রুশপন্থী বিদ্রোহীদের দখলে থাকা ডোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে রাশিয়া ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্রের মর্যাদা দেওয়ার পরই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। অবশেষে সমস্ত আশঙ্কাকে সত্যি করে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিয়েছে মস্কো। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ইউক্রেনের মাটিতে রাশিয়ার মিলিটারি অপারেশন চলছে। এই পরিস্থিতিতে প্রাণ হাতে করে ইউক্রেন থেকে দেশে ফিরছেন ভারতীয় পডুয়ারা। ওঁরা যুদ্ধ দেখেছেন। কিন্তু এক দিন যুদ্ধ থেমে যাবে। শান্ত হবে ইউক্রেন। আর তারপরেই ওঁরা ফিরে যেতে চান সেই দেশে। যেখানে জমা রাখা আছে ওঁদের চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন। ওঁদের একার নয়, পরিবার, পরিজনদেরও স্বপ্ন। যে স্বপ্নের মধ্যে মিশে আছে অনেক অনেক অর্থও।
সিউড়ির শাহরুখ থেকে সোনারপুরের শ্রীমা, ইউক্রেন থেকে প্রাণ হাতে করে ফেরা বাংলার পড়ুয়ারা বলছেন, ফের যাবেন। আসলে কারও বাবা জমিজমা বিক্রি করে পাঠিয়েছেন, কারও মা বিয়ের গয়না বন্ধক রেখেছেন, কারও পরিবার আবার মোটা সুদে ঋণ নিয়েছেন। সকলেই চেয়েছেন সন্তানের স্বপ্ন সফল হোক। দেশে সুযোগ না পেলেও বিদেশ থেকে ডাক্তারির ডিগ্রি নিয়ে আসুক। কে জানত এমন করে যুদ্ধ আছড়ে পড়বে! ক’দিন আগেও যাঁরা ভাবছিলেন ছেলেমেয়েরা ঠিকঠাক ফিরে আসুক, তাঁরাই এখন ভাবছেন আবার পাঠাতে হবে।
বীরভূমের সিউড়ি শহরের সাজানো পল্লির বাসিন্দা শাহরুখ সুলতান আহমেদ বাড়ি ফেরার পথে। তাঁর বাবা আফতাবউদ্দিন বলেন, ‘যেতে তো হবেই। অনেক টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষাতেও পাশ করে গিয়েছে। এখন শুধু বাকি ইউক্রেন সরকারের নেওয়া শেষ পরীক্ষাটা। সেটা হওয়ার কথা আগামী ২৪ মে। যুদ্ধ থেমে গেলে নিশ্চয়ই কিছু একটা হবে।’ সরকারি চাকরি করতেন আফতাবউদ্দিন। তাঁর বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। বাবার সঞ্চয় আর নিজের সঞ্চয় মিলিয়েও শাহরুখের ইউক্রেনে পড়ার টাকা জোগাড় করতে পারেননি আফতাবউদ্দিন। আত্মীয়-স্বজনরাও টাকা দিয়েছেন।
যদিও ভরসা হারাচ্ছেন না আফতাবউদ্দিন। বলেন, ‘যুদ্ধের জন্য তো আর পড়ুয়ারা দায়ী নয়। আশা করি অনলাইনে পরীক্ষার ব্যবস্থা হবে। অথবা যুদ্ধ থামলে ওখানে গিয়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হবে।’ অনলাইনে পরীক্ষা হলে ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে ডিগ্রি মিলতে পারে বলেও আশা করছে শাহরুখের পরিবার। অন্যদিকে, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলে মেয়েকে ইউক্রেনে ডাক্তারি পড়তে পাঠিয়েছিলেন প্রাক্তন রেলকর্মী সোনারপুরের সুখেন্দু ঘরামি। ওডেসা ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী শ্রীমা ঘরামি বাড়ি ফিরেছেন অনেক কষ্টে। কিন্তু মাঝপথে তো আর ডিগ্রি ফেলে রাখা যায় না। তাই বাড়ি ফেরার পরেই তাকিয়ে রয়েছেন ছেড়ে আসা ইউক্রেনের দিকে।
সুখেন্দুবাবু বলেন, ‘এখন যা পরিস্থিতি তাতে সম্ভব না হলেও পরে যেতে তো হবেই।’ যদিও ইউরোপের অন্য দেশের কোনও মেডিক্যাল কলেজে ট্রান্সফার নেওয়ার ব্যবস্থা হতে পারে কি না তা নিয়েও ভাবনা রয়েছে শ্রীমার। তবে আপাতত ক’টা দিন বিশ্রাম নিতে চান তিনি। কমপক্ষে অনলাইন ক্লাস কবে থেকে শুরু হয় তার অপেক্ষায় থাকা। শ্রীমার কথায়, ‘চার বছর হয়ে গিয়েছে। বাকি আর দু’বছর। লেখাপড়া তো শেষ করতেই হবে।’ একই সঙ্গে গত কয়েকটা দিনের কথাও বললেন শ্রীমা। মলডোভা সীমান্ত ক্রস করে রোমানিয়া পর্যন্ত পৌঁছতে কম কষ্ট করতে হয়নি। তবে তাঁর সাফ কথা, ‘বাড়ি ফিরে আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু আবার যাব। যেতে তো হবেই। এত কষ্ট দেখে নিয়েছি। না হয়, আরও একটু কষ্ট হবে।’