আজ মায়েদের দিন, মাতৃ দিবস। আমার মনে হয়, সব মাতৃ দিবস আসলে নারী শক্তির উদ্বোধন। তাদের শক্তি, ক্ষমতা আর যাবতীয় গুণপনাকে স্বাগত জানাবার দিন। এই দিনটাতে চাঁদমণি হেমব্রমকে নিয়ে আমার অপটু কলমে কয়েকটা কথা লিখতে চাই আমি। অবশ্য যা লিখবো তার বাইরেও না লেখা অনেক কথা থেকে যাবে। অতটা লেখার ক্ষমতা আমার নেই।
হুগলী জেলার পান্ডুয়ায় এক গণ্ডগ্রাম বড়ো মুল্টির বাসিন্দা চাঁদমণি পড়ে ক্লাস টেন-এ। বাবাকে হারিয়েছে ছোটবেলাতে, সে কথা মনে পড়লেই চোখে জল আসে তার। দিনমজুর মা কাকভোরে কাজে বেরিয়ে যায়। এরপর ঘরের সব কাজ সামলে রান্না করে খেয়ে তিন বোন আর বন্ধুদের সঙ্গে তার স্কুলে যাওয়ার পালা। এক ঝাঁক পায়রার মত কলকল করতে করতে বাড়ির সামনে দিয়ে স্কুলে যাওয়া এই মেয়েদের তো আমরা সবাই চিনি। কিন্তু চাঁদমণির আরেকটা আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। অভাব সেই ক্ষমতাটাকে কেড়ে নিতে পারেনি। আপন মনে, নিজের খেয়ালে সে চমৎকার গান গায়। সে কথা তাকে বললেই তার চোখেমুখে জ্বলে ওঠে হাজার ওয়াটের আলো। শিশুসুলভ সারল্যে সে বলে ওঠে ‘আমার গান করতে খুব ভালো লাগে, আমি মোবাইল আর টিভিতে গান শুনি, সে সবই তো গাই।’
এমনিতে চাঁদমণি গান শেখেনা, শেখার প্রশ্নও নেই। তিন বোনের মধ্যে সে বড়। বাড়ির কাজ আর স্কুলের পড়া করাতেই তার দিন কাটে। তার গানের তারিফ করেন স্কুলের দিদিমণি থেকে পাড়ার লোক সবাই। গান একইসঙ্গে তার ভালোবাসা আর আনন্দ। চাঁদমণির গান আমি শুনেছি গতকাল দুপুরে। ওর গ্রামেরই এক বাসিন্দা শ্যাম হাঁসদার পাঠানো একটা লিঙ্ক এর মাধ্যমে। সেটা একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত। আমি যে গানের বিরাট সমঝদার তা নয়। কিন্তু ওর গান শোনার পর থেকেই মনটা অন্যরকম হয়ে গেল। চমৎকার কণ্ঠস্বর, অপূর্ব গায়কী আর মনে হচ্ছিল ও যেন নিজের অনুভব দিয়ে গানটাকে স্পর্শ করছে। ভাবতে অবাক লাগে ১৫৯ বছরেও রবীন্দ্রনাথ কীভাবে এক নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন! এতটাই তার গানের শক্তি! ভুল, ত্রুটি ইত্যাদির কথা তো বিশেষজ্ঞরা বলবেন, আমাকে অবাক করেছে ওর গানের ‘কানেক্ট’ টা। দু-চার জন নামী সঙ্গীত শিল্পী ও বিশেষজ্ঞ বন্ধু রয়েছেন আমার। তারা সবাই এই ‘কানেক্ট’ ব্যাপারটাকে খুব গুরুত্ব দেন।

শ্যাম হাঁসদাকে আমি চিনতাম না। বহু চেষ্টার পর তার সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল। শুনলাম, শিক্ষকতা ও নানা পেশার সঙ্গে যুক্ত শ্যাম ও তার বন্ধু মিঠুন টুডু, চিরপ্রিয় হাঁসদা, রামকিষাণ কিস্কু ও মহেশ হাঁসদা হুগলীর পান্ডুয়ার বড়ো মুল্টি গ্রামের বাসিন্দাদের কিছু সহায়তা দিতে গিয়েছিলেন। সেখানে পুকুর পাড়ে চাঁদমণির গান শোনেন তারা। তখন বাসন মাজতে মাজতে নিজের মনেই গান করছিল সে। শ্যাম ওই গান রেকর্ড করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে। শ্যাম ও তার বন্ধুদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ, কারণ তারা আমাকে চাঁদমণির গান শোনার সুযোগ করে দিয়েছেন।
চাঁদমণির গান শোনার পর আজ সকালে আমার এক বন্ধুকে তার গ্রামে পাঠাই। সে জানালো, পরিবারটি খুব গরিব। এখন চাষ নেই তাই মা কাজ করতে যায় প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে এক লোকের বাড়িতে। ভোরে বেরোন, ঘরে ফেরেন রাতে। পরিবারটির একবেলাই পেটভরে খাবার জোটেনা। তবে পাড়ায় আর স্কুলে চাঁদমণির গানের খুব প্রশংসা হয়। মোবাইলে চাঁদমণির সঙ্গে কথা বললাম। ও জানালো, সবরকম গানই সে নিজের মনে গায়। পড়াশোনা ছাড়া গান নিয়েই থাকে। কান্নাধরা গলায় জানালো, কতদিন গান গাইতে পারবো জানিনা। আমরা এত গরিব…
স্কুলের করে দেওয়া ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট চাইলাম। ও বললো, এখনো কন্যাশ্রী পাইনি, কিন্তু শিক্ষকরা বলেছেন, পাবে। আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, চাঁদমণি তোমার লেখাপড়া ও গান শেখার জন্য যা খরচ হবে আমি তার ব্যয়ভার নিলাম। আমি তোমায় আগামিকাল কিছু টাকা পাঠিয়ে দেবো। আমার নাম, ফোন নাম্বার দিয়ে জানালাম এবার থেকে তোমার যা অসুবিধা হবে তা তুমি আমায় জানিও। শোনার পর চাঁদমণি অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো। ওর মনের অবস্থাটা বুঝতে পারি। ফোন কেটে যায়।
আমি সামান্য মানুষ। কোন দিবসেরই বিরাট কোন তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। গানে গানে আরও বহুদূর যাবে চাঁদমণি। ওর পাশে থাকার চেষ্টাই আমার কাছে মাতৃ দিবসের উদযাপন।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত