ক্রমশ বাড়ছে দেশের জনঘনত্ব। বর্তমানে সারা বিশ্বে মোট জনসংখ্যার নিরিখে শীর্ষে রয়েছে চীন। সামান্য পিছনেই ভারত। তবে রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট বলছে, এবছরের মধ্যেই চীনকে অতিক্রম করে যাবে ভা। জনস্ফীতির সাঁড়াশি চাপে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে এই আশঙ্কায় চিন যে ‘এক সন্তান নীতি’ চালু করেছিল, তাই এখন অভিশাপ হতে চলেছে। কমছে জনসংখ্যা, কমছে জন্মহার। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে চীনের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার প্রায় ভারতের অর্ধেক। রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট বলছে, ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে এ বছরের ১লা জুলাই অবধি একটা বড় পরিবর্তন আসতে চলেছে। ২০২১ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি, আর চীনের জনসংখ্যা ১৪১.২৪ কোটি। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৯ শতাংশের বাস চীনে এবং ১৮ শতাংশের বাস ভারতে। প্রথম-দ্বিতীয়ের এই ছবি দীর্ঘদিনের। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই শতকের শেষে গিয়ে হিসেব উল্টে যাবে। ভারতই জনসংখ্যার নিরিখে প্রথম হবে। অন্তত ১৫০ কোটি জনসংখ্যা দাঁড়াবে ভারতের। চীন থাকবে দ্বিতীয় স্থানে। ২০২২ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দুই জনবহুল অঞ্চল হল পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া। এই দুই অঞ্চলের মধ্যেই পড়ছে ভারত এবং চীন। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বর্তমানে জনসংখ্যা ২৩০ কোটি (বিশ্বের ২৯ শতাংশ)। অন্য দিকে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় ২১০ কোটি জনসংখ্যা (বিশ্বের নিরিখে ২৬ শতাংশ)। রিপোর্ট বলছে, ২০৩৭ সালের ভিতরে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল অঞ্চলের তকমা পেতে চলেছে। কারণ ২০৩০ সাল নাগাদ পুর্ব ও দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ায় জনসংখ্যা ক্রমশ কমতে শুরু করবে।
পাশাপাশি রিপোর্ট বলছে, ১৯৪৯ সালে চীনে যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল, ২০১৯ সালের হিসেবে সেটা অনেকটাই কম। শুধু কম নয়, রীতিমতো উদ্বেগজনক। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৪৯ সালের পর থেকে চীনে প্রতি হাজার জনে জন্মহার ছিল ১০.৯৪। আর এ বছর প্রতি হাজার জনে জন্মহার ৬.৭৭। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জন্মহারের এই পতন শুরু হয়েছে ১৯৮০ সালের পর থেকে। ১৯৭৯-তে চিনে ‘এক সন্তান নীতি’ চালু হওয়ার পর থেকেই হুড়মুড়িয়ে কমেছে শিশু জন্মের হার। ১৯৭৯ সালে যখন এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল চিন, অনেক দেশই ভেবেছিল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এটা বুঝি সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয়েছিল অন্য জায়গায়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, অনেক মহিলাকে সে সময় গর্ভপাতে বাধ্য করা হয়েছিল। বন্ধ্যাকরণ করানো হয়েছিল অনেক যুবতীকে। এই নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আঙুল তোলায় শত শত মানুষের কারাদণ্ড-জরিমানা দেখে চমকে উঠেছিল বিশ্ব। অভিশাপের সূত্রপাত এর পরেই। জন্মহার কমতে থাকায় জনসংখ্যায় কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে। দেখা যায়, পরিবারে আয় করার লোকের সংখ্যা কম, পরিবর্তে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সংখ্যা অধিক। ফলে পরিবার পিছু আয়, সমৃদ্ধিও কম। যা দেশের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলে। রিপোর্ট বলছে, এই নিয়ম চালু হওয়ার পর থেকে দেশ জুড়ে দশ লক্ষ পরিবার তাদের একমাত্র উত্তরাধিকারীকে হারিয়েছেন। আগামী ২০-৩০ বছরে আরও ৪০ থেকে ৭০ লক্ষ পরিবারকে এই অবস্থার শিকার হতে হবে। ২০১৬ সালেই ‘এক সন্তান নীতি’ প্রত্যাহার করে দুই সন্তানের অনুমোদন দিয়েছিল চীন। কিন্তু তার পরেও জন্মহারের পতন অব্যাহত। এখন চিনের পার্লামেন্টের সদস্যেরা দাবি করছেন, প্রজননের উপর নিয়ন্ত্রণমুক্তি, অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের জন্য বিশেষ কর-ছাড়, বিনামূল্যে শিক্ষা-স্বাস্থ্যের সুবিধা না বাড়ালে দূরীভূত হবে না এই সমস্যা। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের হিসেবে চীনের জনসংখ্যা ১৪১ কোটি। ২০২৯ সালের মধ্যে সেটাই ১৪৪ কোটিতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জন্মহারের যেভাবে পতন শুরু হয়েছে তাতে ২০৬৫ সাল নাগাদ রেকর্ড পতন হবে জনসংখ্যার। সেটা কমে দাঁড়াতে পারে ১১৭ কোটিতে। এদিকে শিশুজন্মের হারে ঊনিশেই চিনকে টেক্কা দিয়েছিল ভারত। ২০১৯ সালের প্রথম দিনে ভারতে ৬৯ হাজার ৯৪৪ জন নবজাতকের জন্ম হয়েছিল। ২০২০ সালের প্রথম দিনে ভারতে ৬৭ হাজার ৩৮৫ জন নবজাতকের জন্ম হয়েছে। ইউনিসেফের রিপোর্ট বলছে, চীনে বছরের প্রথম দিনে ৪২ হাজার ২৯৯ জন শিশু জন্মগ্রহণ করেছে। সেক্ষেত্রে ভারত এগিয়ে অনেকটাই। জনগণনা-বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী চার-পাঁচ দশকে ভারতের জনসংখ্যায় কর্মক্ষম মানুষের অনুপাত থাকবে চিনের থেকে বেশি। তুলনায় নির্ভরশীল বৃদ্ধদের সংখ্যা থাকবে কম। ২০৩৬ সালে কর্মক্ষম মানুষ দাঁড়াবে সর্বোচ্চ, জনসংখ্যার পঁয়ষট্টি শতাংশ। অন্যদিকে, ২০২০ সালের পর থেকে ২০৪০ সাল পর্যন্ত চীনে ষাট পেরোনো মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৭৫ শতাংশ, ইঙ্গিত মিলেছে এমনটাই।