এবার মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আজব যুক্তি সাজাল মোদী সরকার। জিনিসপত্রের বেশি দাম নাকি শুধু শহরেই! গ্রামে সবই নাকি সস্তা! অর্থমন্ত্রকের নভেম্বর মাসের রিভিউ রিপোর্টে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। অর্থমন্ত্রকের ডিপার্টমেন্ট অব ইকনমিক অ্যাফেয়ার্স প্রতি মাসেই প্রকাশ করে অর্থনীতি সংক্রান্ত রিপোর্ট। এই রিপোর্ট দেখলে মনে হবে, অর্থনীতি, বাণিজ্য, কৃষি, রপ্তানি, শিল্পোৎপাদন, জিডিপি বৃদ্ধির হার—প্রতিটি বিভাগেই ভারত চূড়ান্ত সফল। অর্থনীতি নাকি অনেকটাই সবল। মন্দা তো দূরের কথা, মূল্যবৃদ্ধিই নাকি দেশ থেকে উধাও হয়েছে। সেজন্যই নরেন্দ্র মোদীর সরকার মূল্যবৃদ্ধিকে আজ আর কোনও সমস্যা বলেই মনে করছে না। আর এই রিপোর্ট ঘিরেই শুরু হয়েছে বিতর্ক।
প্রসঙ্গত, কয়েকদিন আগে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার গভর্নর শক্তিকান্ত দাস নীতি নির্ধারণ কমিটির বৈঠকের পর সবথেকে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে। বলেছিলেন, আপাতত মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম টানার কোনও সম্ভাবনা নেই। বরং আগামী কয়েক মাসে আরও বাড়বে নিত্যপণ্যের দাম। এমনকী তাঁর দাবি, শীতের ফসল বাজারে চলে আসা সত্ত্বেও খাদ্যপণ্যের দামের উপর তার বিশেষ প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। আগামী আর্থিক বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক, অর্থাৎ জুলাই মাসের পর আশা করা যায় মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আসবে।
উল্লেখ্য, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই উদ্বেগের পরও অর্থমন্ত্রক কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ওয়াকিবহাল নয়। তাদের মাসিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, মূল্যবৃদ্ধি থাকলেও সেটা শহরে কিছুটা লক্ষ্য করা গিয়েছে। গ্রামীণ এলাকায় নাকি কোনও মূল্যবৃদ্ধিই নেই। বরং গ্রামে জিনিসপত্র বেশ সস্তা। তার নেপথ্যে সরকার কী যুক্তি দিচ্ছে? প্রথম যুক্তি, গত কয়েক মাসে গ্রামীণ এলাকায় ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্বিতীয়ত, বেড়েছে কৃষি উৎপাদনের হার। তাই গ্রামাঞ্চলে জিনিসপত্রের দাম মোটেও বাড়েনি। বরং অর্থমন্ত্রকের রিপোর্ট দাবি করছে, গ্রামীণ ভারতে ট্রাক্টর বিক্রি এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়েছে। অর্থাৎ সরকার বোঝাতে চাইছে, গ্রামীণ এলাকায় মূল্যবৃদ্ধির লেশমাত্র নেই।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, দেশের আনাচ-কানাচ থেকে যে মূল্যবৃদ্ধির আঁচ পাওয়া যাচ্ছে, তার কারণ কী? সরকারের যুক্তি, এটা ভারতে শুধু নয়। আমেরিকা, চীন, ইউরোপ—সর্বত্রই হচ্ছে। ওইসব দেশে-মহাদেশেও রেকর্ড পরিমাণ মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। বরং ভারতের মজুতদারির বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ, সরকারের কঠোর বিধিনিষেধ এবং নজরদারির কারণে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। গ্রামীণ এলাকায় তো ১০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন হয়েছে মূল্যবৃদ্ধির হার। সরকারের দাবি, খাদ্যশস্য, খাদ্যপণ্য, প্যাকেজড খাবার, সবকিছুর দামই কমে গিয়েছে। সরকার নিয়ম করে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিটি ফ্যাক্টর কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করে এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যথাসম্ভব ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।
দেশের বাস্তব চালচিত্র কি একই কথা বলছে? একদমই নয়। তার প্রধান কারণ অগ্নিমূল্য পেট্রোল-ডিজেল। জ্বালানির দাম কিন্তু শহরে বেশি, গ্রামে কম হয় না। বরং পরিবহণ খরচের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে ডিজেল-মূল্য। আর ডিজেল খরচ বাড়লে তার সরাসরি প্রভাব জিনিসপত্রের উপর পড়বেই। ফলে কলকাতার তুলনায় ঝালদায় জ্বালানির দাম বেশি। দেশের মধ্যে প্রথম পেট্রল ১০০ টাকা ছুঁয়েছিল রাজস্থানের গঙ্গারামপুরে। জয়পুর বা যোধপুরে নয়। একই অঙ্ক খাটে ভোজ্য তেলের ক্ষেত্রেও। শহর-গ্রাম হিসেব কষে এই ধরনের পণ্যের দাম কম-বেশি হয় না। ফলে সরকারের সাজানো যুক্তি ধোপে টিকছে না।
পাশাপাশি এই রিপোর্টে আরও একটি বিস্ময়কর দিক রয়েছে। মোদী সরকার স্বীকার করেছে, ২০০৩ সাল থেকে ২০১০ সাল, এই সাত বছর ভারতের অর্থনীতির সেরা সময়। সরকারি রিভিউ রিপোর্টে একটি বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ওই সমীক্ষাতেই আশা প্রকাশ করা হয়েছে, ২০০৩ থেকে ২০১০ সালের অর্থনীতির মতোই উন্নতি করার মতো অবস্থায় অচিরেই পৌঁছে যাবে মোদীর ভারত। উল্লেখযোগ্য বিষয়, এই সময়সীমার প্রথম বছরটি ছাড়া বাকি সবটাই ইউপিএ জমানা। অর্থাৎ ইউপিএ আমলের বেহাল অর্থনীতির যে অভিযোগ মোদী সরকার এতদিন করে এসেছে, তাও এক্ষেত্রে অযৌক্তিক হয়ে পড়েছে।