কোয়েসের দামি জার্সি পরা সদ্য নেইমারকে আটকে দেওয়া বিশ্বকাপারকে দাঁড় করিয়ে মেদিনীপুরের ধড়রাশোলের পিন্টু মাহাতোর গোলার মতন শটটা যখন জালে আছড়ে পড়ল, তখনই আসলে জিতে গিয়েছিল বাংলার ফুটবল।
অভিষেক ডার্বিতে জঙ্গলমহলের পিন্টু শুধু গোল করেনি, বিশ্বকাপার জনি অ্যাকস্টাকে পিছনে ফেলে জিতে নিয়েছে ম্যাচের সেরার শিরোপা।
সূর্য ডোবা যুবভারতীতে বাঙালির বিজয়পতাকা ওড়ানো পিন্টু বাংলা ও বাঙালির সব থেকে বড় আবেগে অবশ্যই অক্সিজেন।
ডার্বি জন্ম দেয় অনেক তারকার। ডার্বির হাত ধরেই বাঙালির ফুটবল রূপকথায় চিরকালীন জায়গা করে নেয় অনেকে। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়।
বিশ্বকাপারকে ম্লান করা পিন্টুর মতন আরও অনেক পিন্টু এদেশের পথে–প্রান্তরে বেঁচে থেকেও পাদপ্রদীপের আলোয় জায়গা করে নিতে পারে না।
এবাবের মতন ১৯৬২ সালের এশিয়ান গেমস হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায়। ভারতীয় ফুটবলে সোনার সেই দিনে রহিম সাহেবের ছেলেরা গলায় সোনার পদক ঝুলিয়ে এশিয়াডের ভিকট্রি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছিলেন। পিকে–চুনী–বলরাম, অরুণ ঘোষ, প্রশান্ত সিনহা, রামবাহাদুর, জার্নেল সিং, অরুময়নৈগম, পিটার থঙ্গরাজ, প্রদ্যোত বর্মনরা দেশকে করেছিলেন এশিয়ার সেরা।
১৯৫৬ ও ১৯৬০–এর অলিম্পিকেও আমাদের ফুটবল দল বিশ্বের বহু বাঘা টিমের সঙ্গে সেয়ানে সেয়ানে টক্কর দিয়েছিলেন।
১৯৬০–এর রোম অলিম্পিকে রহিম সাহেবের ছেলেরা হাঙ্গেরি আর পেরুর সঙ্গে দুর্দান্ত লড়ে সামান্য ব্যবধানে হেরেছিলেন। শক্তিশালী ফ্রান্সকে রুখে দিয়েছিলেন ১–১ গোলে।
সেই ৬০–এর অলিম্পিকের পর ফ্রান্স দুবার বিশ্ব সেরা হয়েছে। অথচ রহিম সাহেবদের উত্তরাধিকার বহন করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। বিশ্বকাপ তো পরের কথা। এবারে আবার জাকার্তায় এশিয়াড। পরিকাঠামোর পূর্ণতা ছাড়াই সুনীল ছেত্রিরা যথেষ্ট ভাল খেলেছিল। এশিয়াডে অংশগ্রহণের ছাড়পত্রই দেওয়া হল না। দেশের ক্রীড়া প্রশাসনের কেষ্টবিষ্টুরা মাতব্বরের মতো জানান দিলেন, পদক পাওয়ার সম্ভাবনা যখন নেই, তখন দল পাঠিয়ে কী হবে? ভাবখানা এমন, যেন যাঁরা অংশগ্রহণ করছেন, তাঁরা সবাই পদক পাবেন।
আসলে আমলাতান্ত্রিকতা ও পরিকল্পনার দিশাহীনতা যে আমাদের অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া ক্রীড়া পরিকাঠামোকে আরও পেছনে ঠেলে দিচ্ছে, তা নিয়ে দেশের সরকারের কোনওই মাথাব্যথা নেই।
এবারের এশিয়াডে ১৫টি সোনার পদক নিশ্চয় গৌরবের। কিন্তু আমরা কি কখনও ভাবব না যে চীন কী করে ১৩২টি সোনা পেল জাকার্তায়? কোন পরিকাঠামোর হাত ধরে চীন আজ এশিয়াডে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে? অলিম্পিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রথম হওয়ার টক্কর দেয়? স্টেশনে রাত কাটানো, ডার্বির নায়ক পিন্টু মাহাতোরা এ প্রশ্নকে আরো উসকে দেয়।
প্রতিভার অভাব কোনওকালেই আমাদের ফুটবলে ছিল না। ১৯৭৭–এর কলকাতা। ইডেন গার্ডেন্স। কসমসের হয়ে মাঠে নেমেছেন স্বয়ং ফুটবল সম্রাট।
উল্টোদিকে পিকে ব্যানার্জির কোচিংয়ে শিবাজি ব্যানার্জি, সুধীর কর্মকার, প্রসূন ব্যানার্জি, শ্যাম থাপা, হাবিব, বিদেশ, মানসরা। উল্টোদিকে ফুটবল সম্রাট খেলছেন এটা ভুলে গিয়েছিলেন গৌতম সরকার, দিলীপ পালিতরা। কসমসকে ২–২ গোলে রুখে দিয়েছিলেন ওঁরা। গোল করেছিলেন শ্যাম থাপা ও হাবিব। খেলা শেষে ১৪ নম্বর জার্সিধারীর খোঁজ করেন পেলে। খুঁজে পাওয়ার পর কাঁধ ঝাঁকিয়ে দিয়ে সেই ১৪ নম্বর জার্সিধারীকে অকপটে বললেন, “You are the great number 14 who did not allow me to play.”
১৪ নম্বর জার্সি পরিহিত গৌতম সরকারের অনুভূতি গৌতমদাই জানেন। তবে ফুটবল সম্রাটের ওই উচ্চারণ আসলে ফুটবল পাগল বাঙালির জন্য ছিল এক অনন্য স্বীকৃতি।
বিশ্বকাপের সময় রিও–র বাইরে রিও মাথা তোলে এই ফুটবল পাগল শহরে। বুয়েনস এয়ার্স নিজেকে আবিষ্কার করে আমাদের গলির আনাচে–কানাচে। অথচ আমাদের খেলা হয় না বিশ্বকাপে। পরিকল্পনা, পরিকাঠামো— এই সমস্ত শব্দের সঙ্গে যেন আমাদের চিরকালীন শত্রুতা। অথচ হৃদয় দিয়ে ফুটবল আমাদের সহজাত। এবারের ডার্বি আবারও তার প্রমাণ রেখেছে। প্রাণে প্রাণ রেখে জেগে উঠেছিল যুবভারতী। মশাল নেই তো কি। মোবাইলের আলোয় তখন দু’প্রধানের গ্যালারি বাঙালির আলোকমালা। অপরাজেয়। অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
বাংলার ফুটবলের রঙ লাল–হলুদ, সবুজ–মেরুন। বাঙালির ফুটবল উন্মাদনা আর আবেগে শতাব্দী প্রাচীন মোহনবাগান আর শতবর্ষের দোরগোড়ায় থাকা ইস্টবেঙ্গলই ভালবাসা, ভাললাগার শেষ কথা। খালি পায়ে খেলে গোরাদের হারানোর জয়যাত্রা আর দেশভাগের অবর্ণনীয় যন্ত্রণার খেলার মাঠে বহিঃপ্রকাশের অদম্য জেদের মিশেলেই বাংলার ফুটবল। বাঙালির ফুটবল।
এই অপরাজেয় আবেগ, ভালবাসা, উন্মাদনা আর অঢেল প্রতিভাকে সঠিকভাবে ব্যবহারের জন্য চাই কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনা, পরিকাঠামো ও বিনিয়োগ ছাড়া সাফল্য আসতে পারে না। এই দুর্ভাগা দেশে আজও অবধি কোনও কার্যকরী ক্রীড়ানীতি নেই। খাতায় কলমে অনেক কিছু থাকলেও বাস্তবিক প্রয়োগে আমরা বহু পিছনে পড়ে রয়েছি।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি সরকারি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে চীন সফরের সময় আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল একটি অলিম্পিক ট্রেনিং সেন্টারে। ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকের জন্যে ট্রেনিং চলছিল সেখানে।
প্রায় একটি শহরের সমান সেই ট্রেনিং অ্যাকাডেমিতে তিন–চার বছরের বাচ্চারাও প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। অ্যাকাডেমির প্রধান আমাদের জানিয়েছিলেন যে এই ছোট ছেলেমেয়েরা ২০২৪–এর অলিম্পিকের সোনার পদকের লড়াই করবে। আলাপচারিতার সময় আমাদের প্রতিনিধি দলের এক সদস্য ছোট ছেলেমেয়েদের ট্রেনিংয়ের প্রক্রিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে কি না এ প্রশ্ন তোলাতে অ্যাকাডেমির প্রধান (২০০২ সিডনি অলিম্পিকের সোনাজয়ী) তথ্য দিয়ে আমাদের জানিয়েছিলেন যে ২০০৮–এর অলিম্পিকে একটি সোনার পদকের জন্য চীনের সরকারি বিনিয়োগ ভারতবর্ষের বার্ষিক ক্রীড়া বাজেটের থেকে বেশি ছিল!!
পরিকল্পিত সরকারি বিনিয়োগ ছাড়া কিছু সম্ভব নয়। সরকার পাশে না দাঁড়ালে পিন্টু মাহাতোরা বিশ্বকাপের জনি অ্যাকস্টাকে টপকে গোল করবে, ম্যাচের সেরাও হবে, কিন্তু বিশ্বকাপ খেলতে পারবে না। এই পরিস্থিতি বদলাতে চাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা। যে সদিচ্ছা সীমিত ক্ষমতা নিয়ে দেখাচ্ছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে একটি রাজ্যের ক্ষমতায় অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। তা সত্ত্বেও গোটা বাংলার তল্লাট জুড়ে খেলাধুলোর প্রসারে মুখ্যমন্ত্রীর আন্তরিকতার কোনও অভাব নেই। জেলায় জেলায় মাথা তুলছে স্টেডিয়াম, পাড়ায় মহল্লায় বিলি হচ্ছে খেলাধুলোর সামগ্রী। চিহ্নিত হচ্ছেন স্বপ্না বর্মনরা, এশিয়াডে সোনা জেতার পাঁচ বছর আগেই। অভাবের সংসারেও যতটা করা যায়, তা নিশ্চিত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
বাতাসে বারুদের গন্ধ, নিঝুম পথঘাটের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দেওয়া ভারী বুটের শব্দের আবহ থেকে উঠে আসা পিন্টু মাহাতোর পায়ের গোলা জালে জড়িয়ে যাওয়া দেখেছেন বিশ্বকাপার।
পিন্টু মাহাতোর জঙ্গলমহলে মমতা ব্যানার্জির উদ্যোগে শুরু হয়েছে জঙ্গলমহল কাপ, যা নিয়ে তরুণদের উন্মাদনা ও উৎসাহ চোখে পড়ার মতন।
কয়েক বছর ধরে চলা এই জঙ্গলমহল কাপের হাত ধরেই নীরবে বেড়ে উঠেছে আরও অনেক পিন্টু, হিংসার বিরুদ্ধে ঐক্যের বার্তা ছড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের জঙ্গলমহল কাপে প্রতি বছরের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ অবশ্যই আশার আলো। তবে একটি অঙ্গরাজ্যের উদ্যোগে অবস্থা পাল্টাবে না। সুসংহত কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা চাই, চাই নির্দিষ্ট লক্ষ্য, যথেষ্ট কেন্দ্রীয় বিনিয়োগ আর বিজ্ঞানসম্মত বাস্তবায়ন।
আর সেটা হলেই পিন্টু মাহাতোরা শুধু ডার্বিতে জনি অ্যাকস্টাদের দাঁড় করিয়ে গোল করবে না, লড়াই হবে দেশের জার্সিতে। আন্তর্জাতিক স্তরে দেশের বিজয়কেতন উড়িয়ে দেওয়ার সমস্ত মশলা আছে এই মাটিতে। চাই সাহায্য আর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। আন্তর্জাতিক আঙিনায় পিন্টু মাহাতোদের বিজয়নিশান উড়িয়ে দেওয়ার দিনে লাল–হলুদ, সবুজ–মেরুন রঙের বাঙালি আবার একসঙ্গে আলোর মশাল জ্বেলে দেবে। দেবেই।
(সৌজন্য:- আজকাল)