রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, ডাক্তার থেকে শুরু করে ইঞ্জিনিয়ার নানাক্ষেত্রের মানুষদের জীবন ও কাজ নিয়ে বহু আলোচনা, গ্রন্থ লেখা হয়। এসবের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানানো বা স্মরণ করা হয় তাদের। ইদানিং নামী লেখক- সাংবাদিক, গবেষকরাও এই তালিকায় জায়গা পেয়েছেন। ব্রাত্য রয়ে গেলেন শুধু চিত্রসাংবাদিকরা। দীর্ঘদিন কলকাতার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাগজে চিত্রসাংবাদিকতা করার সূত্রেই আমি জানি তাদের কাজের গুরুত্ব ও ঝুঁকি মোটেই কম নয়। তারাই দশকের পর দশক করে চলেন বদলানো সমাজ ও সময়ের নিখুঁত ডকুমেন্টেশন। যা ছাড়া ইতিহাস থাকে অসম্পূর্ণ। অথচ তাদের জীবদ্দশায় কিংবা মৃত্যুর পরও তাদের নিয়ে কোন আলোচনা, গ্রন্থ রচনা, শ্রদ্ধা জানানো তো দূরের কথা বার্ধক্যেও তাদের খোঁজখবর নেওয়ার কোন লোক থাকে না। প্যাটদা মানে দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার প্রয়াত চিত্রসাংবাদিক, ভারতের আধুনিক চিত্রসাংবাদিকতার অন্যতম প্রাণপুরুষ সুব্রত পত্রনবীশের শোকসভার চিঠি পেয়ে অনেক ক্ষোভে, দুঃখে কয়েকটা কথা লিখে ফেললাম। ভুল বললে নিজগুণে মার্জনা করবেন। এই শোকসভায় প্যাটদা ছাড়াও আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ট বন্ধু পিটিআইয়ের বিশিষ্ট চিত্রসাংবাদিক কে কে রায় ও সর্বভারতীয় চিত্রসাংবাদিকতায় এক উজ্জ্বল নাম সৌমিত্র ঘোষের প্রতিও শ্রদ্ধা জানানো হবে।
আমি যখন আশির দশকে চিত্রসাংবাদিকতায় এলাম প্যাটদা তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। সাহেবি আদবকায়দা, অথচ বাজে সাহেব নন, নিখুঁত ভদ্রলোক। আমাদের মত এলেবেলেদের প্রতিও তিনি ছিলেন সমান সহমর্মী ও সহানুভূতিশীল। অথচ ষাটের দশকে খাদ্য আন্দোলন ও সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনের ছবি তোলার সুবাদে তখনই তিনি হয়ে উঠেছেন জীবন্ত ইতিহাস। স্টেটসম্যানের ছবি তখন গোটা দেশের আলোচনার বিষয়। আগামীকাল ১৩ই জুলাই, শনিবার, বিকেল ৪টার সময় ক্যালকাটা স্পোর্টস জার্নালিস্ট ক্লাবে আমার আলোকচিত্রী বন্ধুরা সুব্রতদা, কে কে, এবং সৌমিত্রর স্মরণসভার যে আয়োজন করেছে তার জন্য কোন সাধুবাদই যথেষ্ট নয়। সবকিছু ভুলে যাওয়ার, অস্বীকার করার এই কালো সময়ে অন্তত অনুরাগী ও সতীর্থরাও তো তাদের একটু মনে করলেন।
সুব্রতদা নিঃশব্দে চলে গেলেন। অনেকেই জানেন না তার সমসাময়িক আরও দুই বিখ্যাত আলোকচিত্রী তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অলক মিত্র গুরুতর অসুস্থ হয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি রয়েছেন। বাংলার চিত্রসাংবাদিকতায় এই দুজনের অবদানও কম নয়। প্রার্থনা করি তারা দুজনেই দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন, আরও অনেকদিন থাকুন আমাদের মধ্যে। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস নবীন প্রজন্মকে প্যাটদা, তারাপদদা এবং অলকদার কাজ বহুদিন অনুপ্রাণিত করবে। এদের একেকটা ছবি তোলার গল্পটাই যেন এক রহস্য উপন্যাস। আমরা খানিকটা জেনেছি, শুনেছি, নবীনরা আমাদের মুখ থেকে তা শোনার পর আফসোস করবেন।
দুঃখ, মৃত্যু নিয়েই আমাদের এগোতে হবে, কাজ থেমে থাকবে না। আমাদের অনেকেই এখন ষাটের ঘরে পা রেখেছি। সুব্রতদাদের কথা মনে রেখে আমাদের এখন নিজেদের কাজকর্মের ডকুমেন্টেশন শুরু করা দরকার। দিল্লি, মুম্বইয়ে এটা খুব হয়, কলকাতায় আমরা কিছুই করি না। একাজটা অবিলম্বে শুরু করা না গেলে অনেক কিছুই হারিয়ে যাবে, তখন আর কিছুই করার থাকবে না।
স্মরণসভায় আমি তো অবশ্যই যাবো, সঙ্গে সঙ্গে অন্যদেরও যেতে বলবো। আমার সৌভাগ্য আমি দীর্ঘদিন এদের সঙ্গে কাজ করেছি, সাহচর্য পেয়েছি এদের। নিশ্চয়ই অনেক পুরনো বন্ধুবান্ধবদের দেখা পাবো। তপনদা, সুধীরদা, অমিত, রাজীব, জয়ন্ত, সলিল বেরা, দেবাশিস,অভিজিৎ সহ যে নবীন ও প্রবীণ চিত্রসাংবাদিক বন্ধুরা আমাকে এই স্মরণসভায় ডেকেছেন, তাদের ধন্যবাদ জানাই।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত