রোহিণী আদালত চত্বরের স্ক্যানার নিষ্ক্রিয় ছিল। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই আইনজীবীর পোশাকে এজলাসের ভিতরে ঢুকে পড়েছিল আততায়ীরা। কুখ্যাত গ্যাংস্টার জিতেন্দ্র গোগিকে কাঠগড়ায় তুলতেই সামনে থেকে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হল তাঁকে। আততায়ীর গুলিতে মৃত্যু হয়েছে দিল্লী পুলিশের স্পেশাল সেলের দুই কর্মীর। পাল্টা গুলিতে মত্যু হয়েছে দুই আততায়ীরও। আদালতের ভিতরেই ‘গ্যাং ওয়ার’-এ শিউরে উঠেছে সকলেই। দিল্লীর অন্যতম বড় গ্যাংস্টার ছিলেন জিতেন্দ্র গোগি। তাঁর বিরুদ্ধে ১৯টি খুনের মামলা রয়েছে। তোলাবাজি, অপহরণ, খুন করে মাত্র ৩০ বছর বয়সেই অপরাধ জগতের বড় নাম হয়েছিল গোগি। টিল্লু গ্যাংয়ের সঙ্গে তাঁর শত্রুতার বিষয়েও সকলেই অবগত ছিলেন। সেই টিল্লু গ্যাংয়ের সদস্যদের হাতেই শেষমেশ প্রাণ হারাতে হল জিতেন্দ্র গোগিকে।
প্রসঙ্গত, ১৯৮৪ সালে দিল্লীতেই জন্ম হয়েছিল জিতেন্দর মান ওরফে জিতেন্দ্র গোগির। আলিগঢের বাসিন্দা গোগি অল্পবয়সেই অপরাধ জগতে প্রবেশ করলেও পড়াশোনায় তুখোড় ছিলেন। দ্বাদশ শ্রেণিতে দারুণ রেজাল্ট করে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধানন্দ কলেজে ভর্তি হয়, সেই সময়ই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন জিতেন্দ্র। ২০১০ সালে প্রিয় বন্ধু কুলদীপ ফাজকে নিয়ে যখন কলেজে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সেই সময়ই সুনীল তাজপুরিয়ার সঙ্গে দেখা হয়। বিরোধী দলের সমর্থনকারী সুনীল ওরফে টিল্লুর সঙ্গে প্রথম দিন থেকেই সুসম্পর্ক ছিল না তাঁর। নির্বাচন ঘিরে দুই দলের মধ্যে যে সংঘর্ষ শুরু হয় তা কলেজের গণ্ডি পার করেও জারি থাকে। কলেজে থাকাকালীনই লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে কুলদীপের সঙ্গে নানা সমাজবিরোধী কাজ করতে শুরু করে জিতেন্দ্র। প্রথমে ছোটখাটো ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের মতো কাজ করলেও ধীরে ধীরে অপহরণেও হাত পাকিয়ে ফেলে গোগি। তৈরি হয় গোগি গ্যাং। মূলত দিল্লীর বাইরে পানিপথ ও হরিয়ানাতেই সক্রিয় ছিল এই গ্যাং। খুন, অপহরণ, তোলাবাজি করেই বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়ে যায় জিতেন্দ্র। প্রায় ৫০ জন তাঁর দলে কাজ করত বলে জানা গিয়েছে।
তিহার জেলে বসে দুবাইয়ের ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা দাবি বা কখনও পুলিশের চোখে লঙ্কার গুড়ো ছিটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনার মাধ্যমেই বারংবার খবরের শিরোনামে উঠে এসেছিল জিতেন্দ্র গোগি। দিল্লি ও হরিয়ানা পুলিশ দীর্ঘদিন ধরেই খুঁজছিলেন গোগিকে। তাঁর খোঁজ দিতে পারলে বা তাঁর বিষয়ে কোনও তথ্য জানাতে পারলেই দিল্লি পুলিশ ৪ লক্ষ টাকা এবং হরিয়ানা পুলিশ ২ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। ২০১৭ সালে হরিয়ানার গায়িকা হর্ষিতা দহিয়াকে পানিপথে খুন করে খবরের শিরোনামে এসেছিলেন জিতেন্দ্র। জানা গিয়েছে, তিহার জেলে বসেই যাবতীয় সুপারি নিতেন জিতেন্দ্র। এরপরে ২০১৮ সালে রবি ভরদ্বাজ নামক এক ব্যক্তিকে ২৫টি গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় গোগি। এ দিকে, সুনীল ওরফে টিল্লুও গ্যাংস্টার হয়ে যাওয়ায় তার ব্যবসায় ভাগ বসাতে থাকে। বিষয়টিকে ভাল চোখে দেখেনি গোগি। কলেজ জীবনের সেই শত্রুতাই ধীরে ধীরে দুই গোষ্ঠীর লড়াইয়ে পরিণত হয়। ২০১৮ সাল থেকে চরম ওঠে দুই গ্যাংয়ের মধ্যে সংঘর্ষ। এখনও অবধি দুই গ্যাংয়ের কমপক্ষে ২৫ সদস্য এই শত্রুতায় প্রাণ হারিয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
উল্লেখ্য, গত চার বছর ধরে দিল্লী ও হরিয়ানা পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করার চেষ্টা করলেও প্রতিবারই চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যেত গোগি। অবশেষে গত বছরের ৩রা মার্চ গুরুগ্রাম থেকে গোগি ও কুলদীপ সহ মোট চারজনকে গ্রেফতার করে দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেল। রোহিত ওরফে মোই এবং কপিল ওরফে গৌরবও স্পেশাল সেলের হাতে ধরা পড়ে।।গোগিকে গ্রেফতারের ওই ভিডিও সে সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। শোনা যায়, ওই ভিডি্য়ো যদি ভাইরাল না হত, তবে সেদিনই গোগি ও তার সঙ্গীদের এনকাউন্টারের খতম করার পরিকল্পনা ছিল স্পেশাল সেলের। ২৫শে এপ্রিল আদালতে নিয়ে যাওয়ার পথেই পুলিশি হেফাজত থেকে পালিয়ে গেলেও ধরা পড়ে যায় জিতেন্দ্র। তারপর থেকেই তিহার জেলে ছিল সে। একটি মামলার শুনানিতে এ দিন দুপুরে উত্তর দিল্লীর রোহিণী আদালতে তাঁকে আনা হয়। এজলাসে তুলতেই আইনজীবীর পোশাকে আততায়ীরা তাঁর উপর গুলি চালায়। প্রায় ২৫ থেকে ৩০ রাউন্ড গুলি চলে। ঘটনায় মৃত্যু হয় আরও দুই পুলিশকর্মীরও। অন্যদিকে, পুলিশের গুলিতেও দুই আততায়ীর মৃত্যু হয়। দিল্লীর পুলিশ কমিশনার রাকেশ আস্থানা জানিয়েছেন, এই হামলার পিছনে ছিল টিল্লু গ্যাংয়েরই হাত।