কন্নড় জাতির অধিকারের প্রশ্নকে রাজনৈতিক রূপ দিয়ে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে কর্ণাটক কংগ্রেসের সিদ্দারামাইয়া। যখন আরএসএস সদস্য কর্ণাটক রাজ্যপাল কর্ণাটকে গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান আদর্শের ফ্যাসিস্ট দল বিজেপিকে পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আনার নোংরা খেলা শুরু করেছে এবং দিল্লীর বাজারি মিডিয়া কর্ণাটকের নির্বাচন ফলাফলকে সিদ্দারামাইয়ার বিরাট হার হিসেবে প্রচার করছে। আমরা, যারা বাংলার, আমরা, যারা বাঙালী জাতির, আমরা যারা পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানো আটকাতে চাই, তাদের একটু তলিয়ে দেখা প্রয়োজন। ২০১৪’এর তুলনায় সিদ্দারামাইয়ার নেতৃত্বাধীন কর্ণাটক কংগ্রেসের ভোট প্রায় ১২ লাখ বেড়েছে। এটা কিন্তু দিল্লীর বাজারি মিডিয়া বা কলকাতার বাজারি মিডিয়া আপনাকে বলবে না। ২০১৪র তথাকথিত মোদী স্রোত (যে স্রোতের বিরুদ্ধে ছিলেন ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের ৬৯% মানুষ), সেই স্রোতের তুলনায় কর্ণাটকে বিজেপি যে সদ্য শেষ হওয়া কর্ণাটক বিধান সভা নির্বাচনে দেড় লাখ ভোট কম পেয়েছে, সেটা আপনাকে কলকাতার বা দিল্লীর বাজারি, বিকিয়ে যাওয়া মিডিয়া বলবে না। খুব কঠিন এই সময়। অসত্যের এই সময়। দিনকে রাত করার এই সময়। পূর্বকে পশ্চিম বানানোর সময়। তবুও সূর্য ঠিক পূর্ব দিকেই ওঠে – দিল্লীর সরকার বা আনন্দের সরকার কি বলে, তা দিয়ে বাস্তবটা বদল হয়না।
যখন হাজার হাজার কোটি টাকার খেলায়, নানা রাজ্যে বিরোধী সংগঠন সোজা কিনে নিয়ে বিজেপি একাধিক ‘সাফল্য’ পেয়েছে ছোট কিছু রাজ্যে, তখন সেই বানাওয়াট হাওয়ার জোরে তারা ভেবেছিল যে কর্ণাটকেও তারা জিতবে। হয়তো তাদের পিছনের দরজা দিয়ে জেতানো হবে, কিন্তু কর্ণাটকের জনগণ তাদের জেতায়নি। তারা টাকা কম ঢালেনি। তারা ঘৃণা কম ছড়ায়নি। কিন্তু তাদের সামনে সিদ্দারামাইয়া একটি দুর্ভেদ্য দেওয়াল খাড়া করে দিয়েছিলেন। সেই দেওয়ালের নাম কন্নড় জাতীয়তাবাদ। কেন্দ্র কর্ণাটকের রাজস্ব লুঠ করে, যেমন করে বাংলার ক্ষেত্রে। কেন্দ্র কন্নড় জাতির উপর হিন্দি চাপিয়ে দেয়, যেমন আরও ভয়ানক ভাবে করে বাঙালির জাতির ক্ষেত্রে। কেন্দ্র কর্ণাটকে ডাক বিভাগ, ব্যাঙ্ক সহ সকল কেন্দ্রীয় অফিসে হিন্দি বলয় থেকে কন্নড় না জানা কর্মী দিয়ে ভরিয়ে দেয়, যেমন এতটাই করে বাংলার ক্ষেত্রে যে বাঙালি অভ্যস্ত হয়ে গেছে এই নিপীড়নে, এই অধিকারহীনতায়। এই সব বাস্তব অনেক কাল ছিল। কিন্তু কেউ এই নিপীড়ন ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চীনের প্রাচীর হয়ে দাঁড়াননি। কর্ণাটকে কন্নড় জাতির ন্যায্য অধিকার চেতনা শীর্ষ রাজনৈতিক প্রাঙ্গনে এমন ভাবে ধারণ করেননি, যেমন করেছেন সিদ্দারামাইয়া। তার ফল পেয়েছেন কন্নড় জনতার বিপুল সমর্থনে – যে কারণে কর্ণাটকে কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোট শতাংশ ২০১৩ ও ২০১৪ কে ছাপিয়ে গেছে। কর্ণাটকের অন্য দল দেবগৌড়ার জনতা দল (সেক্যুলার) এই প্রশ্নগুলিকেও ধারণে বাধ্য হয়েছে। বদলেছে কর্ণাটকের রাজনৈতিক বয়ান। কর্ণাটকে বহিরাগত কায়েমি স্বার্থের প্রতিভূ বিজেপি আমতা আমতা করতে বাধ্য হয়েছে। তাই বিজেপির প্রবল পয়সা ছড়ানো ও তাবেদার মিডিয়ার অপপ্রচার সত্ত্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন ও ভোট দুইই পেয়েছে কংগ্রেস-জনতা দল (সেক্যুলার) যারা এখন জোটবদ্ধ।
এই সাফল্য থেকে বাংলা ও বাঙালির অনেক কিছু শেখার আছে। ঐতিহাসিক নানা দুর্ভাগ্যজনক কারণে বাংলার রাজনীতিতে বাঙালির অধিকারহরণ কখনও কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক প্রশ্ন হয়ে ওঠেনি। তাই আজ সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে হিন্দি আধিপত্যবাদী বিজেপি এই সোনার বাংলাতেও তাদের নোংরা থাবা বসানোর চেষ্টা করছে। তাদের সমর্থন করছে এক শ্রেণীর পুঁজি, দালাল মিডিয়া এবং পশ্চিমবঙ্গে বাঙালির অধিকারের শত্রুরা। তাই এই সময়ে এই বাংলায় দরকার বাংলা ও বাঙালির রাজনীতি, যা ধারণ করবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বাঙালির জাতির অধিকারের কথা, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অধিকারের কথা।
এ বছর কেটে গেছে আরেকটি ফেব্রুয়ারি। ২১ ফেব্রুয়ারির মাস, মাতৃভাষার জন্য লড়াই-এর মাস। এ লড়াই দৈনিক কারণ আমাদের আত্মপরিচিতি দৈনিক পাল্টায় না। অথচ এই ফেব্রুয়ারিতেই ২ বছর আগে খোদ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের ঝটিকা বাহিনী যে হিংসাত্মক কার্যকলাপ চালালো, তার নেপথ্যে রয়েছে ভয়ংকর সংকেত। সেদিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের সাধারণ সভা বা জেনেরাল বডি মিটিং-এ এই একই গোষ্ঠী উন্মত্তভাবে “হিন্দি মে বোল” আস্ফালনে ছাত্র প্রতিনিধিদের বাংলা বন্ধ করে হিন্দিতে কথা বলতে বাধ্য করে এই যাদবপুরে, এই বাংলায়। এ লজ্জা আমরা রাখবো কোথায়? আমরা কখুনো হিন্দি বলয়ে এরকম কোন পরিস্থিতির কথা ভাবতে পারি? পারি না এবং সেটি কাম্য-ও না। কিনতু আমাদের বুঝতে হবে কেন কলকাতায় বাংলাকে দমন করে হিন্দি চাপানো সম্ভব কিনতু হিন্দুস্তানের দিল্লিতে হিন্দিকে পাশে সরিয়ে তামিল বা বাংলা চাপানো সম্ভব না। আমাদের বুঝে নিতে হবে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের প্রেক্ষিতে “বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য” বাণীতে ফাঁকিটা ঠিক কোথায়, কে রাজা আর কে প্রজা, কে প্রথম শ্রেণীর নাগরিক আর কে দ্বিতীয় শ্রেণীর, কেন শিয়ালদহ থেকে লক্ষ্মীকান্তপুর যাবার লোকাল ট্রেনের টিকিটে স্টেশনের নাম হিন্দিতে থাকে কিনতু বাংলায় থাকে না, কাদের স্বার্থে কাদের দালালি করতে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা তকমা দিয়ে মিথ্যা প্রচার করা হয়। একুশে ফেব্রুয়ারী সুযোগ করে দেয় ভাবতে – আমরা মানে কারা, কেন আমার রাষ্ট্র আমার করের টাকায় অন্যের ভাষা প্রচার করে কিনতু আমারটা করেনা। আমাদের ভেবে দেখতে হবে যে আমাদের নিজের নিপীড়িত মাতা থাকতে বিমাতাকে পূজা করতে শেখায় যে রাষ্ট্র, সে রাষ্ট্র কার আর সে রাষ্ট্র কার নয়। আমরা পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালী – বাংলার দেশের (বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নয়) ভাঙ্গা পশ্চিম ভাগ। এই ভাষা আমাদেরও প্রাণের ভাষা, বেঁচে থাকার অবলম্বন, ভালবাসার মাধ্যম, পূর্বসুরীর স্মৃতি, উত্তরসুরীর উত্তরাধিকার, ব্রতের ভাষা- ধর্মের ভাষা-রাজনীতির ভাষা- ঘাম ঝড়ানো কর্মের ভাষা – প্রেমের ভাষা- ফোপানোর ভাষা – অপরাধের ভাষা- দাঙ্গার ভাষা-যৌনতার ভাষা -না বলা কথার ভাষা – ভুলে যাওয়া দিনের ভাষা – আগামীকালের ভাষা- শপথের ভাষা -মুক্তির ভাষা। বাংলা আমার মা। আমি বাঙালি।
( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)