আবহমান কাল ধরেই বাংলার গুড়ের উৎকর্ষ খাদ্যরসিকদের মনে উজ্জ্বল। তবে এ রাজ্যে গুড়ের স্মৃতি প্রাচীন হলেও তা বর্তমানে বিস্মৃতির ছায়ায়৷ ‘বাংলাপণ’-এর উদ্যোক্তারা সেই গবেষণার কাজও শুরু করেন৷ শক্তিনাথ ঝা-এর মতো গবেষকদের সাহায্য নেওয়া হয়৷ বাংলাপণ এরপর মূলত গুড়ের প্রকারভেদের দিকে চলে যায়৷ আরও বিশেষ ধরনের গুড় তৈরিতে মন দেওয়া হয়। স্বাদ ও গন্ধে বাংলার গুড় রাজার আসন পেয়েছে বাংলার খাদ্যতালিকায়৷ কিন্তু আদি গুড়ের ঐতিহ্য থেকে সময়ের চাপে তা সরে এসেছে৷ বাংলাপণের হাত ধরেই এসেছে একের পর গুড়ের সমাহার৷ যা তৈরি করেছে ‘গুড়মল্লার’৷ অনেকদিন আগেই শুরু হয়েছিল ‘জিরেন গুড়’-এর যাত্রা৷ জিরেন অর্থে জিরিয়ে নেওয়া৷ গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতে থাকলেই চলে না৷ মাঝে মাঝে গাছকে জিরিয়ে নিতে বা বিশ্রাম নিতে দিতে হয়৷ সেই থেকেই নামকরণ ‘জিরেন গুড়’৷ জৈবচাষে আগ্রহী অরুণাভ, সৌম্যরা প্রথমবার গুড়ের ব্র্যান্ডিং করতে শুরু করেন৷ বাজারজাত হয় জিরেন গুড়৷ সেইটা ঘটনাচক্রে বিক্রি করতে শুরু করেন সুমিত৷ এর পরই কৌতুহল তৈরি হয় বাঁকুড়ার জিরেন গুড় নিয়ে৷ সেই থেকে শুরু হয় বাণিজ্যিকরণের কৌশল৷ গুড়ের প্যাকিং হয় একেবারে সাবেকি ঢঙে৷ গামছা, ঝুড়ির সংযোগে৷ কিন্তু সে ভাবে তো বিদেশে বা অন্য রাজ্যে গুড় পাঠানো মুশকিল৷ সেই কারণে আরও রূপ পরিবর্তন করে কাচের বোতলে গুড় পরিবেশন করতে শুরু করা হল৷ ইন্টারনেট মাধ্যমে প্রচারও আরম্ভ হয়৷
উল্লেখ্য, গুড় যাঁরা সংগ্রহ করেন, তাঁদের বলা হয় ‘শিউলি’৷ সেই শিউলিদের সহযোগে এরপর একে একে তৈরি হয় ‘রাতের নলেন’, ‘প্রথম নলেন’-এর মতো প্রকারভেদ৷ রাতের নলেন বলতে বোঝানো হয়, সূর্যাস্তের পর রস সংগ্রহ করা শুরু করে সূর্যাস্তের আগেই গুড় তৈরির কাজ সম্পন্ন করা৷ এরকমই প্রথম কাট বা ফার্স্ট কাটের পর যে নলেন হয়, তাকে বাংলাপণ নাম দেয় ‘প্রথম নলেন’৷ এর পর আসবে ‘দো-কাট্টা’ নলেনও৷ একই গাছে চাররকমের রস হবে, তার চাররকমের নামকরণ করবে সংস্থা৷ বাংলাপনের সদস্য সুমিত দাস জানালেন, ‘‘এভাবেই বাংলার ঐতিহ্য ও ফেলে আসা গুড়ের ঐতিহ্যের পথে আমাদের যাত্রা৷ বাংলার নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশের কাছে আমরা যে পৌঁছে যেতে পেরেছি, তা সত্যিই আমাদের আনন্দ দিয়েছে৷ এর পরেও বাংলাজুড়ে থাকা গুড়ের ঐতিহ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ইচ্ছা আমাদের আছে৷’’ শুধু তাই নয়, এ বার সেই নিয়ে তৈরি হয়েছে মিষ্টিও৷ কলকাতার পাথুরিয়াঘাটার ময়রা রামচন্দ্র দাসের পৌত্র মাখনলালের হাত দিয়ে যে মিষ্টির যাত্রা শুরু হয়, সেই মিষ্টি অধুনা বাংলাপনের হাত ধরে নতুন রূপ পেল৷ গিরিশপার্কে মাখনলাল অ্যান্ড বেলসে বাংলাপনের গুড়ের হাত ধরে নতুন করে তৈরি হয়েছে দু’টি মিষ্টি ‘জিরেন মাখনি’ ও ‘মাখনি ঝুরা’৷ তা ইতিমধ্যেই এসে গিয়েছে বাজারে, জয় করতে শুরু করেছে মানুষের মন৷ ‘‘মাখন ময়রার মিষ্টিতে আমরা সবসময় গুণগত মান খেয়াল রাখি৷ সেই দিক থেকে এই মিষ্টি তৈরির আগে আমরা বাংলাপণের গুড় আনিয়ে দেখেছিলাম৷ আমাদের অভিজ্ঞ কারিগররা সেটি বিচার করে মিষ্টিটি তৈরি করে৷ সেই মিষ্টি এবার বাজারে সেই মিষ্টি এল’’, জানিয়েছেন এই সংস্থার অন্যতম অধিকর্তা রিমিতা দাস।