সম্প্রতি কোভিডমুক্ত হয়েছিলেন তিনি। লড়াই করে হার মানিয়েছিলেন নিউমোনিয়াকেও। তবে কিছুদিন আগে ফের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয় তাঁর। দেওয়া হয় ভেন্টিলেশনে। আর রবিবার সকালে ৯২ বছর বয়সে চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিলেন সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর। বিগত ৮ই জানুয়ারি লতা মঙ্গেশকরের করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর প্রকাশ্যে আসে। পরে জানা যায় করোনা ভাইরাসের পাশাপাশি নিউমোনিয়াতেও আক্রান্ত কিংবদন্তি গায়িকা। একটানা মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন কোকিলকণ্ঠী। মাঝে তাঁর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় ভেন্টিলেশন থেকেও সরানো হয়েছিল। কিন্তু শনিবার ফের লতা মঙ্গেশকরের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। আবারও ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয় তাঁকে। আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন চিকিৎসকরা। কিন্তু এদিন থেমে গেল সব লড়াই। পার্থিব বাঁধন ছিঁড়ে সুরলোকে বিলীন হয়ে গেলেন কিংবদন্তি গায়িকা।
উল্লেখ্য, ১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মধ্যপ্রদেশের ইনদোরের এক পরিবারে জন্ম হয় লতা মঙ্গেশকরের। বাবা পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর ছিলেন মারাঠি সঙ্গীত জগতের বিখ্যাত ধ্রুপদী গায়ক। বাবার থেকেই প্রথম গানের তালিম নেওয়া। মাত্র ১৩ বছর বয়সে একটি সিনেমার জন্য প্রথমবার গান রেকর্ড করলেও, তা পরবর্তী সময়ে ছবি থেকে বাদ পড়ে। ১৯৪৫ সালে মুম্বইয়ে পাড়ি দেন তিনি। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। সেখানে উস্তাদ আমান আলি খানের কাছে ধ্রুপদী সঙ্গীত শেখেন। পরের বছর একটি হিন্দি ছবির জন্য প্লেব্যাকে গান করেন। এরপর বাঙালি প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় হয় লতা মঙ্গেশকরের। তাঁর ছবি ‘শহিদ’-এ কাজের সুযোগ পেলেও সরু কণ্ঠের জন্য পছন্দ হয় না সংগীতকারের। ১৯৪৮ সালে ‘মজবুর’ সিনেমায় প্রথম বড় ব্রেক পান লতা। নেপথ্যে ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দার। পরবর্তী সময়ে লতা মঙ্গেশকর সাক্ষাৎকারে জানান যে, গুলাম হায়দার সত্যিই তাঁর গডফাদার। তাঁর মেধার উপর পূর্ণ আস্থা রেখেছিলেন তিনিই।
প্রসঙ্গত, বিগত ১৯৫০ থেকে দীর্ঘ কয়েক দশক কোকিলকণ্ঠীর গান মোহাবিষ্ট করেছে দেশবাসীকে। ‘আয়েগা আনেওয়ালা’, ‘প্যার কিয়া তো ডরনা কেয়া’, ‘আল্লা তেরো নাম’, ‘কঁহি দীপ জ্বলে’, ছয় ও সাতের দশকে এসব গান জনপ্রিয়তার যে শিখর ছুঁয়েছিল, তা আজও অম্লান। বহু বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন সুরসম্রজ্ঞী। এমনকী বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই নিজের তৈরি গান লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। স্বনামধন্য সংগীত পরিচালক এ আর রহমান নয়ের দশকে ‘দিল সে’ ছবিতে তাঁকে দিয়ে গান গাওয়ান। ‘জিয়া জ্বলে’ গানটিতে আজও একক এবং অদ্বিতীয় লতা মঙ্গেশকর। তাঁর সুরে আচ্ছন্ন আসমুদ্রহিমাচল।
সুনিষ্ঠভাবে সুরসাধনার পুরস্কারও কম পাননি লতা। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা ছাড়াও ঝুলিতে এসেছে সিনে অ্যাওয়ার্ড অফ লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট থেকে শুরু করে পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ, দাদাসাহেব ফালকে, ফিল্মফেয়ার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট, ভারত রত্ন-সহ একাধিক সম্মান। বছর কয়েক ধরে ধীরে ধীরে জনসমক্ষে ফিকে হচ্ছিল লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠ। অসুস্থতার জন্য খুব বেশি কাজ করতে পারতেন না। তবে উরিতে ভারতীয় জওয়ানদের সাফল্য কিংবা পরবর্তী সময়ে দেশে তোলপাড় ফেলে দেওয়া বিভিন্ন বিষয়ে নিয়ে ছোট করেই দিয়েছেন সুরেলা বার্তা। শ্বাসকষ্টের জেরে গুরুতর অসুস্থ হয়ে মুম্বইয়ের বিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। প্রাথমিক সংকট কাটিয়ে কিছুটা স্থিতিশীল হলেও চিকিৎসকরা তাঁকে পর্যবেক্ষণে রাখেন। পরে তাঁকে ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয়েছিল। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন সুরসম্রাজ্ঞী।