মংপুতে একবার মৈত্রেয়ীদেবীকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘আমার জীবনে যতবার মৃত্যু এসেছে, যখন দেখেছি কোনও আশাই নেই, তখন আমি প্রাণপণে সমস্ত শক্তি একত্র করে মনে করেছি, ‘তোমাকে আমি ছেড়ে দিলাম, যাও তুমি তোমার নির্দিষ্ট পথে।’ …’’
‘‘ক্ষণে ক্ষণে মনে হয় যাত্রার সময় বুঝি এলো,
বিদায়দিনের ’পরে আবরণ ফেলো
অপ্রগলভ সূর্যাস্ত-আভার।
সময় যাবার
শান্ত হোক, স্তব্ধ হোক, স্মরণসভার সমারোহ
না রচুক শোকের সম্মোহ।
বনশ্রেণী প্রস্থানের দ্বারে
ধরণীর শান্তিমন্ত্র দিক মৌন পল্লবসম্ভারে।
নামিয়া আসুক ধীরে রাত্রির নিঃশব্দ আশীর্বাদ
সপ্তর্ষির জ্যোতির প্রসাদ।।’’
(উদয়ন। শান্তিনিকেতন ১৬ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪১)
রোগক্লিষ্ট জীর্ণদেহে, অবসন্ন মনে রবীন্দ্রনাথের এই কবিতা শুধুমাত্র বিশ্বকবির অসংখ্য কবিতার মধ্যেই আর একটি কবিতা মাত্র ধরে নেওয়াটা বোধহয় সমীচীন হবে না। বরং আসন্ন মৃত্যুর ধ্বনি শুনতে পাওয়া কবির ‘ডেথ উইশ’ বলে এই কবিতাটিকে চিহ্ণিত করলে মনে হয় না সে পাঠ ভুল হবে। আর ‘ডেথ উইশ’ বলে এই কবিতাটিকে ধরে নিলে ঐতিহাসিক শ্রী তপন রায়চৌধুরীর বিখ্যাত সেই ‘স্টেটমেন্ট’ – ‘‘বাইশে শ্রাবণ আমার কাছে শুধু জাতীয় শোকের দিন নয় জাতীয় গ্লানির দিনও হয়ে আছে’’ – সেটি কতটা মর্মান্তিক সত্যি তা অনুধাবন করতেও সাহায্য করবে।
মৃত্যুর পদধ্বনি রবীন্দ্রনাথ প্রথম শুনেছিলেন ছিয়াত্তর বছর বয়সে ১৯৩৭ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর। ‘এরিসিপেলেস’-এর জন্য প্রায় পঞ্চাশ ঘন্টা অচেতন অবস্থায় কাটে কবির। রবীন্দ্রনাথ নিজে গুরুত্ব না দিলেও স্যার নীলরতন সরকারের নেতৃত্বে একদল ডাক্তার শান্তিনিকেতনে এসে তাঁকে সাময়িক সুস্থ করে তোলেন। কিন্তু সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ হয়নি। কিছু দিন পর হেমন্তবালাদেবীকে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘‘কিছুকালের জন্য মৃত্যুদণ্ড এসে আমার ছুটির পাওনা পাকা করে গিয়েছে।’’
এরপরে কবির দরজায় মৃত্যু এসে দ্বিতীয়বার কড়া নাড়ল। শান্তিনিকেতন থেকে ১৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৪০ সালে পুত্রবধূ প্রতিমাদেবীর কাছে গিয়েছিলেন দার্জিলিং পাহাড়ের কালিম্পং-এ। সেখানেই ২৬শে সেপ্টেম্বর তারিখে, রাতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে সেবার তিনি কলকাতায় ফিরে এলেন ২৯শে সেপ্টেম্বর।
অসুস্থতা বেড়েই চলল। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় – সহ অন্যান্য ডাক্তারদের মত অপারেশন করাতে হবে। কবির নিজের তাতে মত নেই। কবি পুত্রবধূ শ্রীমতী প্রতিমাদেবী লিখছেন –
‘‘বাবামশায়ের মনে মনে তাঁর অবসানের একটি কাল্পনিক ছবি গড়ে উঠেছিল, সেই ভাবের কথাও তিনি বলতেন। যেমন করে ফুলপাতা খসে পড়ে, বৃদ্ধ গাছটি যেমন করে ধীরে ধীরে শুকিয়ে আসে, তিনি ভেবেছিলেন তেমনি করে একদিন প্রকৃতির কোলে ঝরে পড়বেন।’’
আবার মৈত্রেয়ী দেবীকে কবি বলেছিলেন —
‘‘অপারেশনের কথা শুনছো? দেখ, এ আমি একেবারেই চাই না। এসেছিলাম গোটা মানুষ যাবার সময় কি ছেঁড়াখোঁড়া হয়ে যাব!’’
কিন্তু শেষ পর্যন্ত কবির পছন্দের কবিরাজী চিকিৎসা, ডাক্তার স্যার নীলরতন সরকারের বারংবার দৃঢ় ‘না’ এর পরেও কবিকে অপারেশনের জন্য কলকাতায় নিয়ে আসাই মনস্থ করা হল।
শান্তিনিকেতন থেকে ২৫শে জুলাই ১৯৪১-এ কবির সেই ‘শেষযাত্রা’য় কিন্তু ব্যবস্থাপনার কোনও ত্রুটি রাখেননি শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক কর্তৃপক্ষ। শৈলজারঞ্জন মজুমদার ভোরবেলার বৈতালিকের আয়োজন করলেন। ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক-কর্মী-আশ্রমিকরা জড়ো হলেন উদয়ন বাড়ির সামনে, কবির সামনে পরিবেশন করলেন ‘এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার’। বীরভূমের তৎকালীন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড রাতারাতি সারাই করলেন আশ্রম থেকে বোলপুর স্টেশন আসার পথ। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের অধিকর্তা এন সি ঘোষ কবির জন্য ব্যবস্থা করলেন বিশেষ সেলুনকারের। বিশ্বভারতী নিউজ/ ভলুম ১০/ জুলাই ১৯৪১-এ শ্রী অনিল চন্দের লেখা ‘দ্য লাস্ট টেন মান্থস’ প্রবন্ধে পাওয়া যায়, যখন আশ্রমের বাসে বিশেষ স্ট্রেচারে কবিকে তুলে দেওয়া হচ্ছে তখন উদয়নের সামনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে সকলে, অপার নিস্তব্ধতা, মৌন শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। বাস যখন চলতে শুরু করেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহস্রকণ্ঠে আশ্রমসঙ্গীত – ‘আমাদের শান্তিনিকেতন’। সেই গান পৌঁছয় কবির কানেও, জলের ধারা নামে তাঁরও চোখে।
শ্রী প্রশান্তচন্দ্র মহলানোবিশের স্ত্রী, শ্রীমতী নির্মলকুমারীর বর্ণনায় পাওয়া যায় – রাস্তার দুধারে এখানে সেখানে গ্রামের লোকেরা হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে ছিলেন, কবির গাড়ি তাদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় নীরবে জোড়হাত দু’খানা কপালে ঠেকিয়ে বিদায় অভিনন্দন জানাতে, কোনওরকম চিৎকার নয়, জয়ধ্বনি নয়, একেবারে স্তব্ধ গম্ভীর শ্রদ্ধা নিবেদন।
রবীন্দ্রনাথের সেলুনকার জুড়ে দেওয়া হয়েছিল পাকুড় প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে। জনস্রোতের বিভ্রাট এড়ানোর জন্য গোপন রাখা হয়েছিল তাঁর কলকাতা আসার দিন। এমনকি শেষ মুহূর্তে পাকুড় প্যাসেঞ্জারের নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মও পরিবর্তন করা হয় সেই কারণেই।
রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর অনিল চন্দ আগের দিন চলে গিয়েছিলেন কলকাতায়, ব্যবস্থাদির জন্য। নিউ থিয়েটার্স-এর বাস ব্যবস্থা করা ছিল। কেউ খবর পায়নি, কাজেই স্টেশনে কোনও ভিড় নেই। শান্তিনিকেতন আশ্রমিক কর্তৃপক্ষের নিখুঁত পরিকল্পনায় বিনা বিভ্রাটে সেই বাসে স্ট্রেচারে করে কবিকে এনে তোলা সম্ভব হল জোড়াসাঁকোর মহর্ষিভবনের দোতলায় পাথরের ঘরে। এর পরবর্তী তেরোদিনের গল্প বহুচর্চিত।
৩০শে জুলাই ডাঃ ললিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে কবির অপারেশন, যে ললিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের শর্ত ছিল, তাঁর নাম প্রকাশ করা যাবে না, এমনকী কবে এবং কী অপারেশন তাও প্রকাশ করা যাবে না। সেই ললিত বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি বলেছিলেন –
‘‘অনিল, কাল যেন কাগজে নাম না দেখি আমার, ললিত বাঁড়ুজ্যে নামের কাঙাল নয়।’’
তাঁর ‘নাম-যশ’-এই কবির অনিচ্ছার অপারেশন এবং ধীরে ধীরে তাঁর অবস্থার অবনতি। ৫ই আগস্ট স্যার নীলরতন সরকার কবিকে দেখতে এসে যাওয়ার সময় একবার ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকিয়েছিলেন অচেতন কবির দিকে। তিনি বুঝেছিলেন, তাঁর অমতে এই অপারেশন ঠিক হয়নি। ৭ই আগস্ট, ২২শে শ্রাবণ শেষবারের মতো কবিকে দেখে গেলেন শ্রী বিধান চন্দ্র রায় ও ললিত বন্দ্যোপাধ্যায় – দুই ‘পরাজিত’ চিকিৎসক। কবিও চলে গেলেন ‘কে যায় অমৃতধাম যাত্রী’ গানের মধ্যে দিয়ে, দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে। কিন্তু একটা প্রশ্ন বোধহয় রেখে দিয়ে গেলেন। জোড়াসাঁকোর মহর্ষিভবনের পাথরের ঘরের পূবদিকের বারান্দাকে যদি অপারেশন থিয়েটার বানানো যায় তাহলে শান্তিনিকেতনে কবির বাসভবনে সেই অপারেশন থিয়েটার বানানোয় বাধা কোথায় ছিল?!
রবীন্দ্রনাথের অন্তিমমুহূর্তে নানা ঘটনা পরম্পরার মধ্যে একটি বিশেষ ঘটনা কৌতূহলী পাঠককে একটা বড় প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। কবির অত্যন্ত স্নেহভাজন এবং পরম আস্থাভাজন শ্রীমতী নির্মলকুমারী মহলানবিশকে কবি নিজেই তাঁর মৃত্যুপরবর্তী কিছু ইচ্ছে প্রকাশ করে গিয়েছিলেন। নির্মলকুমারী লিখছেন –
‘‘একটু পরে কে যেন এসে বলল, দিলীপ রায় আপনাকে একবার ডাকছেন। আমি বললাম, তাঁকে বল পরে দেখা করবো। আবার খানিক পরে আর একজন এসে বলল, চা খেতে আসুন। বললাম চা খাই না। কেন এই বারে বারে ব্যাঘাত? কতটুকু সময়ই বা বাকি আছে?
আর খানিক পরে খবর এল, বরানগর থেকে ফোন এসেছে, আপনাকে বাড়ি যেতে বলছে খুব তাড়াতাড়ি। এইবার প্রাণ চমকে উঠলো। মাঝরাত্রে যখন চলে এসেছি তখন জ্বর ব্যথা, সবই বেশী দেখে এসেছিলাম। তার উপরে কবির জন্য ওঁর (প্রশান্ত মহলানবীশ) মনের উদ্বেগ। না জানি এতক্ষণে কী হয়ে গেল! জিজ্ঞাসা করলাম, কে ফোন ধরেছিল এবং কে ফোন করল? শুনলাম শ্রীযুক্ত সজনীকান্ত দাস শেষরাত্রি থেকে টেলিফোনের ভার নিয়েছেন এবং তিনিই এই খবর আমাকে পাঠিয়েছেন। অনুরোধ করে পাঠালাম তিনি যদি আমাদের বাসায় বেলঘরিয়ায় গুপ্তনিবাসে ফোন করে খবর নেন, কেন আমার ডাক পড়েছে এবং কে ফোন করেছিল তাহলে বড় ভালো হয়।
খবর এল যে লাইন পাওয়া যাচ্ছে না এবং আগের বারে কে ফোন করেছিল জানা নেই, কারণ নাম না বলেই সে টেলিফোন কেটে দিয়েছে।’’
শ্রীমতী নির্মলকুমারী গাড়ি নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়লেন বেলঘরিয়া এবং জানলেন ফোনের খবর মিথ্যে। আবার সাড়ে পাঁচ মাইল রাস্তা পেরিয়ে ফিরলেন জোড়াসাঁকো ।
জোড়াসাঁকোর আঙিনাতে নেমে নির্মলকুমারী দেখেন জনসমুদ্র পার হয়ে ওপরে যাওয়া অসম্ভব। ও-বাড়ির অন্যান্য অংশও চিনতেন বলেই অন্য রাস্তায় ওপরে উঠতে পেরেছিলেন। ঘরের ভিতর পৌঁছবার কয়েক সেকেন্ড আগেই শেষনিঃশ্বাস থেমে গেছে।
এরপরে শ্রীমতী নির্মলকুমারীর ভগ্নচিত্ত আত্মকথন …
‘‘ভাগ্যের এ কী নিদারুণ চক্রান্ত। তাঁর কাছে যে সত্য করেছিলাম এত প্রাণপণ চেষ্টা করেও তা পালন করতে পারলাম না। আমার কথার উপর তাঁর খুব বিশ্বাস ছিল, সেইজন্যেই এটা বারেবারে মনে খোঁচা দিচ্ছে।
আজ কোথায় গেল তাঁর বিশ্বাস? অমিতা আমাকে বলল – ‘আর একটু আগে এসেও যদি আপনি পৌঁছতে পারতেন! ঠিক শেষ মুহূর্তের আগে ডান হাতখানা কাঁপতে কাঁপতে উপরে তুলে কপালে ঠেকাতেই ডান হাত পড়ে গেল।’’
রবীন্দ্রনাথের অন্তিমমুহূর্তে নির্মলকুমারীকে জোড়াসাঁকো থেকে কে সরিয়ে দিলেন? কেন সরিয়ে দিলেন? নির্মলকুমারী লিখছেন শেষরাত্রি থেকে টেলিফোনের ভার নিয়েছিলেন শ্রীযুক্ত সজনীকান্ত দাস। ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত দাস আরও একটা গুরুভার নিয়েছিলেন।
শনিবারের চিঠি, ১৩শ বর্ষ, ১১শ সংখ্যা, ভাদ্র ১৩৪৮ সালের সংবাদ-সাহিত্য শিরোনামে তাঁর নিজের লেখা সম্পাদকীয়তে নস্যাৎ করেছিলেন সেই ২২শে শ্রাবণের দিনের নানা ঘটনা (পরবর্তীতে যাকে অনেকে ন্যক্কারজনক বলেছেন), পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক শ্রী তপন রায়চৌধুরী যাকে অভিহিত করেছিলেন ‘জাতীয় গ্লানির দিন’ হিসেবে।
সজনীকান্ত দাস লিখেছিলেন –
‘‘গত ২২এ শ্রাবণ বৃহস্পতিবার ইংরেজী ৭ই আগস্ট বেলা ১২টা ১৩ মিনিটের সময় ঝুলন-পূর্ণিমার ঠিক সমাপ্তিমূলে বাংলার রবি অস্তমিত হইয়াছেন। মৃত্যুকালে তাঁহার বয়স আশি বৎসর তিনমাস পূর্ণ হইতে দুই দিন বাকি ছিল।
এই প্রসঙ্গে ইহার অধিক লিখিবার প্রয়োজন ছিলো না, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু ও শেষকৃত্য সম্বন্ধে বহু শিক্ষিত বাঙালীর মুখে মুখে এবং দুই একটি সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় স্তম্ভে বহু লজ্জা ও গ্লানিকর সংবাদ প্রচারিত হইতেছে। রবীন্দ্রনাথের শবদেহ লইয়া বহুবিধ অনাচার ও তাণ্ডবের কথাও শুনিতেছি। অনেকে ইহার মধ্যে কোনও কোনও ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের গোপন মতলব চরিতার্থ হইতে দেখিয়াছেন, এবং কেহ কেহ কবির মৃত্যুতে বাংলা দেশের শোককাতর অধীর জনতার পৈশাচিক মনোবৃত্তি লক্ষ্য করিয়া পীড়িত হইয়াছেন। আমরা প্রত্যক্ষ জ্ঞান হইতে বলিতেছি যে এরূপ কিছুই ঘটে নাই, – জীবিত বা মৃত রবীন্দ্রনাথের প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের চেষ্টাও কুত্রাপি পরিলক্ষিত হয় নাই; যাহা রটিয়াছে তাহা মিথ্যা অথবা ভ্রান্তিপ্রসূত।’’
প্রথমতঃ, সজনীকান্ত দাসের সম্পাদকীয়টি প্রথম পাঠেই পাঠকের মনে হবে যে তাঁর এই ‘গুরুভার’ পালনে কিঞ্চিৎ তাড়া ছিল। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর সময় বেলা ১২টা ১৩ নয়, বেলা ১২টা ১০ মিনিট। সমস্ত প্রামাণ্য সূত্র তাই বলছে।
দ্বিতীয়তঃ, এই ‘মিথ্যা এবং ভ্রান্তিপ্রসূত’ ঘটনার বিপরীত বিবরণ পাওয়া যায় শ্রীমতী নির্মলকুমারীর লেখা থেকেই।
‘‘একটু পরে সেবকসেবিকা ছাড়া আর সবাইকে ঘর থেকে চলে যেতে বলা হল। গুরুদেবকে স্নান করানো, সাজিয়ে দেবার কাজ এখনও যে বাকি আছে – সেবা তো সমাপ্ত হয় নি। মেয়েদের মধ্যে ঘরে শুধু আমি, বুড়ী আর অমিতা; আর ছেলেদের মধ্যে সুরেনবাবু, বিশু এবং আরো অনেকে।
যখন স্নান করানো হচ্ছে, নিচের জনতার মধ্যে একদল উপরে এসে বাইরে থেকে টান মেরে দরজার ছিটকিনি খুলে ঘরে ঢুকে পড়ল। কী দারুণ অপমান কবির চৈতন্যহারা এই দেহটার!
যে মানুষের মন এত স্পর্শকাতর ছিল, যে মানুষ বাইরের লোকের সামনে নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজনের কথা কখনও প্রকাশ করতে পারতেন না, সেই মানুষের আত্মাহীন দেহখানা অসহায় ভাবে জনতার কৌতূহলী দৃষ্টির সামনে পড়ে রইল। তাড়াতাড়ি তাঁকে ঢাকা দিয়ে সুরেনবাবুরা সবাইকে ঠেলে বাইরে বের করে দিয়ে আবার দরজা বন্ধ করলেন। এক-একটা দরজায় এক-একজন পাহারা। ভিতর থেকে দরজায় ছিটকিনি সত্ত্বেও হাত দিয়ে ঠেলে ধরে রাখা হয়েছে। তবু বাইরে থেকে প্রাণপণ ঝাঁকানি আর উন্মত্ত চিৎকার – দরজা খুলে দিন, আমরা দেখব।
তাড়াতাড়ি করে আমরা কাপড় পরানো শেষ করলাম। … বেলা তিনটের সময় একদল অচেনা লোক ঘরের মধ্যে ঢুকে নিমেষে আমাদের সামনে থেকে সেই বরবেশে সজ্জিত দেহ তুলে নিয়ে চলে গেল। যেখানে বসেছিলাম সেখানে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। শুধু কানে আসতে লাগলো- ‘জয় বিশ্বকবির জয়, জয় রবীন্দ্রনাথের জয়। বন্দেমাতরম।’ …’’
শ্রী সজনীকান্ত দাস অভিহিত ‘মিথ্যা এবং ভ্রান্তিপ্রসূত’ ঘটনার অন্য একটি বিবরণ পাওয়া যায় ঐতিহাসিক শ্রী তপন রায়চৌধুরীর জীবনী থেকে,
‘‘১৯৪১ অগাস্ট মাসে তপন রায়চৌধুরী মোয়াট সাহেবের ক্লাস করছেন। হঠাৎ বাইরে একটা গোলমাল শোনা গেল। মোয়াট সাহেব তপনবাবুকে বললেন দেখে আসতে কী ব্যপার। জানা গেল একটু আগে রবীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছেন। কথাটা এসে ক্লাসে বলতেই প্রচণ্ড একটা হইচই শুরু হল। তপন রায়চৌধুরীর লিখেছেন মোয়াট সাহেবের চোখে সেই গভীর ব্যঙ্গের দৃষ্টিটা তিনি কোনওদিন ভুলতে পারবেন না কারণ সাহেবের চোখে ভারতবাসীরা যে বর্বর, তাদের দেশের শ্রেষ্ঠ মানুষটির প্রয়াণে শোকপ্রকাশের ভঙ্গী দেখে সে বিষয়ে মোয়াট সাহেব নিঃসন্দেহ হয়েছিলেন তা বোঝা গেছিল তাঁর সে ব্যঙ্গের দৃষ্টিতে।’’
রবীন্দ্রনাথের মৃতদেহ থেকে উন্মত্ত জনতা নাকি স্মারক হিসেবে কবির চুল–দাড়ি ছিঁড়ে নিয়েছিল! ঐতিহাসিক শ্রী তপন রায়চৌধুরীর প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ প্রামাণ্য ধরে নেওয়া যেতে পারে এবং এক্ষেত্রে সে বর্ণনা তাঁর নিজস্ব ভাষায় তুলে না দিলে ইতিহাসের প্রতি অবিচার করার সম্ভাবনা থাকে –
‘‘নিঃসন্দেহ আমিও কিছুটা হলাম – শম্ভুর সঙ্গে জোড়াসাঁকো গিয়ে। এমন দ্বিধাহীন বর্বরতার দৃশ্য দেখতে হবে কখনও ভাবিনি। প্রচণ্ড চেঁচামেচি ঠেলাঠেলি চলছিল। জনতার চাপে ঠাকুরবাড়ির লোহার গেট ভেঙে গেল। মানুষের ভিড় এত বেশি যে আমাদের পা প্রকৃতপক্ষে মাটি ছুঁচ্ছিল না। এরই মধ্যে হঠাৎ প্রচণ্ড বেগে মানুষের মাথায় মাথায় খাটের ওপর শোয়ানো ওঁর দেহ বেরিয়ে এল। আর অনেক লোক ওর চুল–দাড়ি ছিঁড়ে নিচ্ছিল। কবির দেবদেহ শুধু মুহূর্তের জন্য দেখতে পেলাম। বাইশে শ্রাবণ আমার কাছে শুধু জাতীয় শোকের দিন নয়, জাতীয় গ্লানির দিনও হয়ে আছে। এই বর্বরতার নায়করা যতদূর দেখতে পেলাম তথাকথিত ভদ্র বাঙালি ছাড়া কেউ নয়।’’
এ প্রসঙ্গে শ্রী প্রমথ চৌধুরীর মন্তব্যটি কবির অন্তিমযাত্রায় জোঁড়াসাকোর ব্যর্থতার দিকটি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে –
‘‘তাঁর মৃত্যুতে শহরের জনগণ যে বিক্ষুব্ধ ও উদভ্রান্ত হয়েছে, তার প্রমাণ তাঁর শবযাত্রায় বিরাট ও বিশৃঙ্খল জনতার যোগদান। আমি বিশৃঙ্খল বলছি এই কারণে – এ শবযাত্রা কেউ organise করেনি।’’
কবির অন্তিমযাত্রার প্রায় অনুরূপ বিশৃঙ্খলতার বিবরণ পাওয়া যায় শ্রী অমল হোম সম্পাদিত ‘দা ক্যালকাটা মিউনিসিপাল গেজেট: টেগোর মেমোরিয়াল স্পেশাল সাপ্লিমেন্ট’, ১৯৪১ সঙ্কলনেও।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর কয়েকদিনের মাথায় প্রকাশিত শনিবারের চিঠিতে সজনীকান্তের লেখার ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পেয়েছে অসংযমী ক্রোধ, তীব্র শ্লেষ, ব্যক্তি এবং ধর্মকেন্দ্রিক আক্রমণ এবং সর্বোপরি তথ্য বিকৃতি। শ্রীমতী নির্মলকুমারী রবীন্দ্রনাথের যে শববাহকদের বর্ণনা করছেন ‘একদল অচেনা লোক’ বলে, আর শ্রী সজনীকান্ত তাঁদেরই সম্বন্ধেই লিখেছিলেন –
‘‘শবযাত্রায় আত্মীয়পর সমাজ বা সভার কোনও প্রাধান্য ছিল না; কোনও বাছাই করা দলের পক্ষেই তাঁহার শবদেহ উত্তোলন বা বহন করা সম্ভব হয় নাই; … বস্তুত বলা যায় সমগ্র বাংলাদেশ সেদিন রবীন্দ্রনাথের শবদেহ বহন করিয়াছিল – ঠাকুরবাড়ি, শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতী বা ব্রাহ্মসমাজের কোনও দাবি টেকে নাই, টিকিতে পারে না; জীবনে যাঁহারা তাঁহার সর্বাপেক্ষা অন্তরঙ্গ ছিলেন, সেদিন ভিড়ের মধ্যে তাঁহারাও স্থান সংগ্রহ করিতে পারেন নাই। ইহা আনন্দের কথা, ইহাতে কাহারও অভিমান হওয়া উচিত নয়। … এই জনতার কাছে এক রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত অপর কোনও ব্যক্তির বা প্রতিষ্ঠানের কোনও বৈশিষ্ট বা প্রাধান্য সেদিন ছিল না; মৌলভী ফজলল হক, স্যার সর্ব্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র বসু প্রভৃতি প্রধানেরা সকলেই সাড়ে বত্রিশ ভাজার মত জনতার মধ্যে মিশাইয়া গিয়াছিলেন।’’
রবীন্দ্রনাথের মৃতদেহের লাঞ্ছনা সম্বন্ধে শ্রী সজনীকান্তের বক্তব্য –
‘‘কি কারণে জানি না, একদল লোক রটাইয়া বেড়াইতেছেন যে, শ্মশানে রবীন্দ্রনাথ নানা ভাবে লাঞ্ছিত হইয়াছে। … এত বীভৎস কুৎসিত মিথ্যা যে মানুষ সজ্ঞানে রটনা করতে পারে, ইহা ভাবাও কঠিন; মানুষের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধার এমন জঘন্য অর্থ পাষন্ডদের পক্ষেই করা সম্ভব … দুই একজন নিতান্ত অনিচ্ছায় হুমড়ি খাইয়া পড়িয়া শবাধার স্পর্শ করিয়া থাকিবে – এই অনিচ্ছাকৃত অপরাধকে তাঁহাড়া চুল-দাড়ি ছেঁড়া বলিয়া আসর জমাইতেছেন, পদদলন করা বলিতেছেন, তাঁহাদিগকে কি বলিব!’’
অথচ অ্যান্ড্রু রবিনসন – সহ আরও অনেকে পরবর্তীকালে উল্লেখ করেছেন, কর্দমাক্ত প্রায়ান্ধকার শ্মশানে কবির দেহ শুইয়ে রাখা হয়, এবং উচ্ছৃঙ্খল লোকজনের হাতে লাঞ্ছিত হয় নানাভাবে। চুল-দাড়ি ছেঁড়া তো ছিলই, মৃতদেহ পদদলিত বা চিতা নির্বাপনের সময় অর্ধদগ্ধ অস্থি সংগ্রহের জন্য জনতা পাগল হয়ে উঠেছিল এর উল্লেখও পাওয়া যায়।
কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের দ্বারা কবির শেষকৃত্য সম্পাদিত না হওয়ার পেছনে শ্রী সজনীকান্তের যুক্তি –
‘‘শবযাত্রার বহু পূর্ব্বেই নির্দ্ধারিত হইয়াছিল যে, এই অবস্থায় শেষকৃত্য করিবার জন্য তাঁহাকে শ্মশানে লইয়া যাওয়া সঙ্গত হইবে না; … রথীন্দ্রনাথ ভীড়ের মধ্যে পথ পান নাই বলিয়া শেষকৃত্য সম্পাদন করিতে পারেন নাই, ইহা সর্ব্বৈব মিথ্যা।’’
অথচ শ্রীমতী রানী চন্দ লিখছেন –
‘‘এক সময়ে আমার স্বামী এসে দাঁড়ালেন কাছে, ধীরে ধীরে বললেন, গুরুদেব ঘাটে পৌঁছে গেছেন। খবর এসেছে। রথীদা যাচ্ছেন। ‘মুখাগ্নি’ কথাটা উচ্চারণ করতে আর পারলেন না। বললেন, আমি যাচ্ছি – তুমিও চলো।
উঠে দাঁড়ালাম। একটা মোটরে, বাড়ির মোটরই হবে, রথীদার সঙ্গে আমরাও উঠলাম। ডাক্তার রাম অধিকারীও আছেন সঙ্গে। … ভিড়ের চাপে মোটর চলে না – আমরা নেমে পড়লাম। নিশ্ছিদ্র ভিড় নিমতলা ঘাটের পথে। রাম অধিকারী মশায় দু হাতে রথীদাকে আগলে ধরে ভিড় ঠেলে এগোবার চেষ্টা করতে লাগলেন। – রাম অধিকারী মশায়ের দেহে যেমন গলায়ও তেমনি জোর। তিনি চীৎকার করে ভিড়ের উদ্দেশে বলতে লাগলেন, আপনারা একটু পথ ছেড়ে দিন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের পুত্র রথীন্দ্রনাথ এসেছেন পিতার কাজ করতে – আপনারা একটু পথ দিন। রাম অধিকারী যতই চেঁচাচ্ছেন ভিড় ততই চঞ্চল হয়ে উঠছে – কোথায় রবীন্দ্রনাথের পুত্র – তাঁকে দেখবে তারা। মুহূর্তে ভিড়ে যেন উত্তাল তরঙ্গ জাগল। আর উপায় নেই ঘাটে যাবার। রথীদা শোকে অসুখে কাহিল ছিলেন, এবারে যেন সম্বিৎ হারিয়ে পড়ে যাবার মতো অবস্থা হল। রাম অধিকারী রথীদাকে জাপটে ধরে বিপরীতমুখী এগিয়ে মোটরে তুললেন। আমরাও উঠলাম। জোড়াসাঁকোয় ফিরে এলাম। পরে শুনলাম বীরেনদা সুবীরবাবুকে নিয়ে গঙ্গাপথে গেলেন ঘাটে। শেষ কাজ যা করবার বংশের পৌত্র সুবীরবাবুই করলেন। রথীদা খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লেন।’’
সুবীরেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়ে কবির শেষকৃত্য নিয়েও শ্লেষাঘাত করতে ছাড়েননি শ্রী সজনীকান্ত –
‘‘রবীন্দ্রনাথের শেষকৃত্য আদি ব্রাহ্মসমাজ মতে সম্পন্ন হইয়াছিল, এই মত হিন্দুমতের প্রায় অনুরূপ; মুখাগ্নি, চিতাভস্মে কলসী করিয়া জল নিক্ষেপ, গঙ্গাজলে অস্থিবিসর্জন সকলই হইয়াছিল, সুবীর ঠাকুরের পৈতাগাছও গোপনে ছিল না; জনতা হরিবোল-ধ্বনিও করিয়াছিল। ইহাতে কি প্রমাণিত হয়, অধিকারীদের অনিচ্ছাক্রমে হিন্দুমতে তাঁহাকে দাহ করা হইয়াছে? … শ্মশানে হরির নামেও আপত্তি হইবার কথা নয় – …’’
শ্রী সজনীকান্ত দাস ‘জীবনস্মৃতি’ পড়েননি একথা বিশ্বাস করা কঠিন। হিমালয় ফেরত মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের দ্বারা পুত্রদের উপনয়ন দান, উপবীত ধারণ যে ব্রাহ্মধর্মেরই অঙ্গ তা তাঁর জানার কথা। কাজেই ‘সুবীর ঠাকুরের পৈতেগাছ’ উল্লেখ করে হরিবোল ধ্বনিকে বৈধতা দেওয়ার প্রচেষ্টার কারণ প্রশ্নাতীত নয়।
রবীন্দ্রনাথ কী চেয়েছিলেন? ৩০শে জুলাই ১৯৪১, রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষ তিনটি পংক্তি রচনা করেন –
‘‘অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।’’
এই নিবন্ধের শুরুতে যে কবিতাটিকে ‘ডেথ উইশ’ বলে চিহ্নিত করে পাঠের অনুরোধ ছিল সেখানেও সেই নিতান্তই শান্তিটুকুরই প্রার্থনা … ‘‘ধরণীর শান্তি মন্ত্র দিক মৌন পল্লব সম্ভারে’’।
‘জোড়াসাঁকো রবীন্দ্রনাথকে সেই শান্তিটুকু দিতে চূড়ান্ত ভাবে ব্যর্থ হয়েছে’ বলে যে কথা একাংশে প্রচারিত, তা সত্য না অতিকথন সে বিচারের দায়িত্ব পাঠকের হাতেই থাক।
৮ই আগস্ট, ১৯৪১। আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয় –
‘‘কবির বর্তমান অসুস্থতার বহুপূর্বে কবি নাকি এইরূপ ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন যে তাঁহার অন্তেষ্টিক্রিয়া যেন তাঁহার প্রিয় আবাস শান্তিনিকেতনে সম্পন্ন করা হয়।’’
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছের ও প্রিয় মানুষদেরও একই কথা বলেছিলেন। সে সব কথা তাঁরা কেউ কেউ লিখেও গেছেন। পাঠক সে কথা জানেন, কিন্তু এই লেখাটির জন্য আরও একবার উল্লেখ অবশ্যই পুনরাবৃত্তি হবে না।
কবি নাকি তাঁদের বারবার বলেছিলেন, যদি আমার সত্যি বন্ধু হও তাহলে দেখো আমার যেন কলকাতার উন্মত্ত কোলাহলের মধ্যে, ‘জয় বিশ্বকবি কি জয়, জয় রবীন্দ্রনাথের জয়, বন্দেমাতরম’ – এইরকম জয়ধ্বনির মধ্যে সমাপ্তি না ঘটে। আমি যেতে চাই শান্তিনিকেতনের উদার মাঠের মধ্যে উন্মুক্ত আকাশের তলায়, আমার ছেলেমেয়েদের মাঝখানে। সেখানে জয়ধ্বনি থাকবে না, উন্মত্ততা থাকবে না। থাকবে শান্ত–স্তব্ধ প্রকৃতির সমাবেশ। প্রকৃতিতে, মানুষে মিলে দেবে আমাকে শান্তির পাথেয়। আমার দেহ শান্তিনিকেতনের মাটিতে মিশিয়ে যাবে – এই আমার আকাঙ্ক্ষা। চিরকাল জপ করেছি ‘শান্তম্’। এখান থেকে বিদায় নেওয়ার আগে যেন সেই ‘শান্তম্’ মন্ত্রই সার্থক হয়। কলকাতার উন্মত্ত কোলাহল, জয়ধ্বনির কথা মনে করলে আমার মরতে ইচ্ছে করে না।
রবীন্দ্রনাথের শেষ ইচ্ছে, ‘শান্তির অক্ষয় অধিকার’টুকু নিশ্চিত করা যায়নি। পালন করা যায়নি তাঁর দেহ শান্তিনিকেতনের মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা। কারা দেয়নি, কাদের জন্য এই কাজে বাধা পড়েছিল সে কথা আর আলাদা করে উল্লেখের প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি না। কিন্তু শোকবিমূঢ়তা, অসহায়তার হতাশা কাটিয়েও সেই একই বাইশে শ্রাবণে সন্ধেবেলা আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন মন্দির পরিচালনা করেন আর সেই উপাসনায় প্রয়াত কবির অন্তত একটি ইচ্ছের মর্যাদা দিতে শান্তিনিকেতন ভোলেনি … কবির স্মরণসভায় গাওয়ার জন্য বেশ কিছুকাল আগে কবিরই রচিত গানটি পরিবেশিত হয় মন্দিরে –
‘‘সমুখে শান্তির পারাবার-ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।’’
নিমতলায় যখন চলছে রবীন্দ্রপ্রেমীদের ‘বল হরি বল’ চিৎকার, ঠিক একই সময় শান্তিনিকেতন দিতে পেরেছিল রবীন্দ্রনাথকে ‘শান্তির অক্ষয় অধিকার’। প্রকৃতিতে মানুষে মিলিয়ে কবিকে দিয়েছিল তাঁর কাঙ্ক্ষিত শান্তির পাথেয় … ঋক্মন্ত্রে মুখরিত হয়েছিল সেদিন শান্তিনিকেতনের আকাশ বাতাস –
‘‘মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ
মাধ্বীর্ণঃ সন্তোষধীঃ।
মধু নক্তম্ উতোষসো মধুমৎ পার্থিবং রজঃ।
মধুমান নো বনস্পতির্মধুমাম অস্তু সূর্যঃ।।’’
(তথ্যসূত্র:
১- গুরুদেব – রানী চন্দ।
২- বাইশে শ্রাবণ – নির্মলকুমারী মহলানবিশ।
৩- বাঙালনামা – তপন রায়চৌধুরী।
৪- নির্বাণ – প্রতিমা ঠাকুর।
৫- মংপুতে রবীন্দ্রনাথ – মৈত্রেয়ী দেবী।
৬- শনিবারের চিঠি, ১৩শ বর্ষ, ১১শ সংখ্যা, ভাদ্র ১৩৪৮।
৭- সব হতে আপন – রানী চন্দ।
৮- স্বর্গের কাছাকাছি – মৈত্রেয়ী দেবী।
৯- হে মহামরণ – পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়।
১০- The Calcutta Municipal Gazette: Tagore Memorial Special Supplement, 1941।
১১- The Last Ten Months – Anil Kumar Chanda, Visva Bharati News/ vol.10/ July 1941।
১২- আজকাল পত্রিকা, রবিবাসরীয়, ৬ই মে ২০১৮ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত