনি আমৃত্যু ছিলেন সেই বাড়ির বাসিন্দা। হলদে বাড়ির বিরাট ফটকের কাঠের দরজা পার হলেই নজরে পড়বে উঠোন ঘেরা ‘ঠাকুরদালান’। শ্যাওলা ধরা বিষণ্ণ ঠাকুরদালানে কী ‘চণ্ডীপাঠ’ করেছিলেন বাঙালির চিরকালের বীরেন ভদ্র? ডান হাতে ঠাকুরদালান রেখে বাঁ-হাতের কাঠের সিঁড়ির কয়েক ধাপ পেরিয়েই রয়েছে এক ‘সবুজ দরজার তালাবন্ধ ঘর’। এক সময় কে আসেননি ওই ঘরে? বিংশ শতকের নাট্য জগতের নট-নটীর কতজনই তো সেই ঘরে ঠাঁই নিয়েছিলেন। আজ আর কেউ সে ঘর খুলতে চান না! রাস্তার দিকের খড়খড়ির একটি খোলা জানলা অবশ্য চিনিয়ে দেয় ওই ঘরের আলো-আঁধারির রহস্য। চোখে পড়ে দেওয়ালের দিকের একটি সরু খাট। চেয়ার আর আলমারি। আসবাব বলতে ওইটুকুই। কিন্তু তাঁর বইগুলো সব গেল কোথায়? তিনি আক্ষরিক অর্থেই ‘বই পাগল’ ছিলেন। যত দিন মানসিক আর শারীরিক সামর্থ্য ছিল প্রাণে ধরে বইগুলো কাউকে তো দিতেন না বীরেন ভদ্র। বইই তো ছিল তাঁর ‘আত্মার আত্মীয়’। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কন্যা ‘সুজাতা ভদ্র’ অতীতে সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছলেন “অগুনতি বই! কে পড়বে? কোথায় রাখব? কারও সময় নেই। কিছু দিয়ে দিয়েছি আমরা, কিছু কোথায় চলে গেছে।” সেই ঘর পেরিয়ে এগিয়ে গেলে পড়বে একটা কাঠের সিঁড়ি। সেই সিঁড়িতে কোথাও রবীন্দ্রনাথ, তো কোথাও লাল জবা গলায় কালীঠাকুরের ছবি। সিঁড়ি ধরে সোজা তিনতলায় উঠে ডান হাতে একটি ঘর আছে। কাঠের সিঁড়ির শব্দ যেন মনে করিয়ে দেয় ধুতি-পাঞ্জাবি গায়ে, চপ্পল পায়ের এক ছায়াকে! এই যেন ‘আকাশবাণী’ থেকে নিজের ঘরে ফিরলেন তিনি। সেই ঘরজোড়া আছে একটা বিশাল খাট। তাঁর বিয়ের খাট। এই খাটে বসেই কি আবৃত্তি করেছিলেন ‘দেবতার গ্রাস’? ঘরে অনেকগুলো জানলা আছে যা দিয়ে আকাশ ঢুকে আসে। আজও সেই ঘরের কোণে ছড়িয়ে পড়ে ভাদ্রের হলদে রঙের পুজো-রোদ্দুর। ঘর থেকে দেখা যায় ছোট্ট ছাদ। সেই ছাদেই বীরেন্দ্র ভদ্রের ‘ঠাকুমা যোগমায়া দেবী’ কোনও এক অলস দুপুরে তাঁর স্নেহের ‘বুশি’কে (ডাকনাম) শোনাতেন ‘শেক্সপিয়ার’, ‘গিরিশ ঘোষের নাটক’ …। হতাশ গলায় এক সংবাদপত্রের সাংবাদিককে অতীতে সুজাতা ভদ্র’ আরও জানিয়েছিলেন – “চশমা, কলম সবই তো নিয়ে গেছে মিডিয়ার লোক। আমাদের তো কিছুই নেই!” আজ তাঁর সেই ঘরে পা দিলে হঠাৎ মনে হতে পারে যে কে যেন বলে উঠলেন, “বছরের শুধু এই সময়েই মনে পড়ে? সারা বছর তো কেউ ফিরেও তাকায় না। যত্তো সব!”
১৯৯১ সালের ৩রা নভেম্বর অমৃতলোকে যাত্রা করেছিলেন ‘বেতার পুরুষ’। শেষ বয়সের অনেক সাক্ষাৎকারেই বারবার ঠিকরে বেরিয়েছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণের হতাশা, অভিমান, বলেছিলেন – ‘‘ভাবতেই পারিনি সবাই আমাকে ভুলে যাবে …’’ তবে আবার নিজেই বলে গিয়েছিলেন, ‘‘আমাকে ভুলে গেলেও বছরে এক বার সেই দিনটিতে স্মরণ করবেই করবে। তাতেই আমার তৃপ্তি।’’ বেতারে আক্ষরিক অর্থে ‘জুতো সেলাই’ থেকে ‘চণ্ডীপাঠ’ পর্যন্ত করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। কিন্তু বেতার কি তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান দিতে পেরেছিল? তখন স্টাফ আর্টিস্টদের ‘পেনশন-গ্র্যাচুয়িটির ব্যবস্থা’ ছিল না। প্রভিডেন্ট ফান্ডের সামান্য কয়েকটি টাকা নিয়ে বেতার থেকে অবসর নিয়েছিলেন তিনি। ‘রবীন্দ্র ভারতীতে বেতার-নাটক বিষয়ে’ প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন কিছু দিন। একটা সময় ‘শিল্পী রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে’ কলকাতা ও অন্যত্র ‘শ্রীরামকৃষ্ণ ও মহাভারত বিষয়ে পাঠ-গান’ করেছিলেন। সামান্য অর্থের বিনিময়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হতেন, এমনকি প্রতিমার আবরণ উন্মোচনও করতেন! রেডিওর ‘স্টাফ আর্টিস্ট’ হয়েই অবসর নিয়েছিলেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ। ‘পেনশন’ জোটেনি। আসলে নিজের আখের গোছানোর কথা তিনি কখনও ভাবেননি। অবসরের পরে, শেষ পর্যন্ত ‘মহাভারতের কথা’ বলার জন্য ক’টা টাকা পেতেন। শেষ জীবনে ক্রমশঃ তাঁর ‘স্মৃতিভ্রংশ’ হয়ে আসছিল। তাতে অস্বস্তিতে পড়ছিলেন তখনকার বেতারের ‘প্রোগ্রাম অফিসার’। শেষে সেই অনুষ্ঠানও তাঁকে দিয়ে আর চালু রাখা যায় নি! তখন অর্থাভাব মেটাতে বাধ্য হয়ে পাড়ায় পাড়ায় অনুষ্ঠান উদ্বোধন করে বেড়াতে শুরু করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। সেখান থেকেও যে বেশি কিছু পেতেন, তা’ও নয়। সামান্য কিছু জুটত।
রেডিয়ো-র ‘মস্ত দায়’ তিনি বয়ে বেড়িয়েছিলেন চাকরির শেষ দিন পর্যন্ত। অথচ এমন মানুষকেও বারবার অপমানের মুখে পড়তে হয়েছিল! এমন একটি ঘটনার কথা তাঁকে চিনতেন ও জানতেন, বেতার জগতের সাথে যুক্ত মানুষের স্মৃতিতে ভেসে আসে। সেবার, অবসর নেওয়ার পর রেডিয়ো-য় কী একটা কাজে এসেছিলেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ। ঢুকতে গিয়ে বাধা পেয়েছিলেন। ‘সিংহ’ নামের একজন ‘সিকিউরিটি গার্ড’ তাঁর কাছে ‘পাস’ চেয়ে বসেছিলেন। সেদিন মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল তাঁর, থরথর করে কেঁপে উঠেছিলেন, ফর্সা চেহারায় শিরাগুলো দপদপ করে উঠেছিল। সেদিন তিনি কেবলই চিৎকার করে বলেছিলেন, “জন্ম দিয়েছি রেডিয়োকে আমি! জন্ম দিয়েছি! আমিই জন্ম দিয়েছি! আমার কাছে পাস চাইছ? পাস?” যারা এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তাঁদের মনে হয়েছিল এ শুধু চিৎকার করে ক্ষোভ উগরে দেওয়া নয়, এর গভীরে কি লুকিয়ে আছে কান্নাও? সেই দৃশ্য আজও অনেকেই কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারেন না।
শরতের পুজো, পুজোর কলকাতা, কলকাতার বেতার, বেতারের বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র! ইনি এমন এক বাঙালি, যাঁর অভাবনীয় জনপ্রিয়তার কারণে বেতারের অনুষ্ঠানকেই ‘মহালয়া’ বলে ভুল করেন অনেকে। আসলে ‘মহালয়া’ একটি তিথি। অনুষ্ঠানটির নাম ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। এই অনুষ্ঠানের এতটাই জনপ্রিয়তা যে, তাঁকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা মিথ। অনেকেই বলেন, চণ্ডীপাঠের আগে স্নান করে পট্টবস্ত্র পরে পুরোহিতের সাজে বসতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। কিন্তু তাঁর কন্যা ‘সুজাতা ভদ্র’ অতীতে সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, ‘‘বাবাকে কখনও ঠাকুরকে একটা ধূপও দিতে দেখিনি। অনুষ্ঠানের দিন বিয়ের জোড়টা সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন।’’ বীরেন্দ্রকৃষ্ণের স্তোত্রপাঠের গাম্ভীর্যে মুখরিত হয়ে ওঠে মহালয়ার আধো ঘুমে-আধো জেগে থাকা পাড়া। বাঙালির ক্লিন্ন মনে সঞ্চারিত হয় ভাবরস। তখন কারও মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে মায়ের মৃন্ময়ী রূপ, কারও চোখে ভাসে তাঁর ইষ্ট দেবতা, কেউ বা হয়তো দেখতে পান তাঁর হারানো প্রিয়জনকে। সুজাতা ভদ্র আরও জানিয়েছিলেন – ‘‘আমরা চার বোন ছাদে বসে তখন ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শুনতাম। হিম পড়ত। তাই গায়ে একটা হালকা চাদর জড়িয়ে নিতাম। মন দিয়ে শুনলে দেখবেন, শুনতে শুনতে চোখে জল চলে আসে …।’’ কয়েক প্রজন্ম ধরে বাঙালির মাতৃ-আবাহনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। প্রাক-স্বাধীনতা যুগ থেকে সে যাত্রাপথের শুরু। ‘বেতার জগৎ’ বিক্রি থেকে বেতারের জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছনোর দীর্ঘ পথেই কেটেছিল তাঁর জীবনের আলো-ছায়া। ঘর নয়, কাজই ছিল তাঁর সর্বক্ষণের প্রিয় সঙ্গী। তবু অবসরের পরে তেমন আর্থিক সুবিধে পাননি। আক্ষেপ করেছিলেন, দুঃখ পেয়েছিলেন। তবু তিনি তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় বেতারের সঙ্গ ছাড়েননি।
১৯০৫ সালের ৪ঠা আগস্ট বীরেন্দ্রকৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল। বাবা ‘কালীকৃষ্ণ ভদ্র’ এবং মা ‘সরলাসুন্দরী দেবী’। ‘রামধন মিত্র লেনের বাড়িতে’ তিনি এসেছিলেন খুবই ছোট বয়সে। বাড়িটি কিনেছিলেন তাঁর ঠাকুমা। তাঁর উপার্জিত অর্থে। পঞ্জাবের নাভা স্টেটের মহারানির প্রাইভেট টিউটর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন তিনি। সেই সময়ের নিরিখে তিনি ছিলেন উচ্চশিক্ষিতা। ইংরেজি, সংস্কৃত জানতেন। ঠাকুমার কাছেই সংস্কৃতের প্রথম পাঠ হয়েছিল বীরেন্দ্রর। বাড়ির কাছেই তেলিপাড়া লেনে কয়েক জন ছাত্রকে নিয়ে একটি প্রাইভেট স্কুল শুরু করেছিলেন ‘রাজেন্দ্রনাথ দে’। তিনি ছিলেন সাত্ত্বিক মানুষ, মাছ-মাংস খেতেন না। ছোট্ট বীরেনকে খুব স্নেহ করতেন। তাঁর বাড়িতেই দশ বছর বয়সে প্রথম ‘চণ্ডীপাঠ’ করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। এর পরে টাউন স্কুলে ভর্তি হন। তবে রাজেনবাবুর সঙ্গে যোগাযোগে ছেদ পড়েনি।
অঙ্কে মন ছিল না বীরেন্দ্রর। ম্যাট্রিক পাশ করেই জ্যামিতি, বীজগণিত, পাটিগণিতের যত বই ছিল, সব গঙ্গায় জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। এত দিনের বোঝা লঘু করতে পেরে সে কী আনন্দ! তবে ছোটবেলা থেকেই স্মৃতিশক্তি প্রখর। ভাল আবৃত্তি করতে পারতেন। এক বার রাজেনবাবু এক আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় বীরেনের নাম লিখিয়ে দিয়েছিলেন। ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ ছিল আবৃত্তির বিষয়। মাঝে মাঝেই তাগাদা দিতেন, মুখস্থ কত দূর হয়েছে জানার জন্য। তবে ‘আজ করছি, কাল করছি’ বলে বীরেন কাটিয়ে দিতেন। প্রতিযোগিতার তিন-চার দিন আগে হুঁশ হয়েছিল তাঁর। চল্লিশ পাতার কবিতা মুখস্থ করতে হবে! তাঁর আত্মবিশ্বাস বরাবরই একটু বেশি ছিল। কবিতাটা শিখেও ফেলেছিলেন নির্দিষ্ট দিনের আগেই। প্রতিযোগিতায় দু’-চার পৃষ্ঠা বলার পরেই থামতে বলা হয়েছিল বীরেনকে। তবে তাঁর উচ্চারণ শুনেই হোক বা মুখস্থ শক্তির পারদর্শিতা দেখে – এক বিচারক আরও কিছুটা অংশ শোনাতে বলেছিলেন তাঁকে। সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন বীরেন।
স্কুলে দুষ্টুমিও ছিল তাঁর অভিনব। এক বার নকল টিকি চুলের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিলেন। আর গরু লেজ দিয়ে যে ভাবে মাছি তাড়ায়, সে ভাবেই ছটফট করেছিলেন ক্লাসে। বাকি ছাত্ররা হেসে লুটোপুটি। কিন্তু স্যরের চোখে পড়তেই সমূহ বিপদ। বেশ কয়েকটা চড়-চাপড় খেতে হয়েছিল তাঁকে। আবার ক্লাসে নতুন কেউ এলে ল্যাং মেরে ফেলেও দিতেন। তবে খেলাধুলোয় একেবারেই উৎসাহ পেতেন না কিশোর বীরেন। সাঁতার, ব্যাডমিন্টন, টেনিস … কিছুতেই না। নিজেই লিখেছেন, ‘‘ঘুড়ি পর্যন্ত ওড়াতে গিয়ে দেখেছি আমি অন্য কারও ঘুড়ি কাটতে পারতুম না। এক বার ফুটবল খেলতে গিয়েছিলুম গড়ের মাঠে। বাবা বললেন, ও সব খেলাটেলা ছেড়ে দাও। ব্যস, সেখানেই ওই খেলাতেও ইতি।’’
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ যখন ‘স্কটিশ চার্চ’ কলেজে’ পাঠরত ছিলেন, তখন, ১৯২৭ সালের ২৬শে আগস্ট ‘ডালহৌসির এক নম্বর গার্স্টিন প্লেসে’ ‘বোম্বাইয়ের ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি’ একটি বেতার কেন্দ্র স্থাপন করে। এর আগেও কলকাতায় ছোট ছোট দু’টি বেতারকেন্দ্র ছিল। তবে সেগুলো শ্রোতাদের মধ্যে সে ভাবে আগ্রহ তৈরি করতে পারেনি। ‘চিত্রা সংসদ’ নামে একটি ক্লাবের সদস্য ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। সেখানে গান-বাজনা, অভিনয়ের চর্চা হত। সেই দলেই ছিলেন ‘পঙ্কজ মল্লিক’, ‘বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য’ (বাণীকুমার), ‘পশুপতি চট্টোপাধ্যায়’, ‘সত্য দত্ত’, ‘বিজন বসু’ প্রমুখ। নাট্য পরিচালনার সূত্রে তাঁর আলাপ হয়েছিল ‘মনোমোহন ঘোষের’ সঙ্গে, যিনি পরে ‘চিত্রগুপ্ত’ নামে লিখতেন। বীরেন্দ্র তাঁকেও নিয়ে এসেছিলেন সেই ক্লাবে। নতুন স্থাপিত বেতারকেন্দ্রের ভারতীয় অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বভার দেওয়া হয়েছিল ‘নৃপেন মজুমদারের’ কাঁধে। তাঁর সহকারী ছিলেন রইলেন ‘রাইচাঁদ বড়াল’ ও ‘রাজেন্দ্রনাথ সেন’। বেতারের নিজস্ব নাটকের দল থাকলেও বাইরের কয়েকটি দলও তখন রেডিয়োয় অনুষ্ঠান করত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ও চিত্রা সংসদের অন্যরা ভেবেছিলেন, তাঁরাও তো একটা নাটক করতে পারেন। পরশুরামের ‘চিকিৎসা সঙ্কট’-এর নাট্যরূপ দিয়ে তাঁরা যোগাযোগ করেছিলেন রেডিয়োর সঙ্গে। ‘নৃপেন মজুমদার’ রাজি হয়েছিলেন। ১৯২৮ সালের ২১শে আগস্ট বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পরিচালনায় রেডিয়োয় পরিবেশিত হয়েছিল সেই নাটক। অংশগ্রহণে ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ও বাকিরা। সেটাই ছিল কলকাতা বেতারকেন্দ্রের সঙ্গে তাঁর প্রথম যোগাযোগ।
১৯২৮ সালে ‘বিএ’ পাশ করে বাবার এক বন্ধুর সুপারিশে তিনি যোগ দিয়েছিলেন ‘ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের ফেয়ারলি প্লেসের অফিসে’। দুপুরে টিফিনের বিরতি বা বিকেলের অবসরে চলে আসতেন রেডিয়োয়। যেখানেই যেতেন, আসর জমিয়ে দিতে পারতেন। তাঁর এই গুণেই মোহিত হয়ে ‘নৃপেন মজুমদার’ তাঁকে রেডিওতে যোগ দেবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। চাকরি ছেড়ে বীরেন্দ্র রেডিওতে যোগ দিয়েছিলেন ১৯২৮ সালের শেষের দিকে। ১৯২৯ সালের এপ্রিল মাসে ‘মেঘদূত’ ছদ্মনামে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ শুরু করেছিলেন ‘মহিলা মজলিশ’। রেডিয়োর প্রথা ভেঙে একেবারে অন্য রাস্তায় হেঁটেছিলেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র। মহিলাদের জন্য ‘মহিলা মজলিস’ আরম্ভ করেছিলেন ‘মেঘদূত’ ছদ্মনামে। পরে যদিও তিনি ‘শ্রীবিষ্ণুশর্মা’ ছদ্মনামে অনুষ্ঠান প্রচার করেছিলেন। তিনি সেই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিষয়ে বক্তৃতা দিতেন। ‘ভগিনী নিবেদিতা’, ‘সাবিত্রী’, ‘দ্রৌপদী’, ‘বিজ্ঞানের নানা খবর’, ‘সাহিত্যে নারীদের স্থান’, ‘ইউরোপের নারীদের কথা’ … এমন নানা বিষয়ে আলোচনা হত সেখানে। শ্রোতাদের চিঠিপত্র পড়ে শোনাতেন। পিয়ানো বাজাতেন। অনুষ্ঠান নিয়ে মহিলাদের মতামত চাওয়া হলেও বলে দেওয়া হত, মহিলারা যেন ব্যক্তিগত কথা জানিয়ে পত্র না লেখেন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে এই অনুষ্ঠান নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। মহিলাদের কী করা উচিত, বলা উচিত তা ‘বিষ্ণুশর্মা’ কেন ঠিক করে দেবেন? অননুকরণীয় বাগ্মিতায় অল্প সময়ের মধ্যেই মহিলামহলে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন বীরেন্দ্র। বহু লোক সে সময় রেডিয়ো স্টেশনে এসে ‘বিষ্ণুশর্মা’কে দেখতে চাইতেন। কিন্তু ‘বিষ্ণুশর্মারূপী বীরেন্দ্র ভদ্র’ আগ্রহী শ্রোতাদের কাছে অধরাই ছিলেন। ওই বছরেই সেপ্টেম্বরে পাক্ষিক পত্র হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল বেতারকেন্দ্রের মুখপত্র ‘বেতার জগৎ’। সম্পাদক ছিলেন ‘প্রেমাঙ্কুর আতর্থী’। পরে সেই দায়িত্ব পেয়েছিলেন ‘নলিনীকান্ত সরকার’। সম্পাদনার কাজেও বীরেন্দ্রর উৎসাহ ছিল অগাধ। সালটা ছিল ১৯৩৬। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম পক্ষের অনুষ্ঠানসমৃদ্ধ ‘বেতার জগৎ’ প্রকাশিত হবার কথা ছিল ২৫শে জানুয়ারি। ঠিক তার চার দিন আগে মারা গিয়েছিলেন ‘সম্রাট পঞ্চম জর্জ’। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের সঙ্গে কথা বলে ‘নলিনীকান্ত সরকার’ ঠিক করেছিলেন, পত্রিকার সংখ্যাটি ‘পঞ্চম জর্জ সংখ্যা’ রূপে প্রকাশ পাবে। বীরেন্দ্র ছুটেছিলেন ‘ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি’তে (এখনকার ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি’)। সেখান থেকে ‘পঞ্চম জর্জ সম্পর্কিত’ দু’টি মোটা মোটা বই এনে তথ্যসমৃদ্ধ একটি প্রবন্ধ লিখে ফেলেছিলেন তিনি। নির্দিষ্ট দিনেই প্রকাশিত হয়েছিল সেই সংখ্যা।
১৯৩২-এর ষষ্ঠীর ভোরে প্রথম বার প্রচারিত হয়েছিল বেতারের কালজয়ী অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। তবে ১৯৩১ সালে ‘বসন্তেশ্বরী’ নামে প্রথম বার শোনা গিয়েছিল সেই অনুষ্ঠান, যেখানে ‘বাণীকুমার’ শ্রীশ্রী চণ্ডীর কয়েকটি শ্লোক আবৃত্তি করেছিলেন। শ্রোতাদের কাছে বিশেষ ভাবে সমাদৃত হয়েছিল সেটি। তখনই সকলে ভেবেছিলেন, ষষ্ঠীর সকালে এমন একটি অনুষ্ঠান করলে কেমন হয়! সংস্কৃত রূপকের অন্তর্গত ‘বীথী’ নাট্য রচনাশৈলী অনুসরণে নতুন ভাবে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ প্রণয়ন করেছিলেন ‘বাণীকুমার’। সেই অনুষ্ঠানের কয়েকটি গানে সুরযোজনা করেছিলেন ‘পণ্ডিত হরিশচন্দ্র’ ও ‘রাইচাঁদ বড়াল’ আর অধিকাংশ গানে ছিলেন ‘পঙ্কজকুমার মল্লিক’। গ্রন্থনায় ও শ্লোক আবৃত্তিতে ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। পরে ‘বাণীকুমারের বড় ছেলে নৃসিংহকুমার ভট্টাচার্য’ জানিয়েছিলেন, ‘‘বীরেন জেঠা কিন্তু গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতেন না। অনুষ্ঠানের আগের রাতে আটটা-ন’টা নাগাদ শতরঞ্চি আর বালিশ নিয়ে চলে যেতেন বেতারকেন্দ্রে। বাবাকে গাড়ি নিতে আসত রাত দুটো নাগাদ।’’ তিনি আরও জানিয়েছিলেন – ‘‘বীরেন জেঠা বাবাকে ডাকতেন ‘বোদে’ বলে। সকলের সামনে অবশ্য ‘বাণী’ বলতেন। কায়স্থ ঘরের ছেলে হয়ে চণ্ডীপাঠ করবেন, এতে কর্তৃপক্ষও ভয় পেয়েছিলেন। তবে বাবা বলেছিলেন, এটা শুধু বীরেনই করতে পারে। ও-ই করবে।’’ অবশেষে এসেছিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। যন্ত্রসঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আবেগকম্পিত কণ্ঠে একটু সুর জড়িয়ে বেতারে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বলে উঠেছিলেন – ‘‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর …।’’ ‘পঙ্কজ মল্লিক’ হাত নেড়ে ইশারায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘ঠিক আছে, চালিয়ে যাও।’ সেই শুরু হয়েছিল … প্রথম কয়েক বছর এই অনুষ্ঠানের যুগ্মভাবে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন ‘রাইচাঁদ বড়াল’ ও ‘পঙ্কজ মল্লিক’। পরে একক ভাবে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন ‘পঙ্কজ মল্লিক’। পরবর্তী কালে অবশ্য অনুষ্ঠানে কিছু পরিমার্জন, পরিবর্ধন করা হয়েছিল। গানের শিল্পীও বদলে গিয়েছিলেন। তবে গ্রন্থনা ও আবৃত্তির শিল্পী ছিলেন অপরিবর্তিত। ‘নৃসিংহকুমার ভট্টাচার্য’ জানিয়েছিলেন, ‘‘অনুষ্ঠানের পরে বীরেন জেঠার অন্য রূপ। প্রাণখোলা, হাসিখুশি। সারা পাঞ্জাবিতে লেগে থাকত নস্যি। আর কাউকে সামনে পেলেই তাঁর জামায় নস্যি লাগিয়ে দিতেন।’’ নিজের স্মৃতিচারণায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ লিখেছিলেন, ‘‘দু’টি জিনিসের নেশা ছিল। নস্যি আর থিয়েটারে অভিনয়।’’
বেতারে নানা ধরনের অনুষ্ঠান করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। তবে রেডিয়ো-নাটকের তিনি ছিলেন অবিসংবাদী পথিকৃৎ। রঙ্গমঞ্চে অভিনীত ‘গিরিশচন্দ্র ঘোষ’, ‘দীনবন্ধু মিত্র’, ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত’, ‘দ্বিজেন্দ্রলাল রায়’, ‘শচীন্দ্র সেনগুপ্ত’ প্রমুখ নাট্যকারের বিখ্যাত নাটক বীরেন্দ্রকৃষ্ণের প্রযোজনায় বেতারস্থ হয়েছিল। অনেক নাটক পেশাদারি মঞ্চের চেয়েও বেতারে বেশি সফল হয়েছিল। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ডাকেই তখনকার রঙ্গমঞ্চের বিখ্যাত শিল্পীরা নাটক করেছিলেন বেতারে। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা দ্বিজেন্দ্রলালের ‘চন্দ্রগুপ্ত’। অভিনেতা বিকাশ রায় তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘‘মাইক্রোফোনের সঙ্গে দোস্তি ছিল বীরেন ভদ্রের। ওঁর যে কোনও অনুষ্ঠান হাঁ করে শুনতাম। মনে হত, শ্রোতাদের সঙ্গে খেলা করছেন।’’ সম্ভবতঃ ১৯৩২ সালে ‘জামাইষষ্ঠীর দিনে’ অভিনয়ের জন্য একটি প্রহসন লিখেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। যে দিন অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হবে, সে দিন চার-পাঁচটি গান রচনা করে তাতে সুর বসিয়ে গানগুলো কুশীলবদের তুলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সন্ধেয় বেতারস্থ হল ‘প্রহারেণ ধনঞ্জয়’। শ্রোতাদের অনুরোধে অনেক বার প্রচার করা হয়েছে প্রহসনটি। তবে এই অনুষ্ঠানটি শুরুর পিছনেও একটি ঘটনা আছে। ‘নৃপেন মজুমদার’, জামাইষষ্ঠীর দিনে অভিনয় করার জন্য এক ভদ্রলোককে একটি প্রহসন লিখতে অনুরোধ করেছিলেন। ‘আজ দিচ্ছি কাল দিচ্ছি’ করে প্রায় দিন পনেরো পেরিয়ে গিয়েছিল। নাটক আর লেখা হয় না। এ দিকে জামাইষষ্ঠী এসে পড়ল বলে। শেষমেশ ঠিক আগের দিন, বীরেন্দ্র কৃষ্ণ প্রহসনটি লিখতে বসেছিলেন। মাত্র একদিনে একটি বই শুধু লিখে ফেলেননি তিনি, যেদিন সন্ধ্যায় নাটকটি অভিনীত হবে সেদিন চার-পাঁচটি গান লিখে, নিজে সুর দিয়ে কুশীলবদের শিখিয়েও দিয়েছিলেন। এ ছাড়াও তাঁর প্রযোজিত নাটকের মধ্যে অন্যতম ‘ডি. এল রায়ের’ ‘সাজাহান’, ‘শচীন সেনগুপ্তের’ ‘প্রলয়’। ১৯৩১ সালের ৮ই মে বেতারে অভিনীত হয়েছিল ‘ডি এল রায়ের’ ‘সাজাহান’ নাটক। সে এক মনে রাখার মতো ঘটনা! কণ্ঠে ছিলেন – ‘বীরেন্দ্রকৃষ্ণ’ (আওরঙজেব), ‘অহীন্দ্র চৌধুরী’ (সাজাহান), ‘দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়’ (দারা), ‘নিভাননী’ (জাহানারা), ‘মিস বীণাপাণি’ (পিয়ারী)। ‘অহীন্দ্র চৌধুরী’, ‘দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়’, ‘নরেশ মিত্র’, ‘সরযূবালা দেবী’কে দিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বেতারে অভিনয় করালেও ‘শিশির কুমার ভাদুড়ী’ বেতারে নাটক করতে চাননি সেটা বীরেন্দ্র কৃষ্ণের কথা থেকেই জানা যায়। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ জানিয়েছিলেন, ‘‘শিশির ভাদুড়ী মাইক্রোফোনের সামনে এসে কেবলই এদিক-ওদিক হাত পা নেড়ে অভিনয় করতে চাইতেন। পরে নাকি বলেছিলেন, ধূর রেডিয়োয় আমি গিয়ে কী করব? সব কেমন বন্ধ, বন্ধ! আমার কিছুই করার নেই!’’ ‘শ্রী নলিনীকান্ত সরকারের স্মৃতিচারণে’ও বীরেন্দ্র কৃষ্ণ কে নিয়ে আরেকটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। তাঁর বক্তব্যে, “বর্ষাকাল। বৃষ্টির জন্য বাড়ি থেকে বেতারের কেউই বেরোতে পারেনি। সন্ধ্যা নাগাদ বৃষ্টির তোড় আরও বাড়ল। রেডিয়োটা চালালাম। বীরেন্দ্র ভদ্রের কণ্ঠে ঘোষণা। বললেন, ‘এ বার একটু পিয়ানো শুনুন’। বুঝতে পারলাম, প্রথম আর্টিস্ট আসেননি। পিয়ানো বাজিয়ে অভাব পূরণ করলেন বীরেন্দ্র ভদ্র। দ্বিতীয় আর্টিস্টও অনুপস্থিত। বীরেন্দ্র ভদ্র ঘোষণা করলেন এ বার রবীন্দ্রসঙ্গীত। বাহুল্য এ বার গায়কও বীরেন্দ্র ভদ্র।”
বীরেন্দ্রকৃষ্ণের রসবোধের গুণে তাঁর অনুষ্ঠানগুলি শ্রোতাদের কাছে সঞ্জীবিত হয়ে উঠেছিল। এমনই একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল ‘শ্রোতাদের চিঠিপত্রের উত্তরদানের অনুষ্ঠান’ – ‘সবিনয় নিবেদন’। এক বার এক শ্রোতা চিঠি লিখেছিলেন, রেডিয়োয় কীর্তনের অনুষ্ঠান কেন কমে যাচ্ছে, তা নিয়ে। সেই শ্রোতার মতে, কীর্তন যে ধর্মসাধনার অঙ্গ। তার উত্তরে ‘সবিনয় নিবেদনে’ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘‘দেখুন, আমাদের হরেক শ্রোতার মন জুগিয়ে চলতে হয়। শ্রোতারাই চিঠিতে নানা রকম অবাক্যি-কুবাক্যি বলে আমাদের কীর্তন কমাতে বাধ্য করেছেন। এক শ্রোতা কী লিখেছেন জানেন? সকাল, বিকেল, রাত্তির – যখন রেডিয়ো খুলি, খালি কীর্তন আর কীর্তন। শ্রোতাদের বাড়িগুলোকে যে আপনারা শ্রাদ্ধবাড়ি করে তুললেন!’’ বেতারকেন্দ্রের ক্যান্টিনে বসে ছোট-বড় সকলের সঙ্গেই গল্প জমিয়ে দিতে পারতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। সেখানে কোনও ভেদাভেদ ছিল না। তবে কাজের সময়ে গল্প জুড়লে যত রথী-মহারথীই হোন, তাঁকে নিষেধ করতেও পিছপা হতেন না। এমনই ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব। বীরেন্দ্র কৃষ্ণের অসম্ভব রকমের এই সব ক্ষমতার জন্য বহু গুণিজন তাঁকে বেশ মান্যি করতেন। একবার ‘জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়’ অল্প টাকা পাওয়ার জন্য স্থির করেছিলেন রেডিয়োতে আর অভিনয় করবেন না। তখন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ তাঁকে ডেকে ধমকে বলেছিলেন, “তুমি কি রেডিয়োতে টাকা রোজগার করতে এসেছ?” ওই এক কথাতেই কাজ হয়েছিল। ‘জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়’ আর কোনও উচ্চবাচ্চ্য করেননি। রেডিয়োর প্রতি বীরেন্দ্র কৃষ্ণের অমন টান দেখে তিনি আবার রেডিয়োয় চলে আসেন।
১৯৪১ সালের ৭ই অগস্ট। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শরীর অত্যন্ত খারাপ। স্বাস্থ্য ক্রমশ অবনতির দিকে। ‘স্টেশন ডিরেক্টরের নির্দেশ’ ছিল, সকাল থেকে প্রতি পনেরো মিনিট অন্তর কবির খবর শ্রোতাদের কাছে জানাতে হবে। ‘নলিনীকান্ত সরকার’ ছিলেন ‘জোড়াসাঁকো’তে। সেখান থেকে প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর ফোন করে পাঠাচ্ছিলেন কবির খবর। আর সেই সূত্র ধরে রেডিয়ো অফিস থেকে পনেরো মিনিট অন্তর বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ঘোষণা চলেছিল দুপুর পর্যন্ত। ‘বেলা বারোটা তেরো মিনিটে’ ‘বিশ্বকবি’ অমৃতলোকে যাত্রা করেছিলেন। বেতার কর্তৃপক্ষ ঠিক করেছিলেন, শ্মশানক্ষেত্র থেকে অনুষ্ঠানাদি রিলে করা হবে। ‘কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তির শেষযাত্রার ধারাবিবরণী’ রেডিয়োয় সেই ছিল প্রথম। এরপরে ‘তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়’, ‘বিধানচন্দ্র রায়’ প্রমুখের অন্তিমযাত্রার বিবরণও দিয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। এক সময়ে ‘নিমতলা ঘাট’ থেকে প্রতিমা বিসর্জনের ধারাবিবরণীও দিয়েছিলেন নিয়মিত। বেতারে ‘ক্রিকেট-ফুটবল খেলার ধারাবিবরণী’ও প্রথম শোনা গিয়েছিল তাঁরই কণ্ঠে। তবে ফুটবল খেলাটা তিনি প্রথম দিকে একেবারে জানতেন না। তবু চলে গিয়েছিলেন মাঠে। খেলার নিয়ম না জানায় কৌতুককর পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয়েছিল। যেমন, এক বার কোন একটি খেলায় একটি দলের গোলের সামনে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি হয়েছিল। তবে গোলকিপার বল ধরে কোনও ক্রমে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু বীরেন্দ্রকৃষ্ণ উত্তেজনায় বলে উঠেছিলেন, ‘‘এই রে হ্যান্ডবল হয়েছে, হ্যান্ডবল হয়েছে।’’ পাশ থেকে তখন কেউ তাঁকে শুধরে দিয়েছিলেন। আর এক বার গোল হয়েছে, তিনি তা জানাতেই ভুলে গিয়েছিলেন!
বেতার কেন্দ্রের বাইরেও তাঁর বহুমুখী প্রতিভা ছড়িয়ে পড়েছিল। ‘পেশাদার রঙ্গমঞ্চে’, ‘গ্রামোফোন রেকর্ডে’, ‘ছায়াছবিতে’ আর ‘বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালিখি’তেও তিনি ছিলেন অনন্য বিস্ময়। ‘পেশাদার রঙ্গমঞ্চে পরিচালক’ হিসেবে তাঁর প্রথম অভিষেক ঘটেছিল ‘রঙমহলে’ ‘অভিষেক’ নাটকে (১৯৩৭)। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় হয়েছিল ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা’। ওই বছর ‘মিনার্ভা’য় প্রথম বার মঞ্চস্থ হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্রের ‘সীতারাম’ নাটক। ‘নামভূমিকায়’ অভিনয় করেছিলেন ‘কমল মিত্র’ আর প্রধান স্ত্রী চরিত্রে ছিলেন ‘সরযূবালা দেবী’। ১৯৫৮ সালে বীরেন ভদ্রের পরিচালনায় ‘মায়ামৃগ’ নাটকে প্রথম বার মঞ্চে অভিনয় করেছিলেন ‘বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়’। তাঁর কথায়, ‘‘আমি মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি যেতাম। উনি আমাকে আকাশবাণীতে বীরেনদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। কী জানি, আমাকে দেখে ওঁর কী মনে হয়েছিল! বলেছিলেন, তুমি পারবে। মঞ্চে অভিনয়, বেতারে কণ্ঠস্বর মডিউলেশন সব কিছুই ওঁর কাছে শেখা। আমাকে বলতেন, নিজে মেকআপ করবে। কারও উপরে নির্ভর করে থাকবে না। অভিনয় জগতে চলতে হলে কার সঙ্গে কী ভাবে মিশতে হবে, সেটাও উনি বলে দিয়েছিলেন।’’ তবে বিশ্বজিত আক্ষেপ করে এটাও জানিয়েছিলেন, ‘‘উনি যখন মারা যান, কেউ আমাকে জানায়নি। আমি তখন বম্বেতে কাজ করছি। জানার পরে খুব কেঁদেছিলাম।’’ বেতারে ‘রূপ ও রঙ্গ’র আসরে ‘বিরূপাক্ষ’ ছদ্মনামে নিজের লেখা কৌতুক-নকশা পরিবেশন করেছিলেন বীরেন। ‘বিরূপাক্ষের ঝঞ্ঝাট’, ‘বিরূপাক্ষের বিষম বিপদ’, ‘বিরূপাক্ষের অযাচিত উপদেশ’ বই আকারেও প্রকাশিত হয়েছে। রেডিয়ো ছাড়া তো তখন অন্য কোনও বিনোদন মানুষের ছিল না। আর রেডিয়োয় তখন থিয়েটারের ভূত চেপেছিল যেন। বীরেন্দ্র কৃষ্ণও সেই পথে হেঁটেছিলেন। কিন্তু তাঁকে একেবারে নতুন করে সব কিছু করতে হয়েছিল। তাঁর সামনে তো কোনও কাঠামো ছিল না। কাজ করতে করতে তাঁকে খুঁজে বার করতে হয়েছিল রেডিয়ো নাটকের নিজস্ব ভাষা। কেমন করে পাতা ওল্টাতে হবে, যাতে পাতা ওল্টানোর আওয়াজ না শোনা যায়। সংলাপ বলার সময় ‘চোরা দম’ কেমন করে নিতে হয়। শুধু কণ্ঠস্বর দিয়ে রাগ, দুঃখ, ভালবাসা সমস্তই প্রকাশ করতে হয় কেমন করে। পরিস্থিতির প্রয়োজনে কেমন করে মাইক্রোফোন থেকে দূরে গিয়ে সংলাপ বলতে হয়। কাউকে শিক্ষা দেওয়াতে তাঁর কোনও ক্লান্তি ছিল না। কখনও ধমকাতেন, কখনও ভালবাসতেন, কেউ তাঁর মুখের ওপর কথা বলার সাহস দেখাতে পারতেন না।
বীরেন্দ্র চলচ্চিত্র জগতেও নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন। ১৯৪৩ সালে তিনি ‘স্বামীর ঘর’ নামে একটি ছবি পরিচালনা করেছিলেন। কয়েকটি ছবিতে চিত্রনাট্যও লিখেছিলেন, ‘মা অন্নপূর্ণা’ (১৯৫৪, পরিচালনা ‘হরি ভঞ্জ’), ‘সতীর দেহত্যাগ’ (১৯৫৪, পরিচালনা ‘মানু সেন’), ‘সাধক বামাক্ষ্যাপা’ (১৯৫৮, পরিচালনা ‘নারায়ণ ঘোষ’)। তাঁর নিজের লেখা দু’টি নাটক ‘ব্ল্যাক আউট’, ‘৪৯ নম্বর মেস’ও মঞ্চসফল হয়েছিল।
এত বর্ণময় ও ব্যস্ত কর্মজীবনের চাপে বাড়িতে সে ভাবে সময় দিতে পারতেন না বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যার কথায়, ‘‘তা নিয়ে মায়েরও কোনও দিন অভিযোগ ছিল না। আমরাও কিছু বলিনি। এমনও হয়েছে, রাত দুটোয় বাবা ফিরেছেন। পাড়ার ছেলেরা আবার এসে ধরে নিয়ে গেল ওঁকে। উনি না গেলে তাঁরা নাকি মার খাবে।’’ আর কথা দিয়ে কথার খেলাপ করার মানুষ তিনি ছিলেন না। খাওয়াদাওয়া নিয়েও তাঁর বিশেষ ফরমায়েশ ছিল না। তাঁর কন্যা ‘সুজাতা ভদ্র’র কথায়, ‘‘খাবারে ঝাল আর নুন কম বেশি হলে বাবা বুঝতেন। রাতে ঘন দুধ চাইতেন।’’ সাধারনতঃ অনুষ্ঠান বাড়িতে সব শেষেই আসতেন। তবে তাঁর সেজ মেয়ের বিয়েতে রাত দশটায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। তখনও বরযাত্রী আসেনি। এ দিকে, ‘সুজাতা ভদ্র’র কথায়, ‘‘বাবার চিন্তা, জমাদাররা অনেক ক্ষণ বসে আছে। ওদের খাইয়ে আগে বাড়ি পাঠিয়ে দাও!’’
যে স্মৃতিশক্তি ছিল তাঁর গর্ব, আশির দশকের প্রথম থেকেই তা লুপ্ত হওয়ার নানা উপসর্গ দেখা যেতে শুরু হয়েছিল। ‘রবীন্দ্র সদনে সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান’ হয়েছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পৌরোহিত্যে। সেখানে নিজের বক্তৃতায় সকলকে হতচকিত করে তিনি বলে উঠেছিলেন, ‘‘কে এই সঞ্জীব চাটুজ্জে, একে তো চিনি না।’’ কিছুক্ষণ পরে সংবর্ধনায় পাওয়া উপহার সামগ্রী যখন সঞ্জীববাবু মঞ্চেই তুলে দিয়েছিলেন বীরেন্দ্রর হাতে, তখন সঞ্জীববাবুর হাত ধরে তিনি আকুল কান্না কেঁদেছিলেন! তাঁর স্ত্রী মারা যাওয়ার মাস সাতেকের মধ্যে তাঁর শরীরের আরও অবনতি হয়েছিল। ‘সুজাতা ভদ্র’ পরে জানিয়েছিলেন, ‘‘তখন প্রায়ই বাবা বলতেন, তোমাদের মা অনেক দিন এই ঘরে আসেন না। এক দিন ওকে আসতে বলো।’’ বড় অভিমান ছিল তাঁর। মুখে কিছু বলতেন না। ‘আকাশবাণীর এমেরিটাস প্রোডিউসার’-এর মতো সম্মাননার পদ জোটেনি তাঁর। বলতে গেলে কিছুই মেলেনি, না কোনও ‘সরকারি খেতাব’, না ‘পদ্মশ্রী’, ‘পদ্মভূষণ’। পেয়েছিলেন কেবল গুচ্ছের চাদর আর উত্তরীয়! শেষে বুকভরা অভিমান নিয়েই ১৯৯১ সালে আজকের দিনেই পৃথিবীকে বিদায় জানিয়েছিলেন তিনি।
সত্যি! বেতার তাঁকে যদি বা ভোলে, বাঙালি তাঁকে আজও ভোলেনি। আজও মহালয়ার দিন ভেসে আসে ‘‘রূপং দেহি, ধনং দেহি, যশো দেহি …’’। রেডিওতে আজও তাঁর কণ্ঠ ভেসে আসে, কিন্তু মুখ দেখা যায় না … তিনি নাম নয়, চেহারা নয়, আস্ত একটা কণ্ঠ, তিনি দিগন্ত ছোঁওয়া আকাশ … তিনি ‘বেতার পুরুষ’, বাঙালির একান্ত আপন শ্রী বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র।
(তথ্যসূত্র:
১- কলকাতা বেতার, সম্পাদনা: ভবেশ দাশ ও প্রভাতকুমার দাস, পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র (২০১৫)।
২- বিরূপাক্ষ রচনা সমগ্র, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, লালমাটি প্রকাশনী (২০২০)।
৩- voice from the sky, article published in The Telegraph, dated 18th September 2015.)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত