একুশের ভোটযুদ্ধে ভরাডুবির পর থেকেই শনির দশা শুরু হয়েছে বঙ্গ বিজেপির। দলত্যাগের হিড়িক, আদি-নব্য দ্বন্দ্ব তো ছিলই। চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনের আগে শিকেয় উঠেছে তাদের সংগঠনেরও। এরই মধ্যে ৩৫ আসন লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। শুধু তাই নয়। সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে চাপও দিয়ে চলেছেন তিনি। আবার, বুথ শক্তিশালী করতে একের পর এক কর্মসূচি ঘোষণা করে চলেছেন দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন কর্মসূচি তো রয়েছেই। আর সে সবই ‘সফল’ করতে রাজ্য নেতারাও দল এবং সাত মোর্চা নেতৃত্বকে চাপে রাখছেন। মোর্চার নেতারাও একের পর এক কর্মসূচি ঘোষণা করে চলেছেন। সে সব পালন করতে গিয়ে নাজেহাল কর্মীরা। একটার ঘাড়ে উঠে যাচ্ছে অন্য একটা কর্মসূচি। কিন্তু এতে লাভের লাভ হচ্ছে কি? রাজ্য নেতারা মানতে না চাইলেও কর্মসূচির ‘চাপ ও সাফল্যের’ সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে দলের অন্দরেই।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি শাহ এবং নাড্ডা কলকাতা সফরে এসে রাজ্য নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে দলকে বলা হয়, সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে ‘বুথ সশক্তিকরণ’ কর্মসূচিতে। এর পরেই বসে রাজ্যের বর্ধিত কার্যকারিণী বৈঠক। সেখানে নির্দেশের পর নির্দেশ দেন রাজ্য নেতৃত্ব। ছ’টি গুরুত্বপূর্ণ তারিখ ঠিক করেন রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব। বলা হয়, রাজ্য স্তরের নির্বাচন পরিচালন কমিটির পরে প্রতিটি লোকসভা স্তরেও হবে একই রকম কমিটি। সেগুলি শেষ করতে হবে ১৬ জানুয়ারির (মঙ্গলবার) মধ্যে। এর পরে বিধানসভা ধরে ধরে এলাকাভিত্তিক কমিটি গঠন করতে হবে ২০ জানুয়ারির মধ্যে। ১২ জানুয়ারি স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন পালন করতে বলা হয়েছিল প্রতিটি মণ্ডলে। বলা হয়েছিল, ১৪ জানুয়ারি মকরসংক্রান্তির দিন সেবামূলক কর্মসূচি নিতে হবে। স্বামীজির জন্মদিন পালন হয়েছে। তবে নেহাতই গুটিকয়েক এলাকায়। শীর্ষ স্তরের নেতারা সেবামূলক কাজে যোগ দিয়েছিলেন।
কিন্তু কর্মীরা? তাঁদের তো বাড়ি বাড়ি গিয়ে রামমন্দির উদ্বোধনের আমন্ত্রণ জানাতে হবে। ২২ জানুয়ারি, রামমন্দির উদ্বোধনের দিন স্থানীয় মন্দিরে পুজো করতে হবে, বাড়িতেও প্রদীপ জ্বালাতে হবে। এর পরে পরেই রয়েছে ২৮ জানুয়ারি রবিবার প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠান বুথ স্তরে শোনার কর্মসূচি। আর তা মিটলেই প্রতিটি ব্লক স্তর থেকে মানুষকে অযোধ্যায় নিয়ে যেতে হবে সারা ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে। এ সবের মধ্যেই রাজ্যে এসেছে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘বিকশিত ভারত সঙ্কল্প যাত্রা’। তাতেও যোগ দিতে হচ্ছে কর্মীদের। আবার, ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধন হয়ে গেলেই ২৫ জানুয়ারি ‘নব মতদাতা সম্মেলন’ নামে কর্মসূচি মোদীর। সে দিন দেশের মোট পাঁচ হাজার জায়গায় নতুন ভোটারদের জমায়েত চায় দল। রাজ্যকে বলা হয়েছে, কমপক্ষে পাঁচটি জায়গায় পাঁচ হাজার মানুষের সমাবেশ করতে হবে মোদীর ভার্চুয়াল বক্তৃতা শোনার জন্য। যার মধ্যে কমপক্ষে এক হাজার নতুন ভোটার হতে হবে।
এই কর্মসূচি সফল করতে রাজ্য বিজেপির যুব মোর্চা তিনটি কর্মসূচি নিয়েও ফেলেছিল। তারা ঠিক করেছিল ১৩ থেকে ১৬ জানুয়ারি চলবে খেলার মাঠ, স্টেডিয়াম, ক্লাব এবং জিমে গিয়ে নতুন ভোটার ধরা। সেটা শেষ হতে না হতেই ১৭ থেকে ১৯ জানুয়ারি শহরে-গ্রামে সমস্ত কোচিং সেন্টারে গিয়ে কথা বলা হবে পড়ুয়া ভোটারদের সঙ্গে। পরের দু’দিন নতুন ভোটারের খোঁজে বাড়ি বাড়ি যাওয়া। এর পরে আবার ‘গ্রামে চলো’ কর্মসূচিও রয়েছে যুব মোর্চার। বিজেপির মহিলা-সহ বাকি মোর্চার উপরেই এমন ‘চাপ’। দিল্লির নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন, ‘যুবতী সম্মেলন’ও করতে হবে। এত এত কর্মসূচি এক সঙ্গে করতে গিয়ে কি সেগুলি আদৌ পুরোপুরি করে ওঠা যাচ্ছে? লাভ হচ্ছে বিজেপির? ঘোষণা হলেও সব কর্মসূচি ঠিকঠাক পালিত হচ্ছে কি? একটার ঘাড়ে আর একটা তুলে গুলিয়ে ফেলছেন না তো নিচুতলার কর্মীরা? এমন নানা প্রশ্ন এখন ঘুরছে বিজেপির অন্দরে।
হুগলি জেলার এক যুবনেতা যেমন বলছেন, ‘দলের কাজ তো করতেই হবে! কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই সব কর্মসূচি সফল করতে গিয়ে নিজের এলাকার বুথের দিকেই নজর দিতে পারছি না। এত বৈঠকে বসতে হচ্ছে যে, কাজের সময়টাই কমে যাচ্ছে।’ বীরভূমের এক জেলা স্তরের নেতা বলছেন, ‘নতুন মানুষের সঙ্গে আদৌ যোগাযোগ হচ্ছে না! সব কর্মসূচিতে ভিড় জমাতে একই কর্মীকে বার বার ডাকা হচ্ছে। আসলে তাঁদেরই ডাকা হচ্ছে, যাঁরা আসবেন নিশ্চিত।’ তাঁর আরও দাবি, ‘যাঁরা মোদীজির ‘মন কি বাত’ শুনছেন, তাঁরাই আবার নতুন ভোটার হয়ে অন্য কর্মসূচিতে যাচ্ছেন। এ সবের মধ্যে ‘নমো’ অ্যাপের প্রচার এবং নিয়মিত ‘টাস্ক’ও করতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সব কথা মানতে গিয়ে তাঁরা চাপে পড়ছেন। কেউ নিজের মুখে না বললেও জানতে পারছি, বুঝতে পারছি।’ এত বেশি কর্মসূচি যে ঠিক নয়, সেটা মানছেন রাজ্য স্তরের নেতারাও। তাঁদের এক জনের বক্তব্য, ‘আসলে কোনও কর্মসূচিই পুরোপুরি সফল হচ্ছে না।’