বঙ্গদেশের ক্ষণজন্মা এই প্রতিভার আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র ৩৪ বছর। তার মধ্যে ৩৪ টি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন তিনি! শুধু আয়ত্ত বললে ভুল হবে। বলা যায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন তিনি!
বঙ্গদেশের বিস্ময়কর এই প্রতিভা ছিলেন বহু ভাষাবিদ। মাতৃভাষা বাংলা-সহ মোট ৩৪ টি ভাষা জানতেন তিনি। তার মধ্যে ১৪ টিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ছিল তাঁর! তাঁর জ্ঞাত ভাষাসম্ভারের মধ্যে ছিল পালি, চীনা, তিব্বতি, সংস্কৃত, পারসিক, আরবীয়, ইংরেজি, গ্রিক এবং ল্যাটিন ভাষা।
কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা কলেজ (তৎকালীন সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ)‚ দুই প্রতিষ্ঠানেই তিনি অধ্যাপনা করেছেন ইংরেজি সহিত্যের।
তিনিই প্রথম ভারতীয় হিসেবে যোগ দেন ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিসে।
১৯০৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য শুরু হওয়া লিঙ্গুইস্টিক্স বিভাগে তিনি যোগ দেন অধ্যাপক রূপে।
ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরির (বর্তমানে কলকাতায় অবস্থিত ভারতীয় জাতীয় গ্রন্থাগার) প্রথম ভারতীয় গ্রন্থাগারিক তিনি। এই প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় গ্রন্থাগারিক ছিলেন তিনি। এই পদে প্রথম ছিলেন জন ম্যাকফার্লেন।
সম্পাদনা এবং অনুবাদে উল্লেখযোগ্য অবদান আছে তাঁর। প্যালগ্রেভের গোল্ডেন ট্রেজারি নতুন রূপে প্রকাশ করেছিলেন তিনি। মধ্যযুগীয় আরবীয় পর্যটক ইবন বতুতার ভ্রমণনামা অনুবাদ করেছিলেন তিনি। এছাড়াও তিনি বিবিধ কাজ করেছিলেন আরবীয় ব্যাকরণ নিয়ে।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে আছে ইংরেজি-পার্সিয়ান অভিধান‚ ঋক বেদের আংশিক অনুবাদ‚ লঙ্কাবতার সূত্রের সম্পাদনা। পাশাপাশি ‘বাসবদত্তা’‚ ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ – এর মতন বিখ্যাত সংস্কৃত নাটক অনুবাদ করেছিলেন তিনি।
তাঁর কাজ আজও সংরক্ষিত আছে কলকাতায় অবস্থিত ভারতীয় জাতীয় গ্রন্থাগারে। মোট ৮৮ টি খণ্ডে সাহিত্য, ভাষাতত্ত্ব এবং হিন্দু ধর্ম নিয়ে তাঁর লেখা অমূল্য গবেষণা যত্ন করে রাখা আছে সেখানে তারই নামে একটি পৃথক সংগ্রহ বিভাগ তৈরি করে।
তিনি শ্রী হরিনাথ দে। বঙ্গদেশের এক ক্ষণজন্মা স্বল্পায়ু বিস্ময় প্রতিভা।
উনিশ শতকে ভারতে রেনেসাঁ চলার সময়ে এই রেনেসাঁর কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বলা যায় বাংলা। আর বাংলায় তখন এমন এক অদ্ভুত আশ্চর্য সময় অদ্ভুত উত্তাল আর উদ্বেল হয়ে ওঠে। এ সময় আশ্চর্য নক্ষত্রের মত উজ্জ্বল জীবন ভারত তথা বাঙালির নবজাগরণকে সার্বিকভাবে বিপুল গতিতে অন্য এক দিগন্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। এক বিস্ময়কর সময়, যখন বিপুল প্রাণশক্তিতে বাংলাকে বাংলা সমৃদ্ধ জীবন ও ইতিহাসকে ভিন্নতর মাত্রায় পৌঁছে দিতে যেন আশ্চর্য সব মানুষ এক মহাপ্রাণতায় আবির্ভূত হচ্ছিলেন। এতো নক্ষত্রের সমাবেশ এর আগে বা পরে বাংলা দেখেনি। বিশেষ করে উনিশ শতকে জন্মে বিশ শতক অবধি জীবনের ব্যাপ্তিকালকে প্রসারিত করে বহু বহু প্রতিশ্রুতিবান মনীষী জীবনের নানা ক্ষেত্রে নানা মাত্রা ও পরিধি সংযোজন করে যেভাবে বাংলার সর্বকালের জীবনযাত্রায় আশ্চর্য সময়কালের পত্তন করেছিলেন, সেই প্রেক্ষিতে আজকের বাংলার দিকে তাকালে হতাশায় বিদ্ধ হতে হয়। বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায় উনিশ শতকের ১৮৬০ সাল থেকে শুরু করে ১৮৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বুদ্ধিদীপ্ত প্রাণদীপ্ত বেশ কজন মানুষ জন্মগ্রহন করে বাংলাকে বিশ্বদরবারে পরিচিতি দিলেন — বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এই বিচিত্র সময়েই বাংলার চিরবিস্ময় এক বঙ্গসন্তান মহামনীষী,বহুভাষাবিদ, আশ্চর্য প্রতিভাধর সুপণ্ডিত, শিক্ষাবিদ ও ভাষাবিজ্ঞানের বঙ্গভাষায় উদ্গাতা হরিনাথ দে জন্মগ্রহণ করেন। হরিনাথ দের প্রতিভা ও কর্মময়তা আর তাঁর অবদান সম্পর্কে বলা যায় বাঙালি আলোচক, সমালোচক ও লেখকেরা কিছুকাল সরব আলোচনা করে গেলেও, পরবর্তীতে যথোচিত বিচার – বিশ্লেষণ তেমনভাবে করেছেন বলে মনে হয় না। অথচ এই বিস্ময় মানুষটি তাঁর অপরিসীম জ্ঞানবত্তা, বহুভাষাবেত্তা, নিষ্ঠা ও প্রতিভা নিয়ে একসময় সারা পৃথিবীতে প্রভূত সম্মান লাভ করেছিলেন এবং পৃথিবীবাসীকে স্বল্পস্থায়ী জীবনে চিরস্থায়ী বহু সম্পদ দান করে বিস্মিত করে গেছেন। বাংলা ভাষায় তাঁর পারঙ্গমতা ও কৃতিত্ব বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারকে, বিশেষ করে ভাষাবিজ্ঞানের ভারতীয় পথিকৃৎ হিসেবে তাঁর কার্যকলাপ অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি দিতে পেরেছে। এই বঙ্গবাসী ও সম্মানিত বঙ্গসন্তানের জন্য আমরা যুগপৎ সম্মান ও গৌরব অনুভব করি। আর বহু ভাষাবিদ হিসেবে তাঁকে নিয়ে অনুভব করি অপার বিস্ময়।
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়িয়ে ধর্মতলা স্ট্রিট ধরে বাড়ি ফিরছেন হরিনাথ। আচমকা দেখলেন রাস্তার মোড়ে লোকজনের জটলা।
দু’পা এগিয়ে যেতেই নজরে এল, এক যুবক তারস্বরে বক্তৃতা করছেন। তাঁকে ঘিরে যাঁরা, তাঁরা তাঁর একটি শব্দও বুঝছেন না। গুঞ্জন তাই নিয়ে। কিন্তু যুবকটির তাতে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি উত্তেজিত হয়ে বক্তৃতা করেই চলেছেন।
হরিনাথ কিন্তু একটু দাঁড়িয়েই বুঝে গিয়েছেন, ভাষাটি আরবি। এবং ধর্ম নিয়ে কোনও এক বিতর্কিত বক্তব্য রাখতে চাইছেন যুবক। এতক্ষণে কেউ বোঝেননি, তাই রক্ষে। কিন্তু কেউ যদি বুঝে ফেলেন, তো মহা বিপদে পড়ে যেতেই পারেন যুবক।
অপেক্ষা না করে হরিনাথ তখনই সটান বক্তার কাছে গিয়ে আরবি ভাষাতেই ওঁকে বুঝিয়েসুঝিয়ে ভিড় থেকে বের করে আনলেন।
আলাপচারিতায় জানতে পারলেন, যুবকের নাম ছিল ‘রিজকুল্লাহ মালাতি’। নিবাস মিশর। হরিনাথ তাঁকে ঠাঁই দিলেন নিজের বাড়িতে।
প্রায় দু’বছর টানা হরিনাথের কাছেই ছিলেন এই মিশরীয়-যুবক। অতিথির সেবার জন্য অন্য সব উপসর্গ তো ছিলই, সেই সঙ্গে হরিনাথ তাঁকে নিয়মিত একটি মিশরীয় সংবাদ পত্রও জোগান দিয়েছিলেন। সে-কালে শহর কলকাতায় প্রায়-দুঃসাধ্য এই কাজটি হরিনাথ যে কী ভাবে সম্ভব করতেন, কে জানে! কিন্তু হরিনাথ ছিলেন এমনই। শুধু নিজ-ভাষাভাষী বলে নয়, অন্য ভাষীর প্রতিও তাঁর টান ছিল তীব্র।
কে এই হরিনাথ? হরিনাথ দে। চৌত্রিশ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবন কাটিয়ে তিনি যখন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করছেন, তত দিনে কুড়িটি ইউরোপীয় ভাষা, চোদ্দোটি ভারতীয় ভাষা কব্জা করে ফেলেছিলেন।
হরিনাথ দে পশ্চিমবঙ্গের কামারহাটির আড়িয়াদহ গ্রামে ১২ আগস্ট ১৮৭৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতার কাছাকাছি এই গ্রাম বর্তমান উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত। তাঁর পিতা ভোলানাথ দে রাইপুর সেন্ট্রালের ( বর্তমান ছত্তিশগড়) ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের একজন পদস্থ অফিসার ছিলেন। রাইপুরে যে বাড়িতে শৈশবে হরিনাথ দে বসবাস করেন, সে বাড়িতে ১৮৭৭ সাল থেকে ১৮৭৯ সাল অব্দি তরুণ নরেন্দ্র নাথ দত্ত বাস করেন। নরেন্দ্র নাথ দত্ত পরবর্তীতে স্বামী বিবেকানন্দ রূপে বিশ্ব বন্দিত হন।
হরিনাথ শৈশবের পড়াশোনা রাইপুর হাই স্কুলে করেন এবং পরবর্তী পড়াশোনার জন্য কলকাতা যান। এখানে এসে কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল ও কলেজে পড়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৮৯৩ সালে হরিনাথ প্রেসিডেন্সির ছাত্র হিসেবেই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল্যটিন ও ইংরেজি ভাষায় প্রথম শ্রেণীতে ষান্মানিক স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং এই বছরই তিনি কলিকাতা খ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল্যাটিন ভাষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান নিয়ে পাশ করে সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। এরপর কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষালাভের জন্য বিলেতে গেলেন। সেখানে ক্রাইস্ট’স কলেজে ভর্তি হন। কেম্ব্রিজে পড়ার সময়েই হরিনাথ গ্রীক ভাষায় এম.এ.-তে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হলেন। এই পরীক্ষা তিনি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে দিয়েছিলেন। ঠিক একই সময়ে হরিনাথ প্যারিসে গিয়েছিলেন, সেখানে সরবোনস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ভাষা শেখেন। এরপর ইজিপ্ট গিয়ে আরবি ভাষা শেখা শেষ করেন।
আরবি ভাষা শেখা শেষ করে হরিনাথ জার্মানির মারমুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের জন্য গেলেন। এখান থেকে তিনি সংস্কৃত, তুলনামূলক ব্যাকরণ এবং আধুনিক ভাষা শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান আহরণ করেন।
১৯০০ সালে তিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত ‘ক্লাসিক্যাল ট্রাইপস্’ পরীক্ষার প্রথম ভাগ দিলেন এবং এই পরীক্ষায়ও প্রথম শ্রেণীতেই উত্তীর্ণ হলেন। পরের বছরই তিনি মধ্যযুগীয় আধুনিক ভাষায় ট্রাইপস্ পরীক্ষায় ডিগ্রি অর্জন করলেন। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হরিনাথ দে গ্রীক, ল্যাটিন, হিব্রু ভাষায় শিক্ষা লাভ করে পারঙ্গমতা দেখিয়েছিলেন।
১৯০১সালের শেষ দিকে হরিনাথ দে দেশে ফিরে এলেন। সে সময় পর্যন্ত ভারত সরকারের শিক্ষাবিভাগে উচ্চপদের বৃত্তিতে ভারতীয়দের নিয়োগ করা হতোনা। হরিনাথ বিদেশ থেকে দেশে ফেরার পর তাঁকে ঢাকা সরকারি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এক নীরব বিপ্লবে নিজের যোগ্যতা দিয়েই সেদিন জয়ী হলেন এই বহুভাষাবিদ বঙ্গসন্তান। তিনি বিদেশী শাসকের শিক্ষা বিভাগে উচ্চপদে নিযুক্ত প্রথম ভারতীয়।
১৯০৫ সালে হরিনাথ বদলি হলেন কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজির অধ্যাপকরূপে। অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত থাকলেও তিনি ছিলেন এক চিরপিপাসু শিক্ষার্থী। বিশ্বের বহু বিচিত্র ভাষা, তাদের উদ্ভব, গতি ভঙ্গিমা আর সম্পদের প্রাচুর্য হরিনাথকে একদিনের জন্যও আকর্ষণ বিমুক্ত করেনি। এই মৌলভাবনায় আকৃষ্ট হয়ে তিনি একটার পর একটা ভাষা নিয়ে প্রতিনিয়ত চর্চায় নিরত থেকেছেন,একের পর এক পরীক্ষা দিয়ে গেছেন, সম্মানের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে বোধহয় একটা সত্যের কাছাকাছি আমরা যেতে পারবো — ভাষাচর্চার ক্ষেত্রে তিনি কেন বারবার পরীক্ষার সামনাসামনি হলেন, কেনইবা সেসব পরীক্ষায় সর্বোত্তম হতে চাইলেন, এই বিষয়টা। ভাষাচর্চা কি তাহলে কেবল পরীক্ষা নির্ভর মাত্র? এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায় ভাষাচর্চা ব্যক্তির স্বকীয় প্রয়াস, নিষ্ঠা এবং নিরলস সাধনার উপর উৎকর্ষতার জন্য নির্ভরশীল হতে পারে সত্য, তবে পরীক্ষার মাধ্যমে যখনই এই চর্চাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তখন পূর্বজদের সমৃদ্ধ চিন্তা ভাবনার নিরীখে একটা সুনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে সেই ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা একটা গণ্ডীরেখার মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্যপথে আরো সুনিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালিত হতে পারে। অধ্যাপক ড. রণেন্দ্রনাথ দেবের বক্তব্য অনুসারে, “প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতি কোনদিনই মানুষের শিক্ষার ব্যাপারে শেষ কথা বলতে পারেনা। আসলে পরীক্ষা মানুষের মনের দরজা জানালাগুলো খুলে দেয় মাত্র। এই খোলা পথে বিচরণ করে আমরা বিশ্বব্যাপ্ত শিক্ষালয়ের অঙ্গনে প্রবেশাধিকার পাই মাত্র। পরীক্ষার শেখাটা হচ্ছে পাসপোর্ট — এ নিয়ে মানুষ জানার জগতে, জ্ঞানের উন্মুক্ত জগতে একা চলার, সংগ্রহ করার অধিকার অর্জন করে। আর তখনই সে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের, সাঙ্গীকরণের সুযোগ পায়।”
১৯০৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনাকালে হরিনাথ আবারও পরীক্ষার্থী হয়েছেন। সংস্কৃত, আরবি ও ওড়িয়া ভাষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এমনকি সরকারের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা পারিতোষিক লাভ করেছেন। আজকের দিনে এই টাকার মূল্য হাস্যকর। কিন্তু যখনকার কথা বলা হচ্ছে তখন তা বিশাল।
পরবর্তী বছরেই, ১৯০৬ সালে প্রাইভেট (স্বাধীন) পরীক্ষার্থী হয়ে হরিনাথ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পালি ভাষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এম.এ.পাশ করেন। ১৯০৭ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুনভাবে শুরু বই ভাষাবিজ্ঞানের (Linguistics) বিভাগ। এই বিভাগেও মনীষী হরিনাথ দে কে প্রথম অধ্যাপকরূপে নিয়োগ দেওয়া হয়। কলকাতায় ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরী স্থাপিত হবার পর এতে বিলেত থেকে ‘জন ম্যাকফারসন’ প্রথম লাইব্রেরীয়ান হয়ে যোগদান করেন। তিনি লণ্ডনে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সহকারী গ্রন্থাগারিক ছিলেন। কলকাতার ইম্পিরিয়্যাল লাইব্রেরী বর্তমানে ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরী অফ ইণ্ডিয়া’। জন ম্যাকফারসন পরলোকগত হলে দ্বিতীয় লাইব্রেরীয়ান হন হরিনাথ দে। সেকালের ও একালের সম্মানিত এই লাইব্রেরী অফুরন্ত জ্ঞানভাণ্ডার যেখানে স্তরে স্তরে সজ্জিত থেকে জ্ঞান মহাসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালার গভীর নির্ঘোষ উচ্চারণে মুখরিত। ভারতীয় হিসেবে পরাধীন দেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি শ্লাঘার। কারণ হরিনাথ দে হচ্ছেন সেই বিদগ্ধ ভারতীয় ও বাঙালি, যিনি প্রথম ভারতীয় ও বাঙালি হিসেবে এই বিরল সম্মান লাভ করেন। আরেকটু ব্যাখ্যা করে বলা যায়, হরিনাথ দে’র মত বহুভাষাবিদ, অগাধ পাণ্ডিত্যের সমুদ্র, ভাষাবিজ্ঞানীরই উপযুক্ত এই পদে নিয়োগ পদটির সম্মান যেমন বাড়ালো, তেমনি ভারতীয় তথা বাঙালি প্রতিভা বিশ্ববিদ্বদ্ সমাজে স্বীকৃতি পেলো।
ইম্পিরিয়্যাল লাইব্রেরীতে দায়িত্বপূর্ণ কাজ করার সময়েও হরিনাথ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত ভাষার দুটি বিভাগে এম.এ.পরীক্ষা দেন। দুটিতেই প্রথম বিভাগে প্রথম হন। একজন ইতিহাসবিদ, বিদ্বান ও বহুভাষাবিদ হরিনাথ দে তখনকার ইম্পিরীয়্যাল লাইব্ররি আর বর্তমান ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ ইণ্ডিয়ার প্রথম লাইব্রেরিয়ান হয়ে ১৯০৭ সাল থেকে ১৯১১সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। চৌদ্দটি ভাষায় এম.এ. পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। চৌদ্দটি ভারতীয় ভাষা, এশীয় ও ইউরোপীয় ভাষাসমূহের ২০টি ভাষায় ছিলো তাঁর পারদর্শিতা। অর্থাৎ সর্বমোট চৌত্রিশটি ভাষায় তাঁর কিংবদন্তীতূল্য অধিগম্যতা ছিলো। ভারতে প্রথম ভাষাবিজ্ঞান বা Linguistics-এর পথিকৃৎ ছিলেন হরিনাথ দে। ‘এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গলের’ সঙ্গে ছিলো তাঁর ঘনিষ্ঠতা। বহুভাষাবিদ হরিনাথ দে সম্পর্কে একটা কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়, তিনি যেসব ভাষা শিখেছিলেন, সেসব ভাষার মর্মস্থলে তিনি প্রবেশও করেছিলেন। মাতৃভাষার মত প্রতিটি ভাষায় সাবলীলভাবেই তিনি বার্তালাপ, লেখালেখি ও চিন্তাভাবনায় সক্ষম ছিলেন। মোদ্দাকথা প্রতিটি ভাষার সঙ্গে তাঁর সখ্যতা তাঁকে ভাষার অন্দরমহলে প্রবেশাধিকার দিয়েছিল। আরও উল্লেখ করতে হয় অতীত ভাষাসমূহের উৎপত্তি, বিকাশ ও সমৃদ্ধির বিষয়েও তাঁর জ্ঞান ছিলো অপরিসীম। বলতে হয় তিনি শুধু ভাষাবিদ ছিলেন না ছিলেন ভাষাবিজ্ঞানীও, আর এই বিষয়ে এই বঙ্গসন্তান ছিলেন অন্যান্য ভারতীয়দের পথিকৃৎ।
সুপণ্ডিত হরিনাথ দে, ‘ম্যাকুলে’স এসে অন মিল্টন’ (Macaulay’s Essay on Milton) গ্রন্থের একটি নতুন সংস্করণ ১৯০২ সালে প্রকাশ করেন। পরের বছর তিনি আরেকটি বিস্ময়কর প্রকাশনার কাজ সম্পন্ন করেন। ‘প্যালগ্র্যাভস গোল্ডেন ট্রেজারি’ (Palgrave ‘s Golden Treasury) বইটির নবরূপায়ন করে সম্পাদনা ও প্রকাশনা দুটিই করলেন। এরপর হরিনাথের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ইবন বতুতা রচিত বিখ্যাত ভ্রমণ কাহিনী ‘রিহলা’ (Rihla) – এর ইংরেজী অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশ। তিনি জালালউদ্দিন আবু জাফর মোহাম্মদের গ্রন্থ ‘আল্ ফাকরি’ (Al Fakhri) – এরও ইংরেজী অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। এছাড়া তিনি আরবি ভাষার ব্যাকরণ নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ লেখেন।
হরিনাথ দের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলির অন্যতম হচ্ছে ‘ইংরেজী – পারসিক’ অভিধান রচনা। তিব্বতী ভাষারও একটি অভিধান তিনি রচনা করেন। হরিনাথ ঋগবেদের একটা অংশ, উপনিষদ ও মূল শ্লোক সহ টীকাভাষ্য ভাষ্য সহকারে তিনটি ভাষায় অনুবাদও করেছিলেন।
হরিনাথ দে এছাড়াও বহু বিখ্যাত গ্রন্থের টীকাকরণ, সম্পাদনা ও অনুবাদের কাজ সম্পন্ন করেছেন। বহু গ্রন্থ ও সাহিত্যের পাণ্ডুলিপি, ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ক পার্শিয়ান, চীনা, তিব্বতী ও সংস্কৃত ভাষায় রচিত রচনাসমূহের সম্পাদনা, টীকাভাষ্য রচনা ও অনুবাদ কর্মও সাবলীলভাবে করেছেন। বৌদ্ধ ধর্ম সংক্রান্ত ‘লঙ্কাঅবতার সূত্র’ ও ‘নির্বাণ ব্যাখ্যা শাস্ত্রম্’ সম্পাদনা করে তিনি প্রকাশ করেছিলেন। বহু আরবি, ফারসি, পার্শিয়ান, পালি ও বাংলা গ্রন্থেরও পূর্ণ বা আংশিক অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলেন। কয়েকটি সংস্কৃত নাটকেরও ইংরেজি অনুবাদ করে তিনি প্রকাশ করেন, যেমন সংস্কৃত নাট্যকার সুবন্ধু রচিত ‘বাসবদত্তা’ নাটকটি। মহাকবি কালিদাস রচিত ‘অভিজ্ঞানম শকুন্তলম’ ইত্যাদি। তাঁর স্বকীয় সৃষ্ট সাহিত্য, ভাষাবিজ্ঞানীদের, ও হিন্দুধর্ম বিষয়ক নানা রচনায় ৮৮টি ভল্যুম ‘Harinath Details Collection’ নামে পরিচিত এবং তা কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরী অফ ইণ্ডিয়াতে সংরক্ষিত অতি মূল্যবান সম্পদ। বহু পত্রপত্রিকায় হরিনাথ দে রচিত অনেকানেক মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিলো। তার কিছু সংখ্যক ১৯৭২ সালে সংকলিত ও সম্পাদনা করে সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায় কলিকাতা সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার থেকে প্রকাশ করেছেন। এই সংকলন গ্রন্থটির নামকরণ করা হয়েছে — “Select Papers, Mainly Idiological” — ইংরেজিতে রচিত এই সংকলন অত্যন্ত মূল্যবান সংগ্রহ। কলকাতায় ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ ইন্ডিয়া তে সংরক্ষিত, ‘সেন্টিনারী ভল্যুম, হরিনাথ দে, জাতীয় গ্রন্থাগার, ১৯৭৭’, অত্যন্ত মূল্যবান ও তথ্যসমৃদ্ধ সংগ্রহ, যা কৌতূহলী পাঠকের কাছে মনীষী হরিনাথ দে সম্পর্কে মূল্যবান আকর গ্রন্থ বলে পরিগনিত হয়।
ভাষা আর হরিনাথ। হরিনাথ আর ভাষা। ওইটুকু জীবনে এ-দুইকে ঘিরে কত যে গল্প!
ইতালি। ভ্যাটিকান সিটি। পোপ দশম পিউসের সামনে হরিনাথ। পোপকে চোস্ত লাতিন ভাষায় অভিবাদন জানালেন বাঙালি যুবক। হরিনাথের চোখা চোখা লাতিন উচ্চারণে স্তম্ভিত পোপ। পরামর্শ দিলেন, এ বার ইতালীয়টাও শিখে ফেললে হয় তো!
পোপকে স্তম্ভিত করে দিয়ে হরিনাথ এর পর তাঁর সঙ্গে সরাসরি ইতালীয়তেই কথা বলতে শুরু করে দিলেন!
হরিনাথের ল্যাটিন-দক্ষতা চমকে দিয়েছিল লর্ড কার্জনকে। আরবি ও পার্সি থেকে অনুবাদ করে তিনি সাহেবকে একটি বই উপহার দেন। বইটির উৎসর্গ পত্রটি ছিল ল্যাটিনে লেখা। তাতে এতটাই হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন কার্জন, যে ঢাকায় গিয়ে তিনি ডেকে পাঠান হরিনাথকে। হরিনাথ তখন ঢাকার এক কলেজের অধ্যাপক।
ভাষা নিয়ে হরিনাথকে ঘিরে এই যে অবাক-করা সব কাহিনি, তার শুরু কিন্তু শিশুকাল থেকেই।
তেমনই এক সময়ের কথা।
শিশু হরিনাথের তখনও অক্ষরজ্ঞান হয়নি। রায়পুরের বসত বাড়িতে তাঁর মা সব্জি কাটতে কাটতে ছোট্ট ছেলেকে তরকারির খোসা দিয়ে বাংলা বর্ণমালা বানিয়ে দিচ্ছিলেন।
ঘণ্টাখানেক এমন চলার পর দেখা গেল, সেই খোসা আর কাঠকয়লা দিয়ে ঘরময় বাংলা হরফ লিখে ফেলেছে কচি ছেলেটি!
অল্প একটু বড় হতে, আবারও সেই অবাক-কাহিনি।
যাতায়াত ছিল বাড়ির পাশের এক খ্রিস্টান মিশনে। এক ফাদারের কাছে বাইবেল পড়ত খুদে হরিনাথ। এক দিন ফাদার অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করলেন, ছেলেটি আস্ত বাইবেল হিন্দিতে অনুবাদ করতে শুরু করেছে!
প্রেসিডেন্সি কলেজ। ভাষাতত্ত্বের ক্লাস চলছে। পড়াচ্ছেন অধ্যাপক এফজে রো। ভাষা পরিবর্তনের একটি জটিল বিষয় নিয়ে তিনি প্রশ্ন করেছেন। সকলেই অপ্রস্তুত। কী জবাব হবে ভেবে পাচ্ছে না কেউই।
অধ্যাপকের অনুমতি নিয়ে ব্ল্যাক বোর্ডের কাছে চলে গেল ছাত্র হরিনাথ। চক দিয়ে খস খস করে লিখে ফেলল উত্তর। বুকে জড়িয়ে ধরলেন অধ্যাপক রো। সে দিন থেকে তিনি ছাত্রকে রোমের বিখ্যাত দার্শনিক ও গদ্যকারের নামে ‘উপাধি’ দিলেন ‘সিসেরো’!
শুধু ক্লাস নয়, ভাষা নিয়ে হরিনাথের পরীক্ষায় বসাটাও ছিল অনেক সময়ই গল্পে ভরা।
পালি-র এমএ পরীক্ষা। সিক্স্থ পেপারের প্রশ্নপত্রে ‘ধনিয়সূত্ত’র (পালির জটিল একটি পাঠ) কয়েকটি পঙক্তি চোখে পড়তে উত্তর লেখা মাথায় উঠল। হলে বসেই সেটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ না করে শান্তি পেলেন না কিছুতেই!
আরেক বারের কথা।
সংস্কৃত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ভীষণ কঠিন হয়েছে। হরিনাথ তখন অধ্যাপক তো বটেই, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট-সদস্যও। প্রতিবাদ করলেন। আর তার জন্য হরিনাথের সংস্কৃত ভাষা জ্ঞান নিয়ে বাঁকা বাঁকা মন্তব্য ছুটে আসতে লাগল পণ্ডিত-কুল থেকে। হরিনাথের তা সইল না। ঠিক করলেন জবাব দিতে হবে। বসে পড়লেন সংস্কৃত এমএ পরীক্ষায়। স্যারের পাশে বসেই সে-পরীক্ষা দিয়েছিলেন ছাত্র সুরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। তাঁরই বর্ণনা থেকে জানা যাচ্ছে, হরিনাথ নিজের পরীক্ষার খাতায় টানা বসে লেখেননি সে দিন। মাঝেমাঝেই উঠে গিয়ে ছাত্ররা কেমন পরীক্ষা দিচ্ছে, তার খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। তা সত্ত্বেও ফল বেরোতে পণ্ডিতকুল টের পেয়ে গিয়েছিলেন, হরিনাথ দে-র সংস্কৃত-জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা কী মুর্খামি হয়েছে!
ভাষায় এত স্কলার, অথচ সেই পণ্ডিত মানুষটি কিন্তু বিএ পরীক্ষায় দর্শনে ফেল করেছিলেন! ইংরেজি, লাতিনে যথারীতি হাই-ক্লাস নম্বর পেয়েও পাশ করেননি দর্শনে। অনার্সের নম্বর কেটে তাকে পাশ করানো হয়।
ছোটবেলাতেও এমন ঘটনা আছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, এক সহপাঠীর বাবা হরিনাথকে প্রচণ্ড বকুনি দিচ্ছেন, কেননা সে তাঁর ছেলেটিকে ‘গোল্লায়’ পাঠাচ্ছে, তাই।
রায়পুরের সরকারি স্কুল। অঙ্ক ক্লাসটা একদম না-পসন্দ হরিনাথের। পাশেই বসে ক্লাসের সেরা ছেলে নাটু। সে অঙ্কে তুখড়। হরিনাথের সঙ্গে তার খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল। এক দিন খেলার জন্য নাটুকে ডাকতে গিয়েছে হরিনাথ। এগিয়ে এলেন নাটুর বাবা। ডাক্তার উমেশচন্দ্র মিত্র। একচোট বকুনি খেতে হল উমেশচন্দ্রের কাছে। পড়া ছেড়ে খেলা! ভাবখানা এমন যেন, পড়াশুনোয় তো ভাল নয় হরিনাথ, তাই বুঝবে কী, নাটুর মতো ভাল হতে গেলে কতটা পড়াশুনো করতে লাগে!
এর পরের ঘটনা অবশ্য কিঞ্চিৎ অন্য রকম।
হরিনাথ গোটা ঘটনার কথা জানাল তার বাবা ভূতনাথকে। ভূতনাথ ছেলেকে কথা দিলেন ছেলে যদি ভাল রেজাল্ট করে তার পছন্দমতো বই কিনে দেবেন তিনি। অঙ্কে কাঁচা হরিনাথ মিডল স্কুল পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে বৃত্তি নিয়ে পাশ করল। কথা রেখেছিলেন ভূতনাথও। স্থানীয় ‘পারসির দোকান’ থেকে কিনে দেন ছেলের পছন্দের সাহিত্য আর ভাষার বই।
এর পরের ঘটনাটি আরও খানিক অদ্ভুত।
কলকাতা। রিপন স্ট্রিটে ম্যাগ্রা সাহেবের কাছে কিছু দিন কাটালেন হরিনাথ। ভর্তি হলেন সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। এনট্রান্স পরীক্ষা দেওয়ার আগে আচমকা ঘটল এক দুর্ঘটনা। ডান চোখে আঘাত। চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। পড়াশোনা সব বন্ধ।
তখন সহপাঠীরা এসে মাঝেসাঝেই হরিনাথকে পড়া শুনিয়ে যেতে লাগল। খুব আশা যদি কোনও ক্রমে হরিনাথ উদ্ধার পায়। উদ্ধার তো পেলই হরিনাথ, মিলল বৃত্তিও।
ভাষার প্রতি প্রবল আকর্ষণের পাশাপাশি দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রহ ছিল হরিনাথের অনন্ত নেশা। তবে তাকে যে নিজের বলে একেবারে আগলে বেড়িয়েছেন, তেমনটা তো নয়ই, বরং উল্টো।
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ানোর সময় যেমন।
এক দিন দেখলেন সহকর্মী হেনরি অর্নেস্ট স্টেপলটন এক জটিল সমস্যায় পড়েছেন। কী ব্যাপার? এগিয়ে এলেন হরিনাথ। হেনরির সঙ্গে কথা বলে একটা সমাধান-সূত্র বার করলেন। নিজের সংগ্রহ থেকে ওঁকে এনে দিলেন ‘পূর্ববঙ্গের জাতি, বর্ণ ও ব্যবসা-বাণিজ্য’ নামের একটি বই। বহু কষ্টে জোগাড় করা। সে যে কতটা দুষ্প্রাপ্য শুনুন—মোটে বারোটি কপি ছাপা হয়। তার একটিই ছিল হরিনাথের কাছে। এর পরেও সহকর্মীর প্রয়োজনে সেটিও তাঁর হাতে তুলে দিতে তিলমাত্র ভাবলেন না হরিনাথ।
দুষ্প্রাপ্য বইয়ের জন্য কী না কী করেছেন হরিনাথ! কোথায় না কোথায় গিয়েছেন। হঠাৎ একদিন চলে গেলেন বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। আঁতিপাঁতি করে খুঁজে বের করলেন কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’-এর প্রাচীনতম পুঁথিটি। এমনি করেই পার্সি ও তুর্কি ভাষায় লেখা বৈরাম খানের একমাত্র পাণ্ডুলিপি থেকে ওয়ারেন হেস্টিংসের স্বহস্তে লেখা চিঠি, দারা শিকোর করা বেদের পার্সি অনুবাদ— এ সবই ছিল হরিনাথের নিজস্ব সংগ্রহে।
শোনা যায়, সেই সময়ে প্রতি মাসে ছ’শো টাকারও বেশি বই কিনতেন তিনি।
একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে লেখা হয়, মৃত্যুর সময় হরিনাথের সংগ্রহে ছিল হাজার সাতেক পুঁথি ও বই। যার আনুমানিক দাম, ১৯১১ সালের হিসেবে প্রায় ২৫ হাজার টাকা। দুর্ভাগ্য, হরিনাথের এই সংগ্রহশালাকে সম্পূর্ণ ভাবে রক্ষা করতে পারা যায়নি। কোনও এক কারণে, মাত্র হাজার তিনেক টাকায় তা বিক্রি হয়ে যায়।
সংগ্রহশালাটি গিয়েছে। এ বার বোধ হয় তাঁর সম্পাদিত অজস্র বই, লেখাপত্রেরও একই দশা হতে চলেছে!
স্টেপলটনের পাশে যেমন দাঁড়িয়েছিলেন, তেমন অন্যকে গবেষণায় সাহায্য করাটি ছিল যেন, হরিনাথের এক ধরনের নেশা।
অন্তত দু’টি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে।
প্রথমটি ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের। তখন ঔরঙ্গজেবের শাসনকাল সম্পর্কে গবেষণার উপাদান সংগ্রহ করছিলেন যদুনাথ। তিনি আবার তখন পটনা কলেজের অধ্যাপকও। যদুনাথ ভারী বিপদে পড়েছিলেন একটা পার্সি পুঁথি ঘাঁটতে গিয়ে। পার্সিতে তিনি সুপণ্ডিত। তবু অনেক চেষ্টাতেও বুঝতে পারছিলেন না কয়েকটি শব্দের অর্থ। অগত্যা হরিনাথের শরণাপন্ন হলেন। দেখামাত্র হরিনাথ শব্দগুলির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বুঝিয়ে দিলেন যদুনাথকে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি আরেক ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে। রাখালদাস তখন বাংলাদেশের ইতিহাস লিখছেন। খবর পেয়ে হরিনাথ সাগ্রহে রাখালদাসের কাছে গিয়ে তাঁর সংগ্রহে থাকা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ নথি দিয়ে এলেন রাখালদাসকে।— রাজা হরিবর্মদেবের তাম্রলেখ।
উদারমনা, অসম্ভব উদ্যমী পণ্ডিত এই মানুষটি জীবনের শেষ নিঃশ্বাসটি ফেললেন মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়েসে!
জাতীয় গ্রন্থাগারে কর্মরত অবস্থায় ১৯১১ সালে ৩০ আগস্ট তারিখে বাংলা তথা ভারতের এই মহিমান্বিত প্রতিভার বিমূর্ত মূর্তি হরিনাথ দে মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে পরলোকগত হন।
টাইফয়েড হল। তিন-চারটি দিন অচেতন অবস্থাতেই পড়ে রইলেন। দিনভর চেষ্টা করলেন নীলরতন সরকার, হরিনাথ ঘোষ, প্রাণধন বসুর মতো সেকালের সব নামকরা ডাক্তার।
তবু হরিনাথকে ধরে রাখা গেল না।
একটা কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে, মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স চৌত্রিশ বছর, আর পৃথিবীর উন্নত ভাষাসমূহের চৌত্রিশটি ভাষা সম্পর্কে তাঁর কিংবদন্তীতুল্য অপার জ্ঞান!
এই প্রবাদপ্রতীম বহু ভাষাবিদ কেবলমাত্র বাংলা বা ভারতের সীমানায় তাঁর খ্যাতি নিয়ে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। বিশ্ব জোড়া ভাষার বিস্তৃত পরিসরে ও বিশ্ববাসীর নিকট অভূতপূর্ব ভাষাজ্ঞানী, বহুভাষাবেত্তা এবং অপার পাণ্ডিত্য নিয়ে সম্মানের আসন লাভ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলার কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত পরম শ্রদ্ধায় উচ্চারণ করেছিলেন,
… ‘যাচ্ছে পুড়ে নতুন করে সেকেন্দ্রিয়ার গ্রন্থমালা’ …
(তথ্যসূত্র:
১- Harinath De by Sunil Bandopadhyay and Aditi Mukherjee, National Book Trust India (২০০৮)।
২- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ই ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সাল।
৩- শ্রীমতী সুনীতি দেবনাথ মহাশয়ার লিখিত প্রবন্ধ। মূল লেখার লিংক:
https://sunitidebnath.blogspot.com/2017/09/blog-post.html?m=1)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত