সামাজিক মাধ্যমে মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিতের চেয়ে লাভের দিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ফেসবুক। তবে জনপ্রিয় এই সামাজিক মাধ্যমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জুকারবার্গ সম্প্রতি ওঠা এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। মার্কিন আইনপ্রণেতাদের ফেসবুকের সাবেক এক কর্মী বলেছেন, এই সামাজিক মাধ্যম শিশুদের ক্ষতি করছে এবং আমাদের গণতন্ত্রকে দুর্বল করে তুলছে। গত জানুয়ারিতে ট্রাম্প সমর্থকদের ক্যাপিটল হিলে হামলার ঘটনার এক শুনানিতে ফ্রান্সিস হুগেন নামে ৩৭ বছর বয়সী ফেসবুকের সাবেক পণ্য ব্যবস্থাপক এই সামাজিক মাধ্যমের তীব্র সমালোচনা করেছেন। প্রসঙ্গত, ফেসবুকের আন্তর্জাতিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে হুগেনের আইনজীবীরা কোম্পানির অভ্যন্তরীণ নথির উদ্ধৃত করে বলেছেন, ফেসবুকে নির্বাচনী কার্যকলাপের নিরিখে ভারত ‘টিয়ার -০’ তে রয়েছে। এছাড়া গোটা বিশ্বে মাত্র ব্রাজিল এবং আমেরিকাই রয়েছে টিয়ার-০ তে। বাকি দেশগুলিতে ভোট কেন্দ্রীক প্রচারে তেমন বিনিয়োগ করা হয় না। প্রচলিত আছে যে গোটা বিশ্বের ৮৭% সম্পদ ব্যবহার করে আমেরিকা। আর বাকিরা সম্পদের মাত্র ১৩% ব্যবহারের সুযোগ পায়। যা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কারণ আদতে ফেসবুকের অ্যাক্টিভ ব্যবহারকারীর মাত্র ১০% আমেরিকা, কানাডার বাসিন্দা।
সবচেয়ে অবাক করার মতো পরিসংখ্যান হল যে, ফেসবুক কেবলমাত্র ৩-৫% বিদ্বেষমূলক পোস্ট এবং ০.২% ‘সহিংসতা এবং উত্তেজক’ বিষয়বস্তু দমন করতে সক্ষম। একই অভিযোগে, হগেনের আইনজীবীরা কোম্পানি ‘অ্যাডভারসারিয়াল হার্মফুল নেটওয়ার্কস-ইন্ডিয়া কেস স্টাডি’ নামে একটি অভ্যন্তরীণ নথি উদ্ধৃত করে দেখায় যে কোম্পানিটি মুসলিম বিরোধী বিষয়বস্তু সম্পর্কে ভালভাবে অবগত। এবং যারা এই ভীতি প্রদর্শক প্রচার করে তারা মূলত আরএসএস সমর্থক। নথিতে বলা হয়েছে, ‘মুসলিম বিরোধী আখ্যানগুলি হিন্দুপন্থী জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে প্রচার করা হচ্ছে। মুসলমানদের ‘শূকর’ এবং ‘কুকুর’-এর সাথে তুলনা করে এমন অনেক অমানবিক পোস্ট করা হচ্ছে। এমনকী কোরানে পুরুষদের তাদের পরিবারের সদস্যদের ধর্ষণ করার নির্দেশ দেওয়া আছে বলে ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছিল।’ নথিতে স্থানীয় ভারতীয় ভাষায় এই ধরনের বিষয়বস্তু ট্র্যাক করার জন্য কোম্পানির প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাবকেও দায়ী করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, “আমাদের হিন্দি এবং বাংলা শ্রেণীবিন্যাসের অভাবের এই মুসলিম বিরোধী বিষয়বস্তুগুলির বেশিরভাগকেই ফ্ল্যাগ করা হয়না বা এদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেওয়ার হয় না।”
পাশাপাশি, শ্রেণীবিন্যাস শব্দটি ফেসবুক অভ্যন্তরীণভাবে তার ঘৃণা-বক্তৃতা সনাক্তকরণ অ্যালগরিদমগুলি বোঝাতে ব্যবহার করে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, ফেসবুক প্রকাশ্যে বলেছে যে কোম্পানির অ্যালগরিদমগুলির মাধ্যমে বিদ্বেষমূলক পোস্টগুলিকে চিহ্নিত করতে চারটি সরকারী ভারতীয় ভাষা – হিন্দি, বাংলা, উর্দু এবং তামিলকে এর আওতায় আনা হয়েছে। বিষয়টি থেকে এটা স্পষ্ট যে রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার কারণে ফেসবুককে আরএসএস সমর্থকদের দ্বারা প্রচারিত ভীতি প্রদর্শক পোষ্টের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। ফেসবুকের বিরুদ্ধে আরও একটি বড় অভিযোগ এই যে প্ল্যাটফর্মটিতে ভুয়ো তথ্যের অবাধ যাতায়াত একটি অভ্যন্তরীণ গবেষণায় বলা হয়েছে যে, ভারত, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইনে প্রতি ঘন্টায় ১০ থেকে ১৫ লক্ষ ভুল তথ্য সম্প্রচারিত হয়। বাংলা এবং হিন্দিতে লোকজনের অভাবের জন্য সেরকম কনটেন্টের বেশিরভাগটাই ফেসবুকের নজরে আসে না বা কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে দাবি করেছেন ফেসবুকের সিভিক ইন্টেগ্রিটি গ্রুপের প্রাক্তন প্রোডাক্ট ম্যানেজার। এর মূল কারণ হল ফেসবুক যাকে ‘ডিপ রিশেয়ারস’ বলে উল্লেখ করে-এমন পোস্টগুলি যাতে চাঞ্চল্যকর, ক্ষতিকারক বা বিভাজক বিষয়বস্তু থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে, তা অনেকবার শেয়ার করা হয়।
সম্প্রতি ফেসবুক অভ্যন্তরীণ বিশ্লেষণে জানিয়েছে যে, ভুল তথ্য সংক্রান্ত পোস্টগুলিকেই বার বার শেয়ার করা হয়। ফেসবুকের একটি জরিপে বলা হয়, বাংলার ৪০% ব্যবহারকারীই ভুয়ো। ২৮ দিনে রাজ্যে ৩ কোটিরও বেশি ভুয়ো পোস্ট করা হয়েছে। যদিও ফেসবুক এই জরীপ কবে করেছিল তা পরিষ্কার নয়। রাজনৈতিক মুনাফার উদ্দেশ্যেই যে এই ভুয়ো পোস্ট তা একপ্রকার পরিষ্কার। আরও একটি বিষয় সামনে এসেছে। একই ব্যবহারকারীর একাধিক অ্যাকাউন্ট। অর্থাৎ ভুয়ো প্রোফাইল। কোম্পানির ‘লোটাস মহল’ নামের অভ্যন্তরীণ নথিতে দাবি করা হয়েছে যে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বিজেপি আইটি সেলের হাজার হাজার ভুয়ো প্রোফাইলের বিষয়ে অবগত। ফেসবুকের তরফে একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছিল, তাতে দেখা গিয়েছিল যে বাংলার ৪০ শতাংশ প্রথমসারির ‘ভিউ পোর্ট ভিউস’ (ভিপিভি) সিভিক পোস্টারই ভুয়ো বা অসত্য। একটি ক্ষেত্রে এমনই একটি অসত্য পোস্টে গত ২৮ দিনে ৩০ মিলিয়নের বেশি ভিউ হয়েছিল (সবথেকে বেশি ভিউ পোর্ট ভিউস)। তবে কোন সময়ের মধ্যে সেই সমীক্ষা চালানো হয়েছিল, সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। হুগেনের আইনজীবীদের দাবি, এর পরেও ফেসবুক চুপ থাকে কারণ আদতে এরাই কোম্পানিটির বিজ্ঞাপনদাতা।