‘বর্ণপরিচয়’-এর প্রণেতা তিনি। অথচ তাঁর জন্মস্থানই এতদিন পূর্ণ সাক্ষরতার চৌকাঠ ডিঙতে পারেনি, এ নিয়ে আক্ষেপ ছিল এলাকাবাসীর। এবার তা ঘুচল। অবশেষে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মস্থান বীরসিংহ ‘পূর্ণ সাক্ষর’ হল। বুধবার বিশ্ব সাক্ষরতা দিবসে সদ্য সাক্ষরদের নিয়ে এক বিশেষ পরীক্ষার পর এব্যাপারে ঘোষণা করেছে ঘাটাল মহকুমা প্রশাসন। মহকুমা শাসক সুমন বিশ্বাস বলেন, এলাকায় বেশ কয়েকজন নিরক্ষর ছিলেন। তাঁদের সাক্ষর করে তোলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন বীরসিংহ ভগবতী হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তথা বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দিরের সম্পাদক শক্তিপদ বেরা। শক্তিবাবুর বিগত কয়েক বছরের প্রচেষ্টায় এই সাফল্য এসেছে।
উল্লেখ্য, বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার সমিতির উদ্যোগে গত শতাব্দীর আটের দশকে সারা রাজ্য সহ ওই গ্রামেও সাক্ষরতা অভিযান শুরু হয়। ওই সময় বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার সমিতির কর্মকর্তা বিমান বসু বীরসিংহ মেলায় এসে ২০০১সালের মধ্যে বীরসিংহ গ্রামের সমস্ত মানুষকে সাক্ষর করে তোলা হবে বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু বাম আমলে ওই সময়ের মধ্যে বীরসিংহ গ্রামের সকলকে পূর্ণ সাক্ষর করে তোলা সম্ভব হয়নি। তারপর বামফ্রন্ট হাল ছেড়ে দেয়। ২০১৯ সালে বিদ্যাসাগরের জন্মের ২০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সেপ্টেম্বর মাসে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বীরসিংহে আসার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। মুখ্যমন্ত্রী আসার আগে পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক রশ্মি কমল বীরসিংহে এসে জনসহায়ক শিবির করেছিলেন। সেখানেও বীরসিংহকে পূর্ণ সাক্ষর করে তোলার দাবি ওঠে। তখনই প্রশাসন সাক্ষরতা নিয়ে সার্ভে করেছিল। সেই থেকেই এনিয়ে প্রশাসনিকভাবে বীরসিংহকে পূর্ণ সাক্ষর গ্রাম হিসেবে তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
বিগত ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, ওই গ্রামের জনসংখ্যা ছিল ৩০২৬ জন। বর্তমানে সেই সংখ্যা আরও কিছু বেড়েছে। ২০১৯ সালে সার্ভেতে ওই গ্রামে ৬৩ জন নিরক্ষর ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ৫৫ জনই মহিলা। তাঁদের বেশিরভাগের বয়স ৫০-এর উপরে। বীরসিংহ গ্রামের ওই ৬৩ জনকে সাক্ষর করে তুললে গ্রামটি পূর্ণ সাক্ষর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল। ওই সময়ই জেলাশাসক বীরসিংহ গ্রামের নিরক্ষরকে সাক্ষর করে তোলার জন্য বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দিদের সম্পাদক হিসেবে শক্তিবাবুকে দায়িত্ব দেন। শক্তিবাবু বলেন, “সেই থেকেই আমার যাত্রা শুরু। আমি গোটা গ্রামটিকে চারটি এলাকায় ভাগ করি। প্রত্যেক এলাকায় নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য একটি করে পাঠশালা করি। স্কুল ছুটির পর সেখানেই ভজহরি সোরেন, প্রতিমা সাঁতরা, প্রতিমা মল্লিক, লক্ষ্মী মল্লিক, চায়না সাঁতরা, শাসন্তা সাঁতরা, অপর্ণা সাঁতরাদের নিয়ে নিয়মিত পড়াতে বসতাম। ”
ছাত্রছাত্রীদের নানা ধরনের দাবিও পূরণ করতে হয়েছে শক্তিবাবুকে। তিনি বলেন, “কেউ বলেছিলেন চশমা না করে দিলে পড়তে আসবেন না। কেউ আবার পোশাক সেলাই করার পয়সা দেওয়ার দাবি করেন। এসব দাবি মেনে নিয়েই টানা দু’বছর ধরে পড়িয়ে বীরসিংহকে পূর্ণ সাক্ষর গ্রাম করা সম্ভব হয়েছে।” শক্তিবাবু বলেন, “বুধবার বিশ্ব সাক্ষরতা দিবস। তাই আগের দিন মঙ্গলবার ওদের কয়েকজনের পরীক্ষা নিই। সবাই তাঁদের নিজের নাম সই করতে পেরেছেন। অনেকে একটু-আধটু পড়তেও পারছেন।” তিনি বলেন, “এই কৃতিত্ব আমার একার নয়। প্রশাসন আমাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। পাশাপাশি বীরসিংহ গ্রামের চার-পাঁচজন শিক্ষিত যুবক নিয়মিত পাঠশালায় পড়িয়েছেন। তবেই এই গ্রামকে পূর্ণ সাক্ষর করা সম্ভব হল।”