আজ ১৫ই আগস্ট। ৭৫ বছর আগে ঠিক এই দিনেই স্বাধীনতার আলো দেখেছিল ভারতবর্ষ। তবে এর পাশাপাশি চোখ রাখা যাক আরো একটি তাৎপর্যপূর্ণ তথ্যে। স্বাধীনতা লাভের আনন্দে যখন সারা দেশে উৎসবের আবহ, তখন এক অজানা আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা নেমে এসেছিল দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাটে। ১৪ই আগস্ট রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও পাকিস্তানি নেতারা বালুরঘাট হাইস্কুলের দখল নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ১৮ই আগস্ট বালুরঘাট ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। আর তাই আজও ১৫ই আগস্টের পাশাপাশি ১৮ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস পালন করেন বালুরঘাটবাসী। একইভাবে ওই দিনেই ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল মুর্শিদাবাদ এবং নদীয়া জেলাও। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট সকালে মহকুমাশাসক পানাউল্লা পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা তোলেন বালুরঘাটে। শহরের নাট্যমন্দির থেকে জেলা সদর আদালত পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে সুসজ্জিত ছিল পাকিস্তানি পতাকায়। স্বাধীনতা সংগ্রামীরা সশস্ত্রভাবে এর প্রতিরোধ গড়ে তোলেন বালুরঘাটে। তৎকালীন বালুরঘাট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক কুমুদরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের সাহসিকতায় হাইস্কুল চত্বরে পাকিস্তানি পতাকা তুলতে পারেনি সেদেশের ফৌজ। সেই সময় স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ বালুরঘাটসহ রায়গঞ্জ ও অসমের বেশ কিছু এলাকাকে ‘ন্যাশনাল এরিয়া’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। অবশেষে ১৭ই আগস্ট বর্তমান বাংলাদেশের ধামারহাট, পোরসা, পত্নীতলা থানাগুলি বাদ দিয়ে বালুরঘাটসহ মোট পাঁচটি থানা এলাকা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮ই আগস্ট সকালে বালুরঘাটে ভারতীয় জওয়ানরা পজিশন নেন। পাকিস্তানি সেনাদের বালুরঘাট ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পরেই ফিরে যায় পাকিস্তানি সেনা। এরপর ১৮ই আগস্ট প্রশাসনিকভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়, স্বাধীন হয়েছে বালুরঘাট। স্বাধীন বালুরঘাটে প্রথম সরোজরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় ভারতের পতাকা তোলেন। এরপর ১৯শে আগস্ট বালুরঘাট হাইস্কুল ময়দানে স্বাধীনতার বিজয় উৎসব পালন করেন বালুরঘাটবাসী।
ফলত ১৮ই আগস্ট দিনটিকে তাঁদের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে মানেন শহরের বাসিন্দারা। আর সেই কারণেই আজও ১৮ আগস্ট শ্রদ্ধার সঙ্গে তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলন করে স্যালুট জানায় বালুরঘাটবাসী। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় নদীয়া জেলার বিস্তীর্ণ অংশ চলে গিয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে। ১৫ই আগস্ট দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যা নিয়ে উদ্যোগী হয়েছিলেন পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র, বি আর অম্বেদকররা। শেষ পর্যন্ত দু’ দিন পরে এই তিন জেলাই ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। সেই ইতিহাসকে মাথায় রেখেই রবিবার নদীয়া জেলার বিভিন্ন জায়গায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে টানা ১৭ই আগস্ট পর্যন্ত ৩ দিন ধরে পূর্ব পাকিস্তানের অধীনে ছিল মুর্শিদাবাদ জেলা। স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের নেতৃত্বে বাউন্ডারি কমিশনের সুপারিশ অনুসারে মুর্শিদাবাদ জেলা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে৷ আর পাল্টা খুলনা জেলা যুক্ত হয়েছিল ভারতের অংশে। সেই দিন ১৯৪৭এর ১৫ই আগস্ট জেলার সদর শহর বহরমপুরের ব্যারাক স্কোয়ার মাঠে পাকিস্তানের নামে প্রথম স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান পালিত হয়। মুর্শিদাবাদকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে দিল্লীতে তড়িঘড়ি কংগ্রেস নেতা শশাঙ্কশেখর স্যান্যাল মুর্শিদাবাদকে ভারতের মধ্যে ঢোকাতে তৎপর হন। রাজনৈতিক দলগুলির পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হয়, গঙ্গা নদীকে ধরে ভৌগলিক সীমারেখা পুনরায় সংশোধন করে মুর্শিদাবাদকে ভারত ও খুলনা জেলাকে পূর্ব পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করার। কলকাতা বন্দরের নিরাপত্তার বিষয়টিও আলোচনায় ওঠে। অবশেষে ১৭ই আগস্ট ১৯৪৭, সরকারিভাবে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় মুর্শিদাবাদ। পরের দিন ১৮ই আগস্ট মুর্শিদাবাদে প্রথম স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়। বহরমপুর শহরের বুকে আরও একবার ব্যারাক স্কোয়ার মাঠে জেলাশাসক আই আর খান নিজে হাতে তোলেন ভারতের জাতীয় পতাকা। মঞ্চে সুধীর সেনের গলায় ভেসে ওঠে গান। তাই বালুরঘাট, নদীয়ার মতোই স্বাধীনতার আস্বাদ একটু দেরিতেই পেয়েছিল মুর্শিদাবাদ।