জন্ম থেকে তিনি আর পাঁচজনের মতো নন। বাঁ পা ডান পায়ের তুলনায় ছোট। নয়ডার গোবিন্দগড় গ্রামের সেই ১৮ বছরের ছেলে প্রবীণ কুমার শুক্রবার টোকিয়ো প্যারালিম্পিক্সে হাই জাম্পে (টি৬৪) রুপো পেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। ২.০৭ মিটার লাফিয়ে রুপোর পদক প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে এশিয়া রেকর্ডও গড়েছেন দিল্লীর মতিলাল নেহরু কলেজের এই স্নাতক স্তরের ছাত্র।
একটি সাক্ষাৎকারে ওনাকে জানতে চাওয়া হয়, জীবনের প্রথম প্যারালিম্পিক্সে এসে পদক নিয়ে ফিরবেন, তা ভাবতে পেরেছিলেন? উনি বলেন, পদক পাব কি না, তা আগাম বলা বা ভেবে ফেলা মুশকিল। তবে এটা আমার প্রথম প্যারালিম্পিক্স হলেও প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা নয়। চলতি বছরেই দুবাইয়ে বিশ্ব প্যারা-অ্যাথলেটিক্স গ্রঁ প্রি-তে সোনা জেতার পরে এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে টোকিয়োতে নেমেছিলাম যে, দেশকে হতাশ করব না। তবে পদক অপেক্ষা করছে কি না, বা তার রং কী, এ সব নিয়ে এক মুহূর্তের জন্যও ভাবনাচিন্তা করিনি।
কৃত্রিম পায়ের (ব্লেড রানার) সাহায্য নিয়ে যাঁরা লাফ দেন, তাঁরা টি-৬৪তে নামেন। যাঁরা কৃত্রিম পায়ের সাহায্য নিয়ে লাফ দেন না, তারা টি৪৪। প্যারালিম্পিক্সে এই দুই ধরনের প্রতিযোগীদের নিয়েই টি৬৪ বিভাগে প্রতিযোগিতা হয়। সুতরাং আমার কোনও অসুবিধা হওয়ার ছিল না। আমাকে কেবল দেশের জন্য পদক আনতে সেরা লাফটা দিতে হত।
এই জয়ের আনন্দ বলে বোঝাতে পারব না! আমার বাবা অমরপাল এক জন ক্ষুদ্র কৃষিজীবী মানুষ। আমার জন্য অনেকের কাছে গিয়েই এক সময়ে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। বাবা খুব খুশি। আশীর্বাদ করলেন আরও এগিয়ে যাওয়ার। বরং খারাপ লাগছিল আমার। বাবাকে সোনার পদকটা দেখাতে পারব না ভেবে। বাবাকে কথা দিয়েছিলাম, টোকিয়ো থেকে সোনা নিয়ে ফিরব। তিন বছর পরে প্যারিস প্যারালিম্পিক্সে এই কথা আমাকে রাখতেই হবে।
বৃষ্টির জন্য খানিক অসুবিধা হয়েছে লাফ দিতে। তবে আমি সাফল্য পাওয়ার জন্য মরিয়া ছিলাম আজ। বৃষ্টির মধ্যে প্রথম লাফটা তাই ভাল হয়নি। ১.৮৩ মিটার দিয়েছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয় লাফে ১.৯৭ মিটার লাফিয়ে এ দিনের সোনাজয়ী ব্রিটেনের জোনাথন ব্রুম-এডওয়ার্ডস ও ব্রোঞ্জ জয়ী পোলান্ডের মাচি লেপিয়াতোর সঙ্গে সেরা তিনে চলে এলাম, তখন নিজেকে নিজেই বলি, আজ যা হওয়ার হবে। এই জায়গা থেকে পিছিয়ে গেলে চলবে না। পদক চাই। শেষের দিকে ২.১০ মিটার উচ্চতায় লাফিয়ে উঠেও ঠিক ভাবে নামতে পারিনি। তা হলে আজ সোনাটাই নিয়ে ফিরতাম!
গত বছর করোনার জন্য অনুশীলন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। খুব মুষড়ে পড়েছিলাম। তাও মনের জোরে কোচকে গোবিন্দগড় গ্রামে এনে বাড়ির সামনে মাটি খুঁড়ে বিশেষ জায়গা তৈরি করে অনুশীলন চালিয়েছিলাম। তিন-চার মাস এ ভাবে চলার পরেই কোচের আবেদনে সাই সাড়া দিয়ে আমাকে ফের দিল্লী জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে অনুশীলনের সুযোগ করে দেয়। আর এ বছরে করোনার দ্বিতীয় পর্বের সংক্রমণে তো আমি নিজেই আক্রান্ত হয়ে বেশ কয়েক দিন অনুশীলন করতে পারিনি। কিন্তু মনের জোরেই এই সব প্রতিকূলতাকে জয় করে আজ সাফল্য পেয়েছি।
আমার জন্ম থেকেই বাঁ পা ডান পায়ের চেয়ে ছোট। তা সত্ত্বেও আমি ছোট থেকেই খেলতে ভালবাসি। স্কুলে চুটিয়ে ভলিবল খেলতাম। ওটা আমার প্রিয় খেলা ছিল এক সময়ে। আন্তঃ জেলা স্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতাতেই এক বার হাই জাম্পে নাম দিয়ে প্রথম তিনে না থাকায় মুখ ভার করেছিলাম। তখন একজন শিক্ষক বলেন, আমি প্যারা-অ্যাথলেটিক্সে গেলে ভাল করব। তাঁর কথা শুনে পরের দিনই গুগল করে জানতে পারি, এ রকম খেলা রয়েছে। তার পরেই আমি প্যারা-হাই জাম্পেই মন দিই। আমাদের স্কুলের অধ্যক্ষা দীপ্তি শর্মা, সে সময়ে আমাকে খুব উৎসাহ ও সহযোগিতা করেছেন।