১৯৭৪ সালের ১৮ই মে। দিনটি ছিল বুদ্ধ জয়ন্তী, ভারতে সরকারি ছুটির দিন। ঠিক সকাল ৮টা বেজে ৫ মিনিটে পুরো বিশ্বকে চমকে দিয়ে পোখরান টেস্ট রেঞ্জে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় ভারত। বুদ্ধ জয়ন্তীতে বিস্ফোরণ ঘটানোয় এর কোডনাম দেয়া হয়েছিল ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’। সেনা কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্য অনুযায়ী স্মাইলিং বুদ্ধের মোট উৎপন্ন শক্তি ছিল ১২ কিলোটনের মতো। অবশ্য ‘ম্যাগনিট্যুড টু ইল্ড কনভার্সন’ প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত পরিমাণ ছিল ৬ কিলোটন। তবে ভারতীয় পক্ষ-বিপক্ষের রাজনীতিবিদগণ স্মাইলিং বুদ্ধের সক্ষমতার অতিরঞ্জন আর অবনমন দুই-ই করেছেন। রাজনীতিবিদগণের দেয়া সংখ্যাগুলো ২ কিলোটন থেকে শুরু হয়ে ২০ কিলোটন পর্যন্ত গিয়েছে! হয়তো ‘কিলোটন’ শব্দটির প্রকৃত পরিমাণই তারা অনুধাবন করতে পারেননি!
স্মাইলিং বুদ্ধ বোমা পরীক্ষার পর আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া কীরূপ তীব্র ছিল, তা নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারছেন। ফ্রান্স অবশ্য এই পরীক্ষার জন্য ভারতকে অভিনন্দন জানিয়ে টেলিগ্রাম করেছিল, যা আবার পরে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। কারণ, পরীক্ষা সম্পন্ন হবার পরও ভারত একে একটি শান্তিপূর্ণ গবেষণালব্ধ পরীক্ষা বলে অভিহিত করে আসছিল। একে সামরিকায়ন করা হবে না, এ মর্মে তারা একাধিক বিবৃতিও দেয়। এসব বিবৃতি পাকিস্তান অবশ্য কানে তোলেনি। তারাই ছিল এ পরীক্ষার সবচেয়ে বড় সমালোচক। অন্যদিকে ভারি জল (D2O) দ্বারা চালিত সাইরাস চুল্লীটি কানাডাই সরবরাহ করেছিল ভারতকে। তাই তারা তাদের চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ করে ভারতের বিরুদ্ধে এবং ভারি জলের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। রাশিয়া নিরপেক্ষ দর্শকের ভূমিকা পালন করলেও আমেরিকা সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভারতের শান্তিপূর্ণ পরীক্ষার দাবি মেনে নেয়। এর কারণ অবশ্য অনুমানযোগ্য। ঐ মুহূর্তে ভারতের তারাপুরে একটি পরমাণু বিদ্যুৎ চুল্লী নির্মাণের কাজ করছিল আমেরিকা। তারা হয়তো চায়নি সেই কাজ বন্ধ হয়ে যাক!
অন্যদিকে দেশীয় প্রতিক্রিয়া ছিল ইতিবাচকতা আর প্রশংসায় ভরপুর। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানকে পরাজিত করতে সহায়তা করার সাহসী ভূমিকার জন্য এমনিতেই ইন্দিরা গান্ধীর জনপ্রিয় তুঙ্গে ছিল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা কমিটির ৫টি দেশের বাইরে প্রথম দেশ হিসেবে ভারতকে পারমাণবিক শক্তিধর দেশের তালিকায় স্থান করে দেয়ার কারণে তাঁর এবং তাঁর দল কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া হয়। এ প্রকল্পে সার্বিক অবদানের জন্য হোমি সেথনা আর রাজা রামান্না পদ্মবিভূষণে ভূষিত হন। আরো পাঁচজন লাভ করেন পদ্মশ্রী পুরস্কার। সব মিলিয়ে পোখরান-১ ভারতের জন্য এক স্মরণীয় অধ্যায়। নিঃসন্দেহে এ অধ্যায়টিই ভারতকে আজকের শক্তিশালী অবস্থানে আসতে সহায়তা করেছে সর্বাগ্রে। তবে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়। পোখরান-১ পরীক্ষাটি কিন্তু ভারত শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে করেছিল বলেই প্রচার করেছে। তাই তখন ভারত কেবল পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত হয়। পরমাণু অস্ত্র সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে ভারত পরিচিত হয় আরো পরে, পোখরান-২ এর সময়।
তবে শুরুটা এত সহজ ছিল না। জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, “শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যেই আমাদের পারমাণবিক শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। তবে যদি আমরা বাধ্য হই, নিঃসন্দেহে আমরা এটির (পারমাণবিক শক্তি) কঠোর প্রয়োগও করবো!”
নেহরুর এই উক্তিতেই ভারতের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সাফ বোঝা গিয়েছিল। শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের কথা তো কেবল আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য বলা। তবে বৈদেশিক শক্তি কিন্তু মোটেই অনুকূলে ছিল না ভারতের জন্য। জাতিসংঘের নিরাপত্তা কমিটির স্থায়ী ৫ সদস্য রাষ্ট্র ছাড়া আর কেউ পারমাণবিক শক্তি অর্জন করুক, তা কোনোভাবেই ঘটতে দিতে চায়নি পরাশক্তি এই রাষ্ট্রগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তো বরাবরই নজরদারি এবং নানাবিধ সতর্কতা ছিল। এমনিতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমার ধ্বংসলীলা দেখে পুরো বিশ্ব জনমতই এই অস্ত্রের বিপক্ষে ছিল। অথচ বিশ্ব জনমতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে, বিশ্বরাজনীতির বৈরিতা অতিক্রম করে ভারত সফলভাবে পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালায় ১৯৭৪ সালে।
ভারতে পারমাণবিক কর্মসূচী শুরু হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই। ব্রিটিশ ভারতে ‘টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল নিউক্লিয়ার রিসার্চ’ নামক একটি পারমাণবিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন প্রখ্যাত পরমাণুবিদ জেহাঙ্গীর ভাভা। ১৯৪৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এ ইনস্টিটিউট মূলত শান্তিপূর্ণ কাজে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করতো। ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করার পর ভারত তাদের পারমাণবিক কার্যক্রম আরো বিস্তৃত করে। বহির্বিশ্বের সম্ভাব্য সমালোচনার কথা মাথায় রেখে ১৯৪৮ সালে ‘অ্যাটমিক এনার্জি অ্যাক্ট’ নামক একটি পারমাণবিক আইন পাস করে ভারতীয় সংসদ, যেখানে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয় যে ভারত কেবল শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করবে। তবে ভারতের লক্ষ্য যে ভিন্ন কিছুই ছিল, তা বোঝা গিয়েছিল দ্রুতই। শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তির ব্যবহারে সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ ভারত অনেক নাটকীয়তার পর শেষ পর্যন্ত ‘নিউক্লিয়ার নন-প্রোলিফারেশন ট্রিটি’ তথা পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ সংক্রান্ত চুক্তিতে যোগ দেয়নি।
পঞ্চাশের দশকে ভারত নীরবে নিভৃতে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচী দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্রের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। এক্ষেত্রে বিশ্ববাসীর জন্য ভয়ের কারণ স্নায়ুযুদ্ধ ভারতের জন্য আশীর্বাদের মতোই ছিল। স্নায়ুযুদ্ধের ডামাডোলে ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচীর দিকে নজর দেয়ার ফুরসতই মেলেনি বিশ্বনেতাদের! ‘ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জি’ বা ডিএই গঠন ছিল পরমাণু অস্ত্রের দিকে ভারতের প্রথম বড় পদক্ষেপ। এই দফতরের প্রথম সচিব হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন জেহাঙ্গীর ভাভা।
একদিকে নিজেদের অভীষ্ট লক্ষ্য ঠিক রেখেই বিশ্ব রাজনীতিতেও নিজেদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান ধরে রেখেছিল ভারত। কয়েক বছরের মাথায় ডিএই’র বাজেট বর্ধিত হয়ে ভারতের মোট সামরিক বাজেটের এক-তৃতীয়াংশে উন্নীত হয়। এ সময় কানাডা আর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ‘সাইরাস’ নামক একটি পারমাণবিক চুল্লী স্থাপনের চুক্তি করে ভারত, যেখানে উল্লেখ করা হয় যে চুল্লীটি কেবলই শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হবে। এই চুক্তিটি বিশ্ব রাজনীতিতে ভারতের দেয়া একপ্রকার আইওয়াশের মতো ছিল। তবে চুল্লী স্থাপনের চুক্তি করলেও পারমাণবিক জ্বালানির জন্য কানাডার দ্বারস্থ হতে চায়নি ভারত। অবশ্য দেশী মেটালারজিস্ট ব্রহ্ম প্রকাশ সাইরাসের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি যোগাড়ের প্রক্রিয়া উদ্ভাবনের পরই নেহরু কানাডা থেকে জ্বালানি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান।
ব্রহ্ম প্রকাশের জ্বালানি উৎপাদনের পরিকল্পনাটি ‘প্রজেক্ট ফিনিক্স’ নামকরণ করেন নেহরু। মূলত, সাইরাস পুনঃউৎপাদন ব্যবস্থা সম্বলিত একটি চুল্লী ছিল। সেখানে ইউরেনিয়াম থেকে শক্তি উৎপাদনকালে প্লুটোনিয়াম উৎপন্ন হবে। আমেরিকান কোম্পানি ‘ভিট্রো ইন্টারন্যাশনাল’ এর সহায়তায় সেই পুনঃউৎপাদিত প্লুটোনিয়ামের পুনঃব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রজেক্ট ফিনিক্সের আওতায় একটি প্লুটোনিয়াম প্ল্যান্ট স্থাপন করে ভারত।
ষাটের দশকের শুরুতে ভারতে পারমাণবিক উন্নয়ন কর্মসূচী কিছুটা স্থবির হয়ে পড়ে। ইন্দো-চায়না যুদ্ধের কারণে পারমাণবিক কর্মসূচীতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করার সুযোগ হচ্ছিলো না ভারতীয় কর্তৃপক্ষের। যুদ্ধে কিছুটা কোণঠাসা ভারত সাহায্যের জন্য দ্বারস্থ হয়েছিল রাশিয়ার। কিন্তু ইতোমধ্যে কিউবান মিসাইল সংকটে জড়িয়ে পড়া রাশিয়া ভারতের অনুরোধ রাখতে পারেনি। এই কঠিন পরিস্থিতিতে ভারত দুটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। প্রথমত, রাশিয়া তাদের কোনো শক্ত মিত্র নয়। দ্বিতীয়ত, পরাশক্তি হতে হলে পারমাণবিক অস্ত্র ছাড়া বিকল্প নেই। দু’বছর পর, ১৯৬৪ সালে ভাভাকে প্রধান নিযুক্ত করে পারমাণবিক অস্ত্রের নকশা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেন নেহরু। শুরু হয় পরমাণু অস্ত্রের দিকে ভারতে মূল অগ্রযাত্রা।
মূল কর্মসূচী শুরুর পূর্বে অবশ্য তার ভিত্তি স্থাপন করার প্রয়োজন হয়। সে ভিত্তি স্থাপনের কাজটা ভালভাবেই করেন জেহাঙ্গীর ভাভা। মূল ভিত্তিই জনমত, যা তিনি ব্যাপক প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে আদায় করতে সমর্থ হন। রেডিওতে আর পত্রপত্রিকায় দিনরাত তিনি পারমাণবিক অস্ত্রের সুবিধা, নিরাপত্তা আর স্বল্প খরচের কথা প্রচার করেন। অবশ্য মূল কর্মসূচী শুরুর কিছুদিনের মাথায় নেহরুর মৃত্যু ছিল এ কর্মসূচীতে একটি বড় বাধা। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় এলেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, যিনি কট্টর গান্ধীবাদী ছিলেন। ক্ষমতায় এসেই তিনি পরমাণু প্রকল্পের প্রধান হিসেবে তার পছন্দের গান্ধীবাদী পরমাণুবিদ বিক্রম সারাবাইকে নিয়োগ দেন। এ দুজন পুনরায় ভারতের পরমাণু কর্মসূচীকে অস্ত্র থেকে সরিয়ে শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের দিকে নিয়ে যেতে থাকেন।
ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ঝিমিয়ে পড়া পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচী নতুন উদ্যমে শুরু হয়। বহির্বিশ্বের নিকট নিজেদের নিরপেক্ষ এবং শান্তিপূর্ণ অবস্থান বজায় রেখে গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচী চালিয়ে নেয় ভারত। এর গোপনীয়তা ধরে রাখতে মাত্র ৭৫ জন বিজ্ঞানীকে হোমি সেথনা, রাজা রামান্না ও কৃষ্ণগোপাল ইয়েঙ্গারের মতো পরমাণুবিদ এবং পদার্থবিদদের আওতায় নিয়োগ দেয়া হয় এই অস্ত্র প্রকল্পের জন্য। শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য ইউরেনিয়াম চুল্লী সাইরাস ছিল বিশ্বের সামনে ভারতের টোটকা। ইন্দিরা গান্ধীর অনুমোদিত বিজ্ঞানী দল অস্ত্র কর্মসূচীর জন্য গোপনে একটি প্লুটোনিয়াম চুল্লী নির্মাণ করে ফেলে ১৯৭০ সালের মধ্যে।
একই বছর ইন্দিরা গান্ধী ‘ভাভা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার’ তথা বার্চ স্থাপন করেন পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনের জন্য। বার্চের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় পদার্থবিদ রাজা রামান্নাকে (যেহেতু ভাভা মারা গিয়েছিলেন কয়েক বছর আগেই)। প্রকল্পের গোপনীয়তা রক্ষায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে মাত্র ৭৫ জন বিজ্ঞানী এবং প্রয়োজনীয় শ্রমের জন্য আরো কিছু সেনা কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। প্রকল্পটি এত গোপনীয়তার সাথে সম্পন্ন হয় যে ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জাগজীবন রামও অস্ত্র পরীক্ষা সম্পন্ন হবার পূর্বে এ সম্পর্কে জানতে পারেননি!
ভারতের নির্মিত পারমাণবিক অস্ত্রটির বিস্ফোরক ব্যবস্থা অনেকটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাগাসাকিতে নিক্ষেপ করা পারমাণবিক বোমা ‘ফ্যাটম্যান’ এর মতো। এতে ব্যবহার করা প্লুটোনিয়ামের পুরোটাই আসে সাইরাস থেকে। পোখরান-১ নামক এই পারমাণবিক বোমা পরীক্ষায় ১.২৫ মিটার পরিধির ব্যবহৃত বোমাটির ওজন ছিল ১৪০০ কেজি। রাজস্থান প্রদেশের পোখরান নামক স্থান এর বিস্ফোরণের জন্য নির্ধারণ করা হয়। এটি ছিল একটি ভূগর্ভস্থ পরীক্ষা আর বোমাটির বিস্ফোরণ প্রক্রিয়া ছিল ফিশন। এই বিস্ফোরণ ছিল তেজস্ক্রিয়তামুক্ত।
পর পর দুটো দিন। উনিশ আর বিশ— শনি আর রবি। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে, অথচ মনে হচ্ছে এই গতকাল ঘটে গিয়েছে।
এই দু’দিনে দুটো ঘটনার ধাক্কা এসে লেগেছিল সারা পৃথিবী জুড়ে, তবে প্রথম ঘটনার কেন্দ্রে ছিল আমাদের দেশ— ভারত; আর দ্বিতীয়টার কেন্দ্রে আমেরিকা বা আরও পরিষ্কারভাবে ‘নাসা’ থাকলেও, প্রভাব পড়েছিল প্রকৃত অর্থে গোটা বিশ্বে!
দ্বিতীয় বিষয়টা হল অ্যাপোলো মহাকাশযানের চাঁদে পৌঁছনো, মানুষের প্রথম পা-রাখার দিন চাঁদের মাটিতে। ২০শে জুলাই, ১৯৬৯।
আর প্রথম ঘটনার দিন ছিল শনিবার, ১৯শে জুলাই, ১৯৬৯— ইন্দিরা গান্ধী দেশের ১৪টা বড় ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রায়ত্ত করলেন। মোট আমানতের পরিমাণ ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ। তখনও পর্যন্ত স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া ছিল সরকারের আওতায়। একমাত্র স্টেট ব্যাঙ্ক। জন্ম: ১৮০৬ সাল। ব্যাঙ্ক অব ক্যালকাটা নাম ছিল তখন। তিন বছর পরে ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গল নাম হয়। ১৯৫৫ সালে সরকার ব্যাঙ্কটি অধিগ্রহণ করে, তখন নাম ছিল ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক, পরে নাম পাল্টে স্টেট ব্যাঙ্ক হয়েছে। একা এই ব্যাঙ্কের আমানতের পরিমান ছিল ব্যাঙ্কশিল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি— মোট আমানতের ২৩ শতাংশের কাছাকাছি।
ইন্দিরা গান্ধী অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে জাতীয়করণের কাজ সেরে ফেলেন। এই পর্যন্ত ইতিহাসের বিষয়। সেই ইতিহাসের ৫০ বছর ২০১৯ সালের ১৯ জুলাই পালন করা হয়েছে। সগর্বে এবং দেশজুড়ে। বিদেশের লোকজনও খুশিমনে পালন করছেন। সেমিনার, আলোচনায় চারদিক ব্যস্ত…অথচ পঞ্চাশ বছর আগের চেহারা ঠিক এরকম ছিল না।
পক্ষে লোক ছিল, বিপক্ষেও প্রবল বাধা। অর্থনীতির পণ্ডিত বলবেন, ‘এটা তো স্বাভাবিক! একটা বড় পদক্ষেপ, যদি সফল না হয় সেটাও তো মানুষ দেখবে।’ ঠিক কথা, অবশ্যই দেখবে… প্রথা ভাঙার খেলায় সব মানুষ যেতে চায় না এটাও সত্যি। যেটা এতদিন ধরে চলছে, মানুষও ভাল-মন্দ মিশিয়ে তার সঙ্গে চলছে, সেটা থাকাই যেন ভাল, অন্ততনতুন কিছু করার ঝুঁকি নেই সেখানে!
কিন্তু এখানে ঠিক সেটা হল না। আরও কিছু হল। আর ৫০ বছর পরে তার গুরুত্ব কিছুমাত্র কমেনি— এক নতুন পথে এগিয়েছে দেশের রাজনীতি।
‘কামরাজ প্ল্যান’অনুযায়ী মোরারজি দেশাই ১৯৬৩ সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে সরে দাঁড়ালেও ১৯৬৭ সালে ইন্দিরা গান্ধীর সরকারে উপপ্রধানমন্ত্রী হিসাবে আবার যোগ দেন। দায়িত্ব নেন অর্থমন্ত্রকের।
দেশে ব্যাঙ্ক-ব্যবস্থা তখন শোচনীয়। প্রতি সপ্তাহে একটা করে ব্যাঙ্ক উঠে যাচ্ছে, অর্থাৎ ‘ফেল’করছে। আমানত উধাও, যারা ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলেছেন, তাঁরা রাতারাতি সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসছেন।
ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ডের ডিরেক্টর বলেছিলেন, ‘‘ভারতের মতো এত বিপজ্জনক ব্যাঙ্কিং-ব্যবস্থা যে দেশে চালু আছে, তাদের অত্যন্ত সাবধানে ব্যাঙ্কিং চালানো উচিত এবং প্রয়োজনও বটে।’’ ইনি ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ লর্ড জন মেনার্ড কিন্স। বক্তব্যটি প্রায় নিশ্চিত ভবিষ্যতবাণীর মতো কাজ করেছে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত।
তবু মোরারজি কয়েকটি পদক্ষেপ করেছিলেন। ১৯৬৬ সালের আগে ৫০ বছর দেশে প্রায় ১ হাজার ৮০০ ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হয়েছে।উঠে গিয়েছে।আর ১৯৪৭ থেকে ’৬৯-এর মধ্যে তার প্রায় এক তৃতীয়াংশ। মোরারজি ৩২৮ থেকে ব্যাঙ্কের সংখ্যা ৬৮-তে নিয়ে আসেন।
কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী তখন আরও অনেকটা এগিয়ে ভাবছেন। ভাবছেন সমাজতন্ত্রের কথা, তাঁর বাবা জওহরলাল নেহরুর স্বপ্নের কথা— আর তাঁর ভাবনাকে ক্রমশ আরও দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দলের মধ্যে ক্রমশ তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলার চেষ্টা। ‘সিন্ডিকেট’-এরসক্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছে।
ইন্দিরা সক্রিয় হলেন। পর পর ঘটনাগুলো ঘটে গেল। ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ, মোরারজি দেশাইকে অর্থমন্ত্রী থেকে সরিয়ে দেওয়া এবং ভিভি গিরিকে নির্দল প্রার্থী হিসাবে রাষ্ট্রপতি পদে সমর্থন করা। যেখানে সঞ্জীব রেড্ডি দলের প্রার্থী সেখানে দাঁড়িয়ে ‘বিবেকের ভোট’চাইলেন ইন্দিরা।
একা ইন্দিরা? না, একা নন। অবাধ্য অশান্ত সময়ে তাঁর পাশে এক হচ্ছে কংগ্রেসের নতুন প্রজন্ম। রয়েছেন পিএন হাকসার এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ডেপুটি গভর্নরের দল। যাঁরা গোপনে তৈরি করেন ব্যাঙ্ক-রাষ্ট্রায়ত্তকরণের কাগজপত্র।
খেয়াল করবেন, ইন্দিরা যখন ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রায়ত্তকরণের অর্ডিন্যান্স পাশ করছেন, তার পরদিন পর্যন্ত ভিভি গিরি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি পদে আছেন। বোঝা যায়, গিরি নির্বাচনে জিতবেন কি নাসে ব্যাপারেইন্দিরা তখন নিশ্চিত ছিলেন না।
কিন্তু ঘটনার পিছনে এই আঁকিবুকিগুলো আমরা কেউ মনে রাখি না, মনে রাখার কথাও নয়।
ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ ভারতের অর্থনীতির জগতে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য এবং বৈপ্লবিক কাজ। রাজনীতির জগতেও। আর ওই ’৬৯ সালের নভেম্বর মাসে ইন্দিরা গান্ধী কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হন; তৈরি হয় ইন্দিরা কংগ্রেস।
ব্যাঙ্ক জাতীয়করণকে কেন্দ্র করে রাজনীতির নতুন যুগ শুরু হয় ওই ১৯৬৯-৭০ সালে। বাকিটা ইতিহাস।
১৯৬৬ সালে কংগ্রেস সংসদ দলের সদস্যদের গোপন ব্যালটের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বী শ্রী মোরারক্ষী দেশাইকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সেই থেকে টানা এক বছর দেশের ভিতরে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানা ঘাত ও প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে তিনি এগিয়ে চলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর নিজের ভাষায়, ‘আমি যতদিন প্রধানমন্ত্রী থাকব, ততদিন ভারতবর্ষের ভাবমূর্তির কোন ক্ষতি হতে দেব না। দেশ শাসনে জনগণের কল্যাণে কোন নিয়ন্ত্রণ মানব না’।
শ্রীমতী গান্ধীর এই দশটি বছর গুরুত্বপুর্ণ। বলা যেতে পারে এই দশ বছরই ইন্দিরা-দশক। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার তের মাসের মধ্যে ’৬৭ সালের নির্বাচনে ভারতের কয়েকটি রাজ্যে কংগ্রেস বিরোধীরা ক্ষমতায় এলেন। এমনকি তাঁর নিজের রাজ্য উত্তরপ্রদেশও। প্রধানমন্ত্রীর সামনে অনেক সমস্যা। ৬৭’ সালের শেষ দিকে দেখা গেল বিশ্বব্যাপী মন্দা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। ভারতের এক তৃতীয়াংশ জায়গা জুড়ে খরা। উৎপাদন ব্যাহত। দেশ জুড়ে খাদ্য আন্দোলন শুরু হল। শ্রীমতী গান্ধী পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ‘সবুজ বিপ্লবের’ আহ্বান জানালেন।পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গের কৃষির উপর গুরুত্ব দেওয়া হল। কৃষি উৎপাদন বেড়ে গেল। কিন্তু এই সময় পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের উগ্রপন্থীদের আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকল। খুন এবং লুটপাটের ঘটনা এতই বেড়ে গেল যে বিদেশের সংবাদপত্রে হৈ চৈ দেখা দিল।
হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রাষ্ট্রপতি ডক্টর জাকির হোসেন মারা গেলেন। কংগ্রেস স্থির করল তৎকালীন লোকসভার স্পিকার নিলাম সঞ্জীব রেড্ডি কংগ্রেস দলের প্রার্থী হবেন। ওদিকে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের ব্যাপারে কংগ্রেস দলের মধ্যে অন্তর্বিরোধ তখন তীব্র। অর্থমন্ত্রী মোবারজী পদত্যাগ করলেন। সংকট আরও ঘনীভূত হল। তারপর সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে বিবেক অনুয়ায়ী রাষ্ট্রপতির নির্বাচনে ভোট দেওয়ার আহ্বানে কংগ্রেস প্রার্থী সঞ্জীব্ রেড্ডি পরাজিত হলেন। বরাহগিরি ভেঙ্কটগিরি ভারতের রাষ্ট্রপতি হলেন।
কিছুদিন পর আনুষ্ঠানিক ভাবে কংগ্রেস দল ভেঙ্গে গেল। নব কংগ্রেস ও আদি কংগ্রেস । আদি কংগ্রেস নেতারা বিদ্রোহী দলে যোগ দিলেন। এই সময় প্রধানমন্ত্রী সংবিধান সংশোধন করে রাজন্য ভাতা বিলোপ এবং ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ বিল পাশ করলেন। তারপর শ্রীমতী গান্ধী নির্দিষ্ট সময়ের এক বছর আগেই লোকসভা ভেঙে দিয়ে ’৭১ সালের গোড়ার দিকে নির্বাচনের ডাক দিলেন। শুরু হল নির্বাচনী অভিযান। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা সারা ভারতে দিনে ১০ থেকে ১২টি করে সভা করে নতুন শ্লোগান ‘গরিবী হাটাও’ নিয়ে এগিয়ে এলেন। বহু কর্ম ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি যে আমাদের কলকাতা সম্পর্কে সজাগ তা জানতে পারা যায় তৎকালীন সংবাদপত্র থেকে। নির্বাচনী প্রচারে ওই সময় প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী ছিলেন অনেক বাঙালি সাংবাদিক। তাঁরা প্রশ্ন করেছিলেন কলকাতার ভবিষ্যৎ নিয়ে। বিমানে তাঁর আসনের ডান দিকে একটি কালো ট্রাঙ্ক ছিল। ট্রাঙ্ক থেকে একটি ফাইল বের করে তাঁদের দিয়ে বলেছিলেন, লিখে নিন, ‘সি এম ডি এ দ্বিতীয় হুগলী সেতু এবং কলকাতার পাতাল রেলের ব্যাপারে আমই খুবই আগ্রহী। কেন্দ্রের সব মন্ত্রণালয়কে আমই নির্দেশ দিয়েছি, জরুরী ভিত্তিতে এই কাজ গুলি করতে হবে। কলকাতা না বাঁচলে সারা ভারতের ক্ষতি’।
সে যাক। ৭১’ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে শ্রীমতী গান্ধী তৃতীয় বারের মত ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন। ওই নির্বাচনের গত পাঁচ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনেক ওলট পালট হয়েছে।সবচেয়ে বড় ঘটনা পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ। সংসদ নির্বাচনের পর ‘৭১সালের ১৮ মার্চ নতুন মন্ত্রীসভায় শপথ গ্রহণের সাত দিনের মধ্যে অর্থাৎ ২৫শে মার্চ রাত্রে পূর্ব পাকিস্তান ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওই দেশ থেকে এক কোটি লোক এসে ভারতে আশ্রয় নেয়। ভারতের উপর অর্থনৈতিক সামাজিক চাপ আসে, বিঘ্নিত হয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রধানমন্ত্রী মুক্তিকামী সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে প্রতিশ্রুতি দিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হল, আক্রমণকারী পাকিস্তান পরাজিত হল।
বাংলাদেশকে সমর্থন করার জন্য ৭১’ সালে ডিসেম্বর মাসের তিন তারিখ পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে। ওইদিন গভীর রাতে জাতির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন মাতৃভূমি থেকে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করবই। তিনি কথা রেখেছিলেন।
ঘটনার পর ঘটনার স্রোত বইতে থাকে। ’৭১ সালের ৯ আগস্ট ভারত ও সোভিয়েট ইউনিয়নের মধ্যে ২৫ বছরের দীর্ঘমেয়াদি শান্তি মৈত্র ও সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দেশের ভিতরে ও বাইরে নানা সমালোচনা শোনা যায়। শ্রীমতী গান্ধী এরও জবাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন এই চুক্তির অর্থ এই নয় যে ভারত তার নিরপেক্ষ নীতি পরিবর্তন করেছে। শ্রীমতী গান্ধীর ‘৭২সালে ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশের সঙ্গে অনুরূপ এক চুক্তি করা হয়।
তারপর আবার দেখা দিল অর্থনৈতিক সংকট। নানা ব্যবস্থা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী সব কিছুর মোকাবিলা করলেন, মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে কমিয়ে শুন্য অঙ্কে নিয়ে এলেন। শ্রীমতী গান্ধীর আমলেই ৭৪ সালের মে মাসে ভারিত রাজস্থানের মরুভূমিতে পরমাণু বিস্ফোরণ করে। আবার আর্ন্তজাতিক দুনিয়ায় ভারত বিরোধীরা হৈ চৈ করে উঠলেন। প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট ভাষায় বলে দিলেন, না আমরা যুদ্ধের জন্য নয় – শান্তির জন্য এই পরমাণু বিস্ফোরণ করেছি।
ভারতের বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি উন্নতি এই দশকে যেমন হয়েছে তেমন কৃষি উৎপাদনও প্রচুর বেড়েছিল। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই দশকে আরো কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। হিমালয়ের কোলে ছোট রাজ্য সিকিমের রাজতন্ত্রের অবসান হয়। প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার ভিত্তিতে সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৭৫ সালের গ্রীষ্মে। তারপর সিকিমের জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী সেখানকার বিধানসভার সর্ব সম্মতি প্রস্তাব ক্রমে সিকিম ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে যোগ দেয়। ওই বছর নভেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী সিকিম সফরে গিয়ে সেখানার জনগণের বিপুল সম্বর্ধনা লাভ করেন। এবং সিকিমে উন্নতির সবরকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। ডিসেম্বর মাসে কামাগাতামারু নগরে কংগ্রেসের অধিবেশনে আনুষ্ঠানিক ভাবে সিকিম কংগ্রেস ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে মিশে যায়।
কাশ্মীর সমস্যা দীর্ঘ দিনের সমস্যা। ১৯৭৫ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি কাশ্মীরি নেতা শেখ আব্দুল্লার সঙ্গে শ্রীমতী গান্ধীর মতৈক্যের কথা সংসদে ঘোষণা করেন।তা ছাড়া দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধানে একটি চুক্তিও সম্পাদিত হয় ইন্দিরা দশকে। এর কিছুদিন পর মীরকাশিম মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করেন। এবং শেখ আব্দুল্লা কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বভার নেন। ‘৭৬ সালের জুন মাসে এলাহাবাদ হাইকোর্টের এক রায়ে রায়বেরিলি কেন্দ্র থেকে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচন বতিল করা হয়। কিন্তু ৭ই নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট ওই রায় বাতিল করেদেয়। শ্রীমতী গান্ধীর নির্বাচন বৈধ বলে ঘোষিত হয়।
‘৭৬ সালের এপ্রিল মাসে কক্ষপথে ভারত উপগ্রহ নিক্ষেপ করে। এটাও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ভারতের উল্লেখযোগ্য অবদান। এই দশকের আরও একটি উল্লেখযগ্য ঘটনা ’৭৫সালের ২৬শে জুন অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা ঘোষণা এবং চোরাশিকারীদের শায়েস্তা করার নানা ব্যবস্থা। তাছাড়া অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য তাঁর ২০ দফা কর্মসূচী বহু সমস্যার সমাধান করেছিল। ‘৭৫ সালের আরো একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা তাঁর দ্বিতীয় পুত্র সঞ্জয় গান্ধীর রাজনীতিতে আবির্ভাব। সঞ্জয় বলেছিলেন, একজন আই এস এর পুত্র যদি আই এ এস হতে পারে তাহলে একজন রাজনৈতিক নেতার পুত্রের রাজনীতিতে আসা কোন অন্যায় নয়। বস্তুত তিনি যুব কংগ্রেসের মধ্যে নতুন করে কর্মোদ্যোগ শুরু করায় কংগ্রেসের যুব শক্তির মধ্যে নতুন চেতনার সঞ্চার হয়েছিল।
উৎপীড়ন, অন্যায়,অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষিত নীতিগুলি কার্যকরী করতে কোন বাধাই মানবেন না বলে প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার ঘোষণা করেছিলেন। জরুরী অবস্থা ঘোষণার পর সার্বিক উন্নয়নের যে বিশ দফা কর্মসূচি প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন সেই সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছিলেন, জাদু একটাই তা হল কাজ। আর এই কাজের সাফল্যই আনবে প্রগতি, আনবে উন্নতি, আনবে সমৃদ্ধি।
(তথ্যসূত্র:
১- ইন্দিরা (দ্য লাইফ অব ইন্দিরা নেহেরু গান্ধী), মনোজিৎকুমার দাস ও ক্যাথরিন ফ্রাঙ্ক, অন্যধারা (২০১৪)।
২- ইন্দিরা গান্ধী: ভারতের রাজনৈতিক আকাশে একটি উজ্জল নক্ষত্র, ড. প্রেমেন আড্ডি, সঞ্চিতা।
৩- Indira Gandhi: Child of Politics (Puffin Lives), Sreelata Menon, Puffin Books.
৪- The Dramatic Decade The Indira Gandhi Years, Pranab Mukherjee, Rupa Publications (২০১৫)।
৫- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২২শে জুলাই ২০১৯ সাল।
৬- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪শে জানুয়ারি ১৯৭৬ সাল। রিপ্রিন্ট – ১৮ই নভেম্বর ২০১৭ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত