গত ৯ অগস্ট যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা প্রথম বর্ষের এক ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। হস্টেলের তিনতলা থেকে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন নদিয়ার বগুলার ছেলে স্বপ্নদীপ কুন্ডু। সেই ঘটনার নেপথ্যে র্যাগিং রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ কমিটির রিপোর্টেও এমনই তথ্য উঠে এসেছে। ওই পড়ুয়ার অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর থেকেই তাঁর বাড়ির লোকজন এই র্যাগিয়ের অভিযোগই তুলেছিলেন। সেই মর্মে পুলিশের কাছে অভিযোগও করেন। শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ কমিটির রিপোর্টও সেই অভিযোগকেই মান্যতা দিয়েছে। তবে ওই পড়ুয়ার মৃত্যু কী ভাবে হয়েছে, সে সম্পর্কে কোনও দিশা দেখাতে পারেনি অভ্যন্তরীণ কমিটির ওই রিপোর্ট।
পুলিশ দাবি করেছে, ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় র্যাগিংয়ের প্রমাণ মিলেছে। লালবাজার সূত্রে খবর, হস্টেলের ৭০ নম্বর ঘরে ওই ছাত্রকে বিবস্ত্র করানো হয়েছিল। তার পর তাঁকে বারান্দায় হাঁটানো হয়। কী ভাবে র্যাগিং হয়েছে, তার নথি গত মঙ্গলবার আলিপুর আদালতে জমা করেছে পুলিশ। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ঘটনার আগে বেশ কিছুটা চাপে ছিলেন ওই পড়ুয়া। সূত্রের খবর, এর আগেও মেন হস্টেলে একাধিক র্যাগিংয়ের অভিযোগ সামনে এসেছে বলে উল্লেখ রয়েছে তদন্ত কমিটির রিপোর্টে। তাতে কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক ব্যর্থতাও তদন্ত কমিটি খুঁজে পেয়েছে বলে খবর। পাশাপাশি এ-ও জানা গিয়েছে, তদন্তে নেমে এ পর্যন্ত ১০০-র বেশি জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছে কমিটি। আগামী সপ্তাহে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট জমা দেওয়া হবে।
অন্য দিকে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মৃত্যুর ঘটনায় ১৩ জন ধৃতের মধ্যে অন্যতম সৌরভ চৌধুরীকে শুক্রবার আদালতে হাজির করানো হয়। বিচারক তাঁকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেল হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন। শুনানিতে গোটা ঘটনার জন্য সৌরভকেই ‘কিংপিন’ (মাথা) বলেছেন সরকারি আইনজীবী। তবে সৌরভের জেল হেফাজতের নির্দেশ শোনার পর তাঁর আইনজীবী শুক্রবার বিচারককে অনুরোধ করেন, ‘দাগী বন্দিদের সঙ্গে যেন জেলে সৌরভকে না রাখা হয়।’ অন্য দিকে সরকার পক্ষের আইনজীবী জানান, অন্যদের বেলায় যা নিয়ম, সেটাই মেনে চলা উচিত। সৌরভের আইনজীবী বলেন, ‘পিক অ্যান্ড চুজ করা হচ্ছে।’ প্রত্যুত্তরে সরকারি আইনজীবী বলেন, ‘পিক অ্যান্ড চুজ করে দল বেঁধে মারা হয়েছে।’
তাঁর মন্তব্যের ঘোর বিরোধিতা করে সৌরভের আইনজীবী প্রশ্ন করেন, ‘পিক অ্যান্ড চুজ’ কী? জবাবে সরকারি আইনজীবী জানান, একটি গামছা উদ্ধার হয়। যেটা দিয়ে মৃত ছাত্রের মুখে চাপা দেওয়া হয়েছিল। সেই রক্ত মাখা গামছা এবং ২টো ফোন বাজেয়াপ্ত হয়েছে। ফোনে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপও তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে মেসেজ চালাচালি হত। সরকারি আইনজীবীর দাবি, সেখানে তদন্ত প্রভাবিত করার প্রমাণ হাতে পেয়েছেন তদন্তকারীরা। ফোনে ‘জেইউএমএইচ’ নামে একটি গ্রুপ তৈরি করা হয়েছিল। সৌরভ সেই গ্রুপে ‘ইনস্ট্রাকশন’ (নির্দেশ) দিতেন। মাঝেমধ্যে সেই গ্রুপে অ্যাক্টিভ হতেন শুধুমাত্র ‘নির্দেশ’ দেওয়ার জন্য।
সরকারি আইনজীবীর কথায়, ‘ছাত্রমৃত্যুর পর সৌরভ চৌধুরীকে বাঁচাতে অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র হয়েছিল। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে ওই ষড়যন্ত্র হয়েছিল।’ তিনি জানান, হস্টেলে সৌরভ থাকেন কি না, সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তদন্তকারীদের কী বলা হবে, তা সবই সেই গ্রুপে লেখা হত। পরে প্রমাণ লোপাটের ক্ষেত্রে সেই গ্রুপ ডিলিট করে দেওয়া হয়। অন্যদিকে, ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় শুক্রবার অভ্যন্তরীণ কমিটির রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য বুদ্ধদেব সাউকে। সূত্রের খবর, তাতে বলা হয়েছে, ছাত্রমৃত্যুর নেপথ্যে র্যাগিংয়ের ভূমিকা রয়েছে বলে ‘মনে করা হচ্ছে’। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ তদন্তে স্পষ্ট নয় যে, গত ৯ অগস্ট রাতে কী ভাবে হস্টেলের বারান্দা থেকে পড়ে গিয়েছিলেন বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ওই ছাত্র।