জানবাজার রাজবাড়ীর ইতিহাস শুরু শ্রী প্রীতরাম দাসের হাত ধরে। পলাশী-যুদ্ধের চার বছর পূর্বে ১৭৫৩ খ্ৰীষ্টাব্দে, এক দরিদ্রের গৃহে প্রীতরাম দাস জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মাতা সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তাঁরা তিন ভাই ছিলেন। শ্রী প্রীতরাম দাস তাঁদের মধ্যে ছিলেন জ্যেষ্ঠ। বাল্যে গুরুমহাশয়ের পাঠশালায় সামান্য বাঙ্গলা ভাষা ও গণিত শিক্ষা করে ১৭৬৭ খ্ৰীষ্টাব্দে চোদ্দ বছর বয়সে, মাতৃপিতৃহীন প্রীতরাম, রামতনু ও কালীপ্রসাদ নামক দুই কনিষ্ঠ সহোদর সহ কলিকাতায় জানবাজারের তদানীন্তন বিখ্যাত জমিদার মান্নাবাবুদিগের পুরস্ত্রী, তাঁর পিতৃস্বসার (শ্বশুর) আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন এবং অল্প ইংরাজি ভাষা শিখে দালালী ও ফোর্ট উইলিয়ম দূর্গে ইংরেজ সৈন্যদের রসদ যোগানের কাজ করতে শুরু করেন। এই সূত্রে ফোর্টের জনৈক পদস্থ ইংরেজ কর্মচারীদের সাথে বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে প্রীতরাম তাঁদের সঙ্গে ঢাকায় যাত্রা করেন। সেখানে উক্ত ইংরেজের সাহায্যে, নাটোর রাজসরকারে এক বিশিষ্ট কর্মচারীর পদে নিযুক্ত হন। ১৭৭৭ খৃষ্টাব্দে চব্বিশ বছর বয়সে, প্রীতরাম সঞ্চিত অর্থসহ নাটোর থেকে কলকাতায় প্রত্যাগমন করে, আশ্রয়দাতা মান্না-পরিবারের, যুগলমান্নার একাদশ বর্ষীয়া কন্যার পাণিগ্রহণ করেন। এই বিয়ের ফল স্বরূপ তিনি জানবাজারের কয়েকখানি বাড়ী ও ষোল বিঘা জমি যৌতুক রূপে লাভ করেন। এই বিবাহের ফলস্বরূপ ১৭৭৯ খ্ৰীষ্টাব্দে তাঁর প্রথম পুত্র হরচন্দ্র এবং ১৭৮৩ খ্ৰীষ্টাব্দে দ্বিতীয় পুত্র রাজচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন।
কলিকাতায় এসে, প্রীতরাম আমদানী ও রপ্তানীর কার্য্য করতেন। পরে ১৭৮৭ খ্ৰীষ্টাব্দে “বর্ন কোম্পানী” নামক তদানীন্তন ইংরেজ-বণিকদলের তদানীন্তন ইংরেজ-বণিকদলের মুৎসুদ্দি পদে নিযুক্ত হন। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে, নাটোর রাজের অধিকারস্থ কয়েকটি পরগণা লাটে উঠলে, দেওয়ান শ্রী শিবরাম সন্যালের সাহায্যে, প্রীতরাম উনিশ হাজার টাকায়, মকিমপুর পরগণা ক্রয় করে নেন। কনিষ্ঠ সহোদর কালীপ্রসাদ নবক্রীত পরগণার নায়েবী কাৰ্য্যভার গ্রহণ করে সেই জমীদারী থেকে কলকাতার বাড়িতে বাঁশ, কাঠ, মাছ প্রভৃতি চালান দিতে লাগিলেন। প্রীতিরাম ঐ সকল পণ্য বিক্রয়ের জন্য, বেলেঘাটায় একটি আড়ত স্থাপন করেন। সেকালে অনেকগুলি বাঁশ একত্রে বেঁধে নদীতে ভাসিয়ে আনা হত। একে চলিত কথায় “বাঁশের মাড়” বলে, বাঁশের ব্যবসায়ী প্রীতরাম এইরূপে “মাড়” নামক ব্যবসায়গত উপাধি লাভ করেন। এই সময়েই বেলেঘাটায় একটি লবণের আড়ত স্থাপিত হয়।
প্রীতরাম, তাঁর পুত্রদ্বয়কে তৎকালসুলভ শিক্ষা প্রদান করে, তাঁদের বিবাহ দিয়েছিলেন। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে, কনিষ্ঠ পুত্র রাজচন্দ্রের প্রথম বিবাহ ও সেই বৎসরেই স্ত্রীবিয়োগ হলে, প্রীতিরাম পরের বছর (১৮০২ খ্রিস্টাব্দ) পুত্রের পুনরায় বিবাহ দেন। কিন্তু সেই স্ত্রীও বিবাহবৎসরেই গতায়ু হন। ঐ বৎসরেই (১৮০২ খ্রিস্টাব্দে) জ্যেষ্ঠপুত্র হরচন্দ্র একমাত্র বিধবা স্ত্রী রেখে নিঃসন্তান অবস্থায় পরলোক গমন করেন। ১৮০৩ প্রীতরাম, কনিষ্ঠ পুত্র রাজচন্দ্রের তৃতীয়বার বিবাহ দেন। রাজকরে এই সহধৰ্ম্মিণী, উত্তরকালবিখ্যাত রাণী রাসমণি। প্রীতরামের জীবদ্দশায় রাজচন্দ্র ও রাসমণির দুইটি কন্যা—পদ্মমণি ও কুমারী জন্মগ্রহণ করেন। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে প্রীতরাম, কলকাতার জানবাজারের বর্তমান সুবৃহৎ পারিবারিক আবাস নির্মাণ আরম্ভ করেন। বাড়িটি সম্পূর্ণ হতে ৭-৮ বছর সময় লেগেছিল। তৎকালীন প্রায় ছয়লক্ষ টাকা মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর যম্পত্তি রেখে ১৮১৭ খ্ৰীষ্টাব্দে চৌষটি বৎসর বয়সে, প্রীতরাম দাস পরলোক গমন করেন।
পিতার মৃত্যুর পরে জমিদারির দায়িত্ব নেন, বাবু রাজচন্দ্র দাস। প্রজা পালক ও দয়ালু জমিদার বলে তাঁর সুখ্যাতি ছিল। তৎকালীন ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি। ইংরেজি শিক্ষা করেছিলেন। তৎকালীন সমাজের অন্ধকারচ্ছন্ন (সতীদাহ প্রথা) দিকগুলোর ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। নারী শিক্ষার পক্ষে তাঁর মত ছিল। রাজা রামমোহন রায় ও প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের মতন ব্যক্তিদের সাথে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল বলে জানা যায়। জানা যায় যে, দু দুবার বিয়ে হয়েছিল তাঁর (১৮০১ এবং ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে)। কিন্তু স্ত্রী বিয়োগে সংসার ফাঁকা। পৈতৃক সম্পত্তি বিষয়-আশয়ে মন বসত না রাজচন্দ্রের। থাকতেন উদাসী হয়ে। একদিন নৌকায় যাচ্ছিলেন হালিশহর দিয়ে। গঙ্গার ঘাটে তখন স্নানের ভিড়। হঠাৎ চোখ আটকে গেল তরুণ রাজচন্দ্রের। বন্ধুদের সঙ্গে স্নান করছে‚ খেলছে এক বালিকা। রূপ যেন আলো করে আছে। তাকে দেখে নৌকায় মন উচাটন। আবার ঘর বসাতে ইচ্ছে হল। কিন্তু ঘর বংশ কিছুই জানা হয়নি বালিকার। লোক পাঠিয়ে খবর এল‚ বালিকার বাড়ি হালিশহরের কোণা গ্রামে। বাবা হরেকৃষ্ণ দাস সামান্য চাষি। জাতে মাহিষ্য। সামাজিক পরিচয়ে অবস্থানে বহু পিছিয়ে। কিন্তু তরুণ রাজচন্দ্র অনড়। বিয়ে করলে ওই মেয়েকেই করবেন। তখন কলকাতায় বইছে ব্রাহ্ম আন্দোলনের উদার বাতাস। স্বাদ পেয়েছেন রাজচন্দ্রও। জাতপাত নিয়ে ভাবতেই চাইলেন না। আদরের ছেলের আব্দার ফেলতে পারলেন না বাবা মা‘ও। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কলকাতার বিশাল বাড়িতে বৌ হয়ে এলেন মাহিষ্য বালিকা। আলতা পরা পা শুধু দাসবাড়িতেই পড়ল না। পড়ল কলকাতার পুরুষশাসিত সমাজেও। শাড়ি গয়নার পুঁটুলি ওই একরত্তির মধ্যে লুকিয়ে বসেছিলেন ভবিষ্যতের রানী রাসমণি। লোকমাতা রানী রাসমণি দাসী। রানী রাসমণি ও বাবু রাজচন্দ্র দাসের কোনও পুত্রসন্তান ছিল না। তাঁদের চারটি মেয়ে ছিল – পদ্মমণি, কুমারী, করুণাময়ী ও জগদম্বা।
১৮৩৬ সালের ৮ই জুন, ৫৩ বছর বয়সে বাবু রাজচন্দ্র দাস প্রয়াত হন। তাঁর মৃত্যুর খবর, তৎকালীন কলকাতার বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। যার বয়ান ছিল অনেকটা এইরকম (জাতীয় গ্রন্থাগারে পেপার কাটিং পেয়েছি, কিন্তু কাগজের নাম উদ্ধার করতে পারি নি)-
“স্বীয় দয়ালু স্বভাবপ্রযুক্ত যে বাবু রাজচন্দ্র দাস ইঙ্গরেজ বাঙ্গালির মধ্যে অতিক্ষুবিদিত ছিলেন তিনি ৮ তারিখে বেলা দশ ঘণ্টাসময়ে পক্ষঘাত রোগে আক্রমিত হইয়া ১৫ ঘণ্ট পরে পর দিবস পরলোক প্রাপ্ত হইয়াছেন ঐ বাবুর মরণে কেবল তাহার আত্মীয়বর্গের মহাশোক হইয়াছে এমত নহে তাহার মরণে সৰ্ব্বসাধারণের বিশেষতঃ এতদ্দেশীয় লোকের পক্ষেও নিতান্ত ক্ষতির বিষয় বটে বাবু রাজচন্দ্র দাস গঙ্গাতে দুইটা পাক ঘাট বন্ধন এবং এক রাস্তা ও রোগী লোকেরদের জীবনাবশেষ কালীন গঙ্গাতীরে বাসার্থ রাজ প্রাসাদতুল্য এক অট্টালিকা নিৰ্ম্মাণ করিয়াছেন এবং তিনি তত্ত ল্য দানশীল কোন আত্মীয় লোকের স্থানে ইহাও ব্যক্ত করিয়াছিলেন মনস্থ আছে আরো কোন মনোনীত স্মরণীয় চিহ্ন স্থাপন করিবেন র্তাহার আরো ইচ্ছা ছিল হিন্দুকালেজে কতক বিদ্যার্থির বেতন নিয়মিত করেন কিন্তু হায়২ এমত সময়ে কাল মৃত্যু আসিয়া তাহার সকল আশাই শেষ করিল মৃৎকালীন তাহাকৈ পক্ষাঘাত রোগে আক্রমণ করে তৎকালঅবধি জীবন শেষপৰ্য্যন্তই একেবারে বাকুরোধ হইয়াছিলেন –জ্ঞাং । (১৮ জুন ১৮৩৬। ৬-আষাঢ় ১২৪৩)”
জানবাজারের বিখ্যাত ধনী প্রীতিরাম মাড়ের পুত্ৰবধু রাসমণি বিধবা হবার পর নিজেই তাঁদের বিপুল সম্পত্তি ও বৃহৎ সংসারের হাল ধরেন। মাহিষ্য বংশীয়া এই রমণীটি বিদ্যাশিক্ষা করেননি বটে, কিন্তু তাঁর জাগতিক জ্ঞান অতি প্রখর। তাঁর স্বামী রাজা ছিলেন না, কিন্তু স্বামীর নাম ছিল রাজচন্দ্ৰ, সেই সুবাদে রাজচন্দ্রের পত্নীকে অনেকে রানী বলে অভিহিত করেন। এবং তিনি রানী নামের যোগ্যও বটে। শ্ৰীমতী রাসমণি যেমন রূপবতী, তেমন তেজস্বিনী।
রূপের জন্যই সামান্য দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি এত সম্পদশালী পরিবারের বধু ও কর্ত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিতা হন। জন্মস্থান হালিশহরের কাছে গঙ্গাতীরে কিশোরী রাসমণি একদিন স্নান করতে এবং জল তুলতে এসেছিলেন। তখন তাঁর বয়েস এগারো। সেই সময় যুবক রাজচন্দ্ৰ গঙ্গাবক্ষে বজরায় বন্ধুবান্ধব সমভিব্যাহারে যাচ্ছিলেন কোনো তীর্থে। রাজচন্দ্রের তখন হৃদয় ভগ্ন, জীবনে শান্তি নেই। পর পর দুটি স্ত্রী পরলোকগমন করায় রাজচন্দ্রের আর বিবাহে মতি নেই। কিন্তু নদীকূলে ঐ রূপলাবণ্যবতী কিশোরীটিকে তাঁর চোখে লেগে গেল। রাজচন্দ্রের বন্ধুবান্ধবরাও বললো, সত্যি, এমনটি আর হয় না। তারা অনুসন্ধান করে জানলো যে, জাতের অমিল নেই, কন্যাটি পালটি ঘরের। পুত্রের বন্ধুদের মুখে সব কথা জানতে পেরে প্রীতিরাম ঐ মেয়েটিকে পুত্রবধু করে নিয়ে এলেন। বন্ধু সুলক্ষণা, তিনি আসবার পর এই পরিবারের উত্তরোত্তর শ্ৰীবৃদ্ধি হতে লাগলো।
রাজচন্দ্রের মৃত্যুর আগে রানী রাসমণির নাম সর্বসাধারণের মধ্যে বিশেষ পরিচিত ছিল না। স্বামীর শ্রাদ্ধের সময়ই তাঁর খানিকটা পরিচয় পাওয়া গেল। এমন দানশীলা রমণী কেউ আর আগে দেখেনি। দানসাগর শ্রাদ্ধে পর পর দুদিন ধরে তিনি মুঠো মুঠো ধন দান করতে লাগলেন। তাঁর নির্দেশ, কোনো প্রার্থই যেন ফিরে না যায়। তৃতীয় দিনে তিনি করলেন তুলট। শুদ্ধ বস্ত্ৰ পরে রানী রাসমণি বসলেন দাঁড়িপাল্লার একদিকে, অন্যদিকে চাপানো হলো শুধু রূপোর টাকা। তাঁর দেহের ওজন হলো ছ হাজার সতেরোটি রৌপ্যমুদ্রা, সেগুলি সেই দণ্ডেই বিতরণ করা হলো পণ্ডিত ব্ৰাহ্মণদের মধ্যে। তারপর থেকে যে কোনো মহৎ কর্মের উদ্দেশ্যে কেউ প্রার্থী হয়ে এলে রানীর কাছ থেকে আশাতীত দান পেয়ে যায়।
রানী রাসমণি যেমন একদিকে অকাতরে দান করেন তেমনি অন্যদিকে বিষয় সম্পত্তিও বাড়িয়ে চলেছেন। কী জমিদারি পরিচালনায়, কী ব্যবসায় কাৰ্যে, তিনি পরিচয় দেন অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার। অর্থ উপার্জনে তাঁর যেমন আনন্দ, তেমনি ব্যয়ে। কলকাতার অন্য ধনীদের প্রায় সবার সঙ্গে রাসমণির একটি পরিষ্কার পার্থক্য চোখে পড়ে। অন্যরাও অনেক সময় দান ধ্যান করেন বটে, কিন্তু বিলাসে প্ৰমোদেও তাঁরা কম অর্থব্যয় করেন না। কিন্তু রানী রাসমণি শুদ্ধাচারিণী, বিশেষ বিশেষ তিথিতে তিনি ভূমিশয্যায় নিদ্রা যান।
কলকাতার ধনীদের মধ্যে একমাত্র ঠাকুর বাড়ির দেবেন্দ্ৰবাবু সমস্ত বিলাসিত পরিত্যাগ করে ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেছেন। এক হিসেবে দেবেন্দ্ৰবাবুও রানী রাসমণির প্রতিপক্ষ। দেবেন্দ্ৰবাবু প্রচার করছেন, দেশবাসী পুতুল পূজা পরিত্যাগ করে নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করুক। আর রানী রাসমণি পূজা করেন সাকার ঈশ্বরের। সমস্ত দেব-দেবীর প্রতি তাঁর অচলা ভক্তি। হিন্দু ধর্মের মহিমা বিস্তারের জন্য তাঁর ধনভাণ্ডার উন্মুক্ত। প্রিন্স দ্বারকানাথ তাঁর স্বামীর কাছ থেকে এক সময় দু লক্ষ টাকা কার্জ নিয়েছিলেন, যথাসময়ে তা শোধ করতে পারেননি বলে ঠাকুরদের জমিদারির একটি পরগণা এখন রানী রাসমণির অধীনে। সুতরাং, প্রকারান্তরে দ্বারকানাথেরই জমিদারির টাকায় দেবেন্দ্ৰবাবু ও রানী রাসমণি পরস্পরবিরোধী দুই ধৰ্মকর্মে ব্যাপৃত।
আতুরালয় স্থাপন, গঙ্গায় ঘাট নির্মাণ, বিভিন্ন তীর্থের দেবদেবীর অলঙ্কার সজ্জা, এ সব তো আছেই, তা ছাড়া এই নগরের উন্নতিকল্পেও তাঁর যত্নের অন্ত নেই। জানবাজারে রানী রাসমণির প্রকাণ্ড অট্টালিকায় দোল-দুর্গোৎসবের জাঁকজমকও কয়েক বৎসরের মধ্যে প্রবাদ-প্রসিদ্ধি পেয়ে গেল। দুর্গোৎসব করতেন বটে পোস্তার রাজা সুখময় রায়, তারপর এই রানী রাসমণি। এই সব উৎসবে সারা শহরের লোক ভেঙে পড়ে তাঁর বাড়িতে। রথের দিন পথে বেরোয় প্রাসাদতুল্য সম্পূর্ণরূপোয় নির্মিত রথ, তার পিছনে প্ৰায় আধ ক্রোশব্যাপী শোভাযাত্রা, তাতে অবিরাম শোনা যায় গীত, বাদ্য আর হারি বোল ধ্বনি।
দুর্গোৎসব উপলক্ষেই রানী রাসমণির অন্য একটি রূপ প্রকাশিত হলো একবার। মহালয়ার দিনের বোধন থেকে শুরু হয় উৎসব। সপ্তমীর দিনে খুব ভোরে ব্ৰাহ্মণরা নব পত্রিকা নিয়ে গঙ্গায় স্নান করাতে যায়, তাদের পেছনে পেছনে বাজনাদাররা ঢাকা, ঢোল, সানাই, করতাল বাজাতে বাজাতে চলে।
সেই তুমুল বাদ্যরবে এক সাহেবের নিদ্রার খুব ব্যাঘাত হলো।
তিনি গবাক্ষ খুলে দেখলেন একদল অর্ধ উলঙ্গ নেটিভ বিকট শব্দ করে লাফাতে লাফাতে চলেছে। নেটিভদের অনেক প্রকার উদ্ভট মুখামির পরিচয় এর আগে পাওয়া গেছে, কিন্তু সূযোদয়ের আগে সকলকার ঘুম ভাঙিয়ে একি উৎকট আনন্দ!
মুখ রক্তবর্ণ করে সাহেব দারুণ চেঁচামেচি করতে লাগলেন এবং তখনই হুকুম দিলেন বাজনা বন্ধ করার। কিন্তু রানী রাসমণির লোকেরা শুনবে কেন? তারা কর্ণপাত না করে তেমনভাবেই ড্যাং ড্যাং করে চলে গেল।
ক্ৰোধে অগ্নিশর্মা হয়ে সাহেব খবর দিলেন কোতোয়ালিতে। পুলিসের সাহায্য চাইলেন, যাতে ফেরার পথে ঐ নেটিভরা তাঁর শান্তি ভঙ্গ করতে না পারে।
দু-একজন অনুচর। এ সংবাদ জানালো রানী রাসমণিকে। তিনিও দপ করে জ্বলে উঠলেন রাগে। তিনি বললেন, আমরা হিন্দু, আমাদের ধর্মকর্মে বাধা দেবার কী অধিকার আছে সাহেবের? সাহেবরা যে খৃষ্টীয় পরবে সারারাত্রব্যাপী হল্লা করে, তখন কি আমরা বাধা দিতে যাই? যা, আরও বেশী করে ঢাক ঢোল বাজা গে যা তোরা! শুধু তাই নয়, আজ সারাদিন ধরে এই পথ দিয়ে বাজাতে বাজাতে যাবি আর আসবি।
তিনি কয়েকজন পাইকও পাঠিয়ে দিলেন ওদের সঙ্গে।
দুচারজন পুলিস সেই শোভাযাত্রাকে বাধা দিতে পারলো না। রাসমণির কর্মচারীরা বললো, আমাদের মা বলে দিয়েছেন, এ রাস্তা আমাদের, এখানে আমরা যা খুশী করবো। সাহেব হাত পা কামড়াতে লাগলেন, সারাদিন ধরে অসহ্য ঢাকের বাজনা তাঁর কান ঝালাপালা করে দিল।
সাহেব একটি মামলা ঠুকলেন রাসমণির নামে। ইংরেজের আদালতে ইংরেজ আনীত মামলার ফলাফল যা হবার তাই হলো, পঞ্চাশ টাকা জরিমানা হলো রাসমণির। কিন্তু এ রমণী বড় জেদী, কিছুতেই হার স্বীকার করার পাত্রী নন। জরিমানার টাকা জমা দিয়ে রাসমণি বললেন, বেশ, এর পর থেকে যে রাস্তা আমি বানিয়েছি, সে রাস্তা দিয়ে অন্য কারুর হাঁটা চলার এক্তিয়ার থাকবে না। বড় বড় গরাণ কাঠের গুড়ি দিয়ে তিনি জানবাজার থেকে বাবুঘাট পর্যন্ত রাস্তার দুদিকে শক্ত বেড়া দিয়ে দিলেন। সব যানবাহন বন্ধ হয়ে গেল, নগর পরিচালকরা পড়লেন মহা অসুবিধেয়। শেষ পর্যন্ত তাঁরা আপোস করলেন রাসমণির সঙ্গে, ক্ষমা চেয়ে তাঁরা জরিমানার টাকা ফেরত দিলেন। রাসমণিও তুলে নিলেন পথের বেড়া। এক স্ত্রীলোকের এই জয় কাহিনীতে খুব আমোদ পেল নগরবাসীরা।
রানী রাসমণি আর একবার কোম্পানী বাহাদুরকে জব্দ করেছিলেন।
সরকার থেকে হঠাৎ আদেশ জারি করা হলো, গঙ্গায় আর জেলেরা ইচ্ছে মতন মাছ ধরতে পারবে না। মাঘে সরস্বতী পূজার পর থেকে সেই আশ্বিন মাস পর্যন্ত গঙ্গা থাকে ইলিশ মাছে ভরা, তখন গঙ্গাবক্ষ জেলে ডিঙিতে ছেয়ে যায়। এর ফলে জাহাজ চলাচলে অসুবিধা হয় বলে ঠিক হলো যে যার খুশী সে আর এখানে মাছ ধরতে পারবে না। এজন্য কর দিতে হবে। কর দিতে গেলেই জেলে ডিঙির সংখ্যা যাবে অনেক কমে।
মৎস্যজীবীরা গিয়ে কেঁদে পড়লো রানী রাসমণির পায়ে। অনেকের জীবিকা নষ্ট হবার উপক্ৰম। এখন রানী না বাঁচালে তাদের কে বাঁচাবে? তিনি ছাড়া তাদের জাতের দুঃখে আর কে সমব্যাথী হবে?
রাসমণি তখন আবার এক চমকপ্ৰদ বুদ্ধির পরিচয় দিলেন। সরকার মাছ ধরার জন্য কর চেয়েছেন, ঠিক আছে, সেই কর তিনি একাই দেবেন। দশ হাজার টাকা দিয়ে তিনি ঘুষুড়ি থেকে মেটেবুরুজ পর্যন্ত গঙ্গা ইজারা নিয়ে নিলেন সরকারের কাছ থেকে। তারপর জাহাজ লঙ্গর করার মোটা দড়ি দিয়ে ঘিরে ফেললেন গঙ্গার সেই এলাকা, জেলেদের বলে দিলেন, এবার তোরা মাছ ধর, যত খুশী মাছ ধর।
দড়ি দিয়ে ঘেরার ফলে সব জাহাজ আটকে গেল। কলকাতার বন্দরে আর কোনো জাহাজ ভিড়তে পারে না, কলকাতার জীবন অচল হয়ে যাবার উপক্ৰম। কলকাতার লোক সবাই সেদিন গঙ্গার কুলে গিয়েছিল রানী রাসমণির কীর্তি দেখতে। সে বড় অদ্ভুত দৃশ্য। মোটা দড়ির ওধারে সার বেঁধে থমকে আছে ইংরেজের জাহাজ, তার নাবিকরা সব হতভম্ব, আর এদিকে পতঙ্গের মতন অজস্র জেলে ডিঙি ভাসছে, জেলেরা উল্লাসে হো হো হা হা করছে। লোকে বলেছিল, ‘দ্যাক দ্যাক, জানবাজারের জমিদারণী ইংরেজের মুখে চুনকালি দিয়েচে।’
ব্যতিব্যস্ত হয়ে সরকার রাসমণির কাছ থেকে কৈফিয়ত তলব করলেন। রাসমণির উত্তর অতি সরল। মাছ ধরার জন্য তিনি গঙ্গার অংশ ইজারা নিয়েছেন, এখন সেই অংশ তিনি জেলেদের মধ্যে বিলি করতে পারেন, সে অধিকার তাঁর আছে। এখান দিয়ে জাহাজ চলাচল করলে মাছ ধরায় বিঘ্ন হবে। সরকার তাঁকে ইজারা দিয়েছেন। এখন তাঁর সুবিধে অসুবিধে দেখার দায়িত্ব তো সরকারের। পুকুর জমা নিয়ে যখন বেড়া জাল ফেলে মাছ ধরা হয়, তখন কি পাড়া-প্রতিবেশীরা সেই পুকুরে আর নাইতে আসে?
অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হলো, রানীও দড়ি কাছি গুটিয়ে নিলেন।
দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের প্রতিষ্ঠাত্রী রাসমণির জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে যত বই বেরিয়েছে, সেখানে লোকশ্রুতির প্রাধান্য, ঊনিশ শতকের এক অসামান্যা বঙ্গরমণীর ঐতিহাসিক পদক্ষেপগুলি কোথাও তেমন বিস্তারিত ভাবে আলোচিত হয়নি। ব্যতিক্রম একটি প্রচেষ্টা, রিপন কলেজের এক বিজ্ঞানের অধ্যক্ষ কোনও রকম ঢাক না বাজিয়ে (ড.শিবতোষ সামন্ত) দুই দশক ধরে একক প্রচেষ্টায় চার খণ্ডে ‘রাসমণির অন্তহীন জীবনবৃত্তে’ নামে যে মূল্যবান বইটি লিখলেন তা কেন ভক্তজনের নজরে তেমন পড়ল না তা কিছুটা আশ্চর্যজনক।
সাড়ে সাতশো পাতার এই বিশাল বইটির আর একটি সম্পদ শ’পাঁচেক চিত্রমালা ও দুষ্প্রাপ্য দলিল থেকে উদ্ধৃতি। অর্থের অভাবে এই সব দলিল দস্তাবেজ এবং নথিপত্র যে ঠিক মতো পুনর্মুদ্রণ করা যায়নি তা বেশ দুঃখজনক।
দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের জটিল ইতিহাস বুঝতে গেলে এক নজরে রাসমণি পরিবারের কিছু বিবরণ শুরুতেই জেনে নেওয়া মন্দ নয়।
নিতান্ত গরিব ঘরের মেয়ে এই রাসমণি। জন্ম ২৪ সেপ্টেম্বর ১৭৯৩। শ্বশুর জানবাজারের বিখ্যাত ধনী ব্যবসায়ী প্রীতিরাম মাড়। তাঁর পুত্র রাজচন্দ্রের তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী এই রাসমণি।
রাজচন্দ্র ছিলেন দূরদর্শী ব্যবসায়ী। সেই সঙ্গে জমিদারি। যে দিন ২০/২৫ হাজার টাকা লাভ না হত, সেদিন আয় অতি অল্প হল বলে তিনি মনে করতেন। কোনও কোনও দিন লক্ষাধিক টাকাও লাভ করতেন।
এই টাকায় তিনি কলকাতায় বিপুল সংখ্যক বাড়ি কিনেছিলেন। এই তালিকাটি দেখলে আজও বিস্মিত হতে হয়। পিতৃদেব প্রীতিরাম মৃত্যুকালে (১৮১৭) সাড়ে ছয় লাখ টাকার ধনসম্পত্তি রেখে যান।
রাজচন্দ্রের চার কন্যা ও এক পুত্র: পদ্মমণি- স্বামী রামচন্দ্র আটা (দাস), কুমারী- স্বামী পিয়ারিমোহন চৌধুরী, করুণাময়ী- স্বামী মথুরমোহন বিশ্বাস (সেজবাবু), মৃতপুত্র, জগদম্বা- স্বামী মথুরমোহন বিশ্বাস।
রাজচন্দ্রের দেহাবসান ৫৩ বছর বয়সে ১৮৩৬ জুন মাসে। তৃতীয় পক্ষের স্ত্রীর বয়স তখন ৪৪ বছর। মৃত্যুকালে তাঁর তিন কন্যা, তিন জামাতা, নাতি নাতনি ও স্ত্রী রাসমণি। সম্পত্তির পরিমাণ অগাধ, তা ছাড়া নগদ ৬৮ লাখ টাকা, বেঙ্গল ব্যাঙ্কের শেয়ার ৮ লাখ টাকা, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরকে দেওয়া ঋণ ২ লাখ টাকা এবং সায়েব কোম্পানি হুক ডেভিডসনকে দেওয়া ঋণ ১ লাখ টাকা।
স্বামীর শ্রাদ্ধ উপলক্ষে রাসমণি এলাহি আয়োজন করেছিলেন। অতিথি ও ব্রাহ্মণ বিদায় ছাড়াও ছিল তিরিশ হাজার কাঙালি সমাবেশ। পরের দিন রাসমণি রৌপ্যমুদ্রায় তাঁর দেহ ওজন করে ৬০১৭ টাকা দান করেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায় বৈধব্যকালে রাসমণি নিজেকে ভোগিনী থেকে যোগিনীতে রূপান্তরিত করলেও বিষয়সংক্রান্ত ব্যাপারে কড়া নজর রেখেছিলেন। পূজাআচ্চা ছাড়াও প্রতিদিন তাঁকে সংবাদপত্র পাঠ করে শোনাতে হত। আরও আশ্চর্য, যোগাযোগ রক্ষার জন্য তিনি শহরের বিশিষ্ট সায়েবদের নিজের বাড়িতে ভোজসভায় নেমন্তন্ন করতেন এবং সেই উপলক্ষে জানবাজারের বাড়ি বিশেষ ভাবে সজ্জিত করতেন।
ধনবতী রাসমণির জনসংযোগ প্রচেষ্টা খুঁটিয়ে দেখবার মতন। কিন্তু আজ তা আমাদের আলোচনার বিষয় নয়, আমরা তাঁর পারিবারিক জটিলতা এবং মন্দির প্রতিষ্ঠার ওপর আলোকপাত করতে চাই।
এই শহরের অনেক ক্রোড়পতি বিপুল সামাজিক ব্যয়ের ইতিহাস স্থাপন করেও সময়ের স্রোতে বিস্মৃতির সাগরে হারিয়ে গিয়েছেন, কিন্তু রাসমণি, তাঁর নিয়োজিত মাসমাইনের পূজারি ছোট ভট্চায্যি এবং তাঁর স্থাপিত মন্দির আজও ভক্তজনের কৌতূহলের কেন্দ্র হয়ে আছে।
একই সঙ্গে কৌতূহলের কেন্দ্র হয়ে রয়েছে, এ দেশে কেন দেবদেবীকে উৎসর্গ করা মন্দিরও দীর্ঘস্থায়ী মামলা-মকদ্দমার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে।
মামলা-মকদ্দমার কথা যখন উঠল তখন গোড়া থেকে শুরু করাই ভাল। লেখক শিবতোষ সামন্ত খোঁজখবর করে রাসমণির স্বামী রাজচন্দ্রের দায়ের করা পঁচিশটা মামলার তালিকা উপহার দিয়েছেন।
এর মধ্যে সাতটা মামলা জনৈক মধুসূদন মণ্ডলের বিরুদ্ধে, আটটি মামলা গোপীমোহন দাসের বিরুদ্ধে। একটি মামলা রবীন্দ্রনাথের দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে, মনে হয় ধার দেওয়া টাকা উদ্ধারের প্রচেষ্টায়। ১৮৩৬ সালে অংশ্যঘাত রোগে রাজচন্দ্রের মৃত্যুর আট বছর পরেও রাসমণি যে সত্যেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এই মামলা চালাচ্ছেন তার প্রমাণ রয়েছে।
রাজচন্দ্রের স্ত্রী রাসমণিও যে মামলা-মকদ্দমায় ভয় পেতেন না তার যথেষ্ট প্রমাণ আদালতে রয়েছে। গবেষক সামন্তের মন্তব্য: জমিদারি চালাতে গেলে মামলা-মকদ্দমা জীবনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। টাকা আদায়ের মামলা, বন্ধকী মামলা, এমনকী ফৌজদারি মামলা। কী ছিল না! জনৈক শম্ভুচরণ দাস ফৌজদারি মামলা করেন রাসমণির বিরুদ্ধে এবং প্রথম পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট রাসমণির বিরুদ্ধে রায় দেন। এর বিরুদ্ধে রাসমণি যশোরের আদালতে আবেদন করেন এবং সফল হন। আগেকার রায় তো বাতিল হলই, সেই সঙ্গে সুদ-সহ তাঁর প্রাপ্য টাকা ফিরে পেলেন রাসমণি।
রাসমণি তখনকার সুপ্রিম কোর্টে যে সব মামলা দায়ের করেছিলেন তার একটি দীর্ঘ তালিকা পাওয়া যাচ্ছে, একই সঙ্গে রয়েছে রাসমণির বিরুদ্ধে যে সব মামলা হয়েছিল তার একটি তালিকা।
সামন্ত লিখছেন, “আত্মীয়স্বজন ও জ্ঞাতিদের সঙ্গেও” মামলা হয়েছিল বলে শোনা যায়।
প্রয়াত স্বামীর সম্পত্তি রক্ষার কঠিন দায়িত্ব নিয়ে রাসমণি এক সময়ে নিজের দুই জামাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে দিতেও দ্বিধা করেননি। দক্ষিণেশ্বর মন্দির নির্মাণের প্রাথমিক দায়িত্বে ছিলেন বড় জামাই রামচন্দ্র দাস। মন্দির উদ্বোধনের মাত্র চার মাস আগে ১৮৫৫-র ১৭ জানুয়ারি রাসমণি “নিজকন্যা পদ্মমণিকে জড়িয়ে, বড় জামাই রামচন্দ্রকে জড়িয়ে সুপ্রিম কোর্টে অর্থ তছরুপের মামলা করেন।”
বিচারপতি স্যর লরেন্স কীল-এর আদালতে চার বছর এই মামলা চলে এবং শেষ পর্যন্ত ১৮৫৯ সালের ১৩ জানুয়ারিতে রানি এই মামলা প্রত্যাহার করেন।
বলা বাহুল্য, জামাই রামচন্দ্র সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। এই মামলার নথি থেকে জানা যায়, স্বামীর মৃত্যুর পরে রাসমণি তাঁর জামাতাদের সহায়তায় জমিদারি পরিচালনা করতেন এবং পালাক্রমে এক এক জন জামাতাকে ‘ম্যানেজার’ বা ‘স্টুয়ার্ট’ বা ‘এজেন্ট’ হিসেবে নিয়োগ করতেন।
দক্ষিণেশ্বর মন্দির নির্মাণকালে গঙ্গায় বানের ফলে পোস্তা, ঘাট ইত্যাদি ভেঙে বিশেষ ক্ষতি হয় এবং তার পর রানি তাঁর জামাতা রামচন্দ্রকে (১৮৪৯) ম্যানেজারের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে দ্বিতীয় জামাই প্যারিমোহন চৌধুরীকে নিয়োগ করেন। মন্দির নির্মাণের তত্ত্বাবধানে আসেন মথুরমোহন বিশ্বাস, যিনি প্রথমে বিবাহ করেন রাসমণির তৃতীয়া কন্যা করুণাময়ীকে এবং তাঁর অকালমৃত্যুর পরে রাসমণি এঁর সঙ্গেই কনিষ্ঠা কন্যা জগদম্বার বিবাহ দেন। এই গুণবান জামাইকে রাসমণি নাকি হাতছাড়া করতে চাননি।
যে জামাইয়ের ওপর তাঁর এতখানি বিশ্বাস, সেই মথুরের বিরুদ্ধেও সুপ্রিম কোর্টে রাসমণি এক মামলা দায়ের করেন ১১ ডিসেম্বর ১৮৫১-তে। অভিযোগ: সম্পত্তির বেহিসাব এবং টাকা আত্মসাৎ। শুধু ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে টাকা তছরুপের অভিযোগই নয়, সংবাদ প্রভাকরে বিজ্ঞাপন দিয়ে জনসাধারণকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল। এই নোটিসে দেখা যাচ্ছে রানির অ্যাটর্নি ১১ ওল্ড পোস্টাপিস স্ট্রিটের ডেনম্যান অ্যান্ড এবাট।
এই মামলা চলার সময় কন্যা-জামাতার সঙ্গে রানির ব্যক্তিগত সম্পর্ক সম্বন্ধে বিস্তারিত সংবাদ তেমন প্রচারিত নয়, শুধু জানা যায় মথুরবাবু সস্ত্রীক ফরাসডাঙায় চলে যান।
১২ জানুয়ারি ১৮৫২-তে মামলার একতরফা হিয়ারিং হয় এবং চার দিন পরে রাসমণি একটা ডিক্রি পান। এই মামলার পরেও রানির অ্যাটর্নি জন নিউমার্চ বাংলা ও ইংরেজি পত্রপত্রিকায় রানির কোম্পানির কাগজের বিবরণ দিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন।
যাই হোক, পরবর্তী সময়ে (১৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৪) শাশুড়িমাতা রাসমণি জামাতা মথুরের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেবার জন্য আবেদন করেন। আদালতে তাঁর বক্তব্য, পাওনা টাকার বেশির ভাগই ফেরত পাওয়া গিয়েছে।
শুধু দুই মেয়ে-জামাই নয়, তার বাইরেও রানির মামলার ছড়াছড়ি। দক্ষিণেশ্বরে জমি কিনতে গিয়েও হাজার হাঙ্গামা। কয়েক জন জমিদার এই জমি কেনায় যথাসাধ্য বাধা দিয়েছিলেন।
শোনা যায়, রানিকে আটকাবার জন্যে একজন ধনবান মোট ১৬ বার কেস করেন এবং প্রতিবারই হেরে যান। এই বাধা অতিক্রম করার জন্য রাসমণি স্বয়ং নাকি প্রতিপক্ষের বাড়িতে পর্যন্ত গিয়েছিলেন। কিন্তু মিষ্টি কথায় কাজ হয়নি।
বাবু রাজচন্দ্র দাসের মৃত্যুর পরে জমিদারির দায়িত্ব নেন রানী রাসমণি দাসী। ইতিহাস বলে যে, প্রতিপদে তৎকালীন ব্রাহ্মণ সমাজ এবং ইংরেজ শাসকদের সাথে তাঁর বিরোধ হয়েছিল। কোনও অবস্থাতেই তিনি আপস করেন নি এবং নত হন নি। সেই সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন তিনি। তাঁর পরিচিতি মানবদরদি রূপে। যাঁরা ইতিহাস নিয়ে খোঁজ রাখেন, তাঁরা প্রায় সকলেই তাঁর কাজ নিয়ে জ্ঞাত। তবুও একটি তালিকা তৈরি করে তাঁর জীবন, প্রতাপ ও কাজের নমুনা দেবার চেষ্টা করলাম-
ইম্পেরিয়াল বা ন্যাশনাল লাইব্রেরি‚ হিন্দু কলেজ বা প্রেসিডেন্সি কলেজের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরিতে প্রচুর অর্থ দান করেছিলেন তিনি।
গঙ্গার জলপথ আটকে রানি রাসমণি বন্ধ করে দিয়েছিলেন জাহাজ চলাচল। ব্রিটিশদের বাধ্য করেছিলেন গরিব জেলেদের উপর বসানো পানিদারি কর প্রত্যাহার করতে। ব্রিটিশরা রীতিমতো সমীহ করত তাঁকে।
সতীদাহ প্রথার বিরোধিতা করেছিলেন বাবু রাজচন্দ্র ও রানি রাসমণি। স্ত্রীর কথায় বৃদ্ধাবাস ও অন্নসংস্থান তৈরি করেছিলেন রাজচন্দ্র। কলকাতায় প্রথম ব্যাঙ্কও তাঁর কীর্তি। বানিয়েছিলেন বাবু রোড। যা এখন রানি রাসমণি রোড।
বাল্যবিবাহ রোধে ভূমিকা নিয়েছিলেন দুজনে। রাসমণি বলেছিলেন‚ বিয়ের সময় স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বয়সের ফারাক কম থাকুক। সমর্থক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নারীকল্যাণকর কাজের। সমর্থন জানিয়েছিলেন বিধবা বিবাহ আন্দোলনে। ব্রিটিশদের কাছে দরবার করেছিলেন যাতে আইন করে বন্ধ হয় পুরুষদের একাধিক বিয়ে।
দক্ষিণ ২৪ পরগণায় (এখনকার সন্তোষপুর) বিশাল জমিদারি ছিল দ্বারকানাথ ঠাকুরের। তখন সে জায়গা সুন্দরবনের অংশ। বাস কয়েকঘর ঠগীর। সেই জমিদারি রানি রাসমণির কাছে বন্ধক রেখে বিলেত গিয়েছিলেন দ্বারকানাথ। পরে সেই জায়গার প্রভূত উন্নতিসাধন করেছিলেন রাসমণি।
প্রয়াত স্বামীর স্মৃতিতে ১৮৩০ সালে রানি রাসমণি বানিয়েছিলেন বাবু রাজচন্দ্র দাস ঘাট। নিত্য স্নানার্থীদের সুবিধার্থে। ডোরিক গ্রীক স্থাপত্যে তৈরি সেই ঘাট এখন মুখে মুখে হয়ে গেছে বাবুঘাট।
তাঁর বাড়িতে জাঁকজমক করে দুর্গাপুজো হতো। একবার বিসর্জনের শোভাযাত্রা আটকে দিয়েছিল ব্রিটিশরা। তিনি পরের দিন আরও বড় শোভাযাত্রা বের করলেন। এ বার তাঁকে জরিমানা করে আদালতে নিয়ে গেল ব্রিটিশরা। তিনি জরিমানা দিলেন। মামলা লড়লেন। তাতে জিতলেন। ব্রিটিশদের থেকে ফেরত পেলেন জরিমানার টাকা।
ব্রিটিশরা তাঁর প্রজাদের বিরক্ত করায়, তাঁর স্বামীর তৈরি রাস্তা রাতারাতি শক্ত ফেন্স বা বেড়া দিয়ে ঘিরে দিয়েছিলেন তিনি। ফলে অনেক সাহেব তাঁদের নিজেদের বাড়িতেই আটকে পড়েন। আদালতে মামলা করেও তাঁরা কিছু করতে পারেন নি। শেষে ক্ষমা প্রার্থনা করে তাঁদের রেহাই মেলে।
দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণী মন্দির নিয়ে তাঁর লড়াই আমরা সকলেই জানি। তিনি এই মন্দির নির্মাণ না করলে আমরা পেতাম না শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব’কে ও স্বামী বিবেকানন্দ’কে।
জীবনের শেষ লগ্নে দিনাজপুরের (এখন বাংলাদেশে) বিশাল সম্পত্তি কেনেন রাসমণি। যেখান থেকে বহন করা হবে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের ব্যয়ভার। ১৮৬১ খ্রীস্টাব্দের ১৮ই ফেরুয়ারি শেষ হয় সেই সংক্রান্ত কাজ। পরের দিন‚ ১৯শে ফেব্রুয়ারি ইহজীবন ছেড়ে মায়ের পায়ে আশ্রয় নেন রানি রাসমণি। ৬৮ বছর বয়সে।
আগেই উল্লেখ করেছি যে রানী রাসমণির চার কন্যা সন্তান ছিল। পদ্মমণি, কুমারী, করুণাময়ী ও জগদম্বা। বড় মেয়ে পদ্মমণির বিয়ে হয় রামচন্দ্র দাসের সাথে আর কুমারীর স্বামী হলেন প্যারিমোহন চৌধুরী। সেজো মেয়ে করুণাময়ী বিয়ের দুই বছর পরই মারা যান। তাঁর স্বামী মথুরামোহন বিশ্বাস জগদম্বাকে বিবাহ করেন। রানী রাসমণির পরে মথুরামোহন জমিদারির দায়িত্ব নেন। তাঁর অনন্য কীর্তি, ব্যারাকপুরে গঙ্গার তীরে, দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের অবিকল অন্নপূর্ণা মন্দির নির্মাণ। শ্রী রামকৃষ্ণ স্বয়ং এই মন্দির উদ্বোধন করেছিলেন। তাঁদের পুত্র ত্রৈলোক্যনাথ বিশ্বাস। ত্রৈলোক্যনাথের চার পুত্র সন্তান – ব্রজগোপাল, নিত্যগোপাল, শ্রীগোপাল আর গোপাল। ব্রজগোপালের দুই কন্যা- লাবন্যলতা এবং বিদ্যুৎলতা। লাবন্যলতার বিবাহ হয় বিজয়কৃষ্ণ হাজরার সঙ্গে।
১৭৯৩ সাল থেকে জানবাজারের রাজবাড়ীতে দুর্গাপুজা শুরু করেন বাবু প্রীতরাম দাস। রাসমণি তাঁর বাড়িতে দুর্গাপূজা উদযাপন করতেন প্রথা ও রীতিনীতি মেনে। সারা রাত যাত্রা হত। সেযুগে দুর্গাপূজায় সাহেবদের মনোরঞ্জন করার প্রবণতা থাকলেও রাসমণি তা করতেন না। ১৮৬১ সালে তাঁর মৃত্যুর পর থেকে তাঁর জামাইরা পুরনো জায়গাতেই দুর্গাপূজা উদযাপন করে আসছেন। ১৯০৩ সাল থেকে জানবাজার রাজবাড়ীর পুজায় পশুবলি বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাসমণির বড়ো মেয়ের অধস্তন পঞ্চম পুরুষ অমলনাথ দাস সিঁথিতে তাঁদের পৈতৃক দুর্গাপূজাটি এই বাড়িয়ে উঠিয়ে আনেন। বাড়ির একটি শাখা বাড়ির অন্য অংশে চলে যান প্রায় একশো বছর আগে। তাঁরা আলাদা পূজা করেন। দাসেরা বলি না দিলেও, তাঁদের সাতটি পাঁঠাবলি হয়। চন্দননগরের শিল্পী প্রতিমা নির্মাণ করেন এবং প্রতিমার পোশাক আনা হয় বর্ধমান থেকে। চৌধুরীদের সুদৃশ্য প্রতিমাটিকে শোলার মুকুট পরানো হয়।
রানী রাসমণির আদি দুর্গাপূজা বাড়ির যে অংশে হতো সেই অংশেই বর্তমানে হাজরা পরিবার বসবাস করেন এবং তাঁরাই সেই দুর্গাপূজা পরিচালনা করেন। অন্যদিকে ত্রৈলোক্যনাথের আর এক পুত্র নিত্যগোপালের দুই সন্তান- সুশীল কুমার বিশ্বাস আর সুনীল কুমার বিশ্বাস। সুনীল কুমার বিশ্বাসের ছেলেরাই বর্তমানে ১৮ রানী রাসমণি রোডে, রানি রাসমণি ভবনের দুর্গাপূজা পরিচালনা করেন যা বিশ্বাস বাড়ির পুজো নামেই পরিচিত। সমগ্র বাড়িটির এখন তিনটি অংশ। জগদম্বার বংশধরেরা বাস করেন ১৩, রানি রাসমণি রোডে, কুমারীর বংশধরেরা থাকেন ১৮/৩ সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোডে ও পদ্মমণির বংশধরেরা বাস করেন ২০ সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোডে।
(তথ্যসূত্র:
১- রাসমণির অন্তহীন জীবনবৃত্তে, ড.শিবতোষ সামন্ত, সৌরজ্যোতি সামন্ত (২০০৯)।
২- রাণী রাসমণি ও তাঁর জীবনদর্শন, অমলেন্দু কুমার দাশ, অনুপম প্রকাশনী (২০১৩)।
৩- রাণি রাসমণি দেবী, গৌরী মিত্র, গ্রন্থতীর্থ (২০১০)।
৪- রানি রাসমণি, মালা দত্ত রায়, পারুল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড (২০১৮)।
৫- আমি তোমাদেরই রাসমণি, শ্যামলী ঘোষ, যোগমায়া প্রকাশনী (২০০৯)।
৬- রানি রাসমণি ও আলোকধাত্রী কাদম্বিনী, ডাঃ জগন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, জগতময় পাবলিকেশন্স (২০১৫)।
৭- ১২ই জুলাই ২০১৪ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় শংকর লিখিত প্রবন্ধ।
৮- আজকাল পত্রিকা, ৪ঠা নভেম্বর ২০১৮ সাল।
৯- কলকাতা হাইকোর্ট সার্ধশতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ, শ্রী অহিন চৌধুরী লিখিত প্রবন্ধ।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত