‘কার্তিক পূর্ণিমার রাত’ বৈষ্ণবদের বড় প্রিয়। এ রাতেই তাঁদের প্রাণের উৎসব ‘রাস’ উদযাপিত হয়। তাই ভজনকুটিরের নিকোনো উঠোনে দেওয়া হয় ‘আলপনা’, উঠোনের পূর্ব কোণে টাঙানো হয় ছোট্ট একখানি ‘চাঁদোয়া’। তার নীচেই রাখা হয় ‘রাধাকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহ’। বড় মায়াময় সে মূর্তি। উঠোনের এক কোণে থাকে মঞ্জরীভরা তুলসী গাছের ঝাড়। কার্তিকের জ্যোৎস্নার দুধ-সাদা আলোয় আটপৌরে ভজনপ্রেমের চেনা পরিবেশ কেমন যেন অপার্থিব সুন্দর হয়ে ওঠে। কাঠের ছোট সিংহাসনে বসানো যুগলবিগ্রহের চার পাশে গোল করে সাজানো হয় ‘অষ্টসখীর মূর্তি’। তাঁদের পরনে থাকে জমকালো পোশাক। সামনে ফরাস পাতা থাকে। তাতে সাজানো হয় ‘মৃদঙ্গ’, ‘মন্দিরা’, ‘হারমোনিয়াম’, ‘করতাল’ এবং ‘আড়বাঁশি’। ‘সুগন্ধী ধূপ’, ‘আতর’ এবং ‘ফুলের গন্ধে’ ম ম করে চারপাশ। ‘সন্ধ্যারতি’ শেষ হলে কপাল থেকে নাক পর্যন্ত তিলকপরা এক মাঝবয়েসি বৈষ্ণবভক্ত বিগ্রহের দিকে হাতজোড় করে প্রণাম করে হাতে তুলে নেন ‘আড়বাঁশি’টি। গভীর শান্ত চোখ দুটি বুজে আলতো ফুঁয়ে ধরেন আলাপ। ‘রাগ কেদার’। বাঁশির সুরে ভজনকুটিরের উঠোনে ক্রমশ বুঁদ হয়ে ওঠে ‘রাস পূর্ণিমার রাত’। ক্রমশঃ ভিড় বাড়ে আসরে। একটা সময়ে বাঁশির সঙ্গে ‘নিখুঁত কণ্ঠ’ মিলিয়ে বৈষ্ণবী গেয়ে ওঠেন ‘মহাজনপদ’ –
‘‘বলয়া নূপুর মণি বাজয়ে কিঙ্কিণী
রাস রসে রতিরণে কী মধুর শুনি’’
‘জোড়া মৃদঙ্গ’ বেজে ওঠে ‘ধ্রুব তালে’। নবদ্বীপের বৈষ্ণব ভজনকুটির বা আখড়াগুলিতে এ ভাবেই পালিত হয় রাস।
বলা হয় ‘রস’ থেকেই রাস। ‘রস’ অর্থে ‘সার’, ‘নির্যাস’, ‘আনন্দ’, ‘হ্লাদ’, ‘অমৃত’ ও ‘ব্রহ্ম’ বোঝায়। ‘তৈত্তিরীয় উপনিষদে’ (২/৭) ‘রস’ সম্পর্কে বলা হয়েছে “রসো বৈ সঃ।’’ অর্থাৎ, “ব্রহ্ম রস ছাড়া আর কিছুই নন।’’ ‘বৈষ্ণব দর্শনে’ এই ‘রস’ বলতে ‘মধুর রস’কেই বোঝানো হয়েছে। আর ‘পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ’ হলেন ‘মধুর রসের ঘনীভূত আধার’। তাঁকে ঘিরেই ‘রাস’। ‘রাস’ কথাটির ‘আভিধানিক অর্থ’ হল ‘নারী-পুরুষের হাত ধরাধরি করে মণ্ডলাকারে নৃত্য’। যাকে বলা হয় ‘হল্লীবক নৃত্য’। কিন্তু বৈষ্ণবদের কাছে ‘রাস’ কথাটির ভিন্ন অর্থ বহন করে। শ্রীকৃষ্ণ ‘শারদপূর্ণিমার রাতে’ বৃন্দাবনের যমুনাতটে ‘গোপিনী’দের আহ্বান করেন এবং তাঁদের ‘অহং বর্জিত বিশ্বাসভক্তি ভাবে’ তুষ্ট হয়ে সঙ্গদান করেন। তাই বৈষ্ণবদের কাছে ‘রাস’ আসলে ‘ভক্ত এবং ভগবানের মিলন উৎসব’। এক অসামান্য ‘আনন্দ উৎসব’। নানানজন নানানভাবে রাসলীলার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ‘বৈষ্ণব কবিরা’ নিজেদের মতো করে ‘রাধা ও কৃষ্ণ’কে উপস্থাপন করেছেন তাঁদের রচনায়। তাঁরা বলছেন, ‘পরমাত্মার সাথে আত্মার মহামিলনই রাস’। পরমাত্মা কে? যিনি ‘ইশ্বর’ তিনিই ‘পরমাত্মা’। তিনি শ্রীকৃষ্ণ। আত্মা কে? শ্রীমতি ‘রাধা’ ও ‘গোপীরা’, যাঁরা ‘পূণ্যবলে’ কৃষ্ণের সান্নিধ্যলাভ করেছে। ‘ভাগবৎ পুরাণে’ অবশ্য শ্রীমতি রাধার কথা নেই। সেখানে বলা হচ্ছে, বৃন্দাবনের রাসমন্ডলে সেখানকার গোপীদের সান্নিধ্য দিতে কৃষ্ণ রাসলীলা করেন। তাহলে যাঁদের সাথে এই লীলা হয়েছিল, তাদের অনেকেই লৌকিক দৃষ্টিতে অন্যের বিবাহিতা স্ত্রী, অর্থ্যাৎ বিষয়টা পরকীয়া। কিন্তু ‘ভাগবৎকার’ রাসলীলা বর্ণনার শুরুতেই বলছেন, নাহ এটা ‘আপ্রাকৃত’, মানে ‘অলৌকিক লীলা’। ভগবান ‘নিদ্রার দেবী যোগমায়া’কে আশ্রয় করে এই লীলা করেন যেখানে ‘গোপীরা’ উপস্থিত থাকেন আত্মারূপে। ‘হর্ষচরিতের টীকাকার’ ‘শঙ্করের মতে’, ‘রাস হল এক ধরণের বৃত্তাকার নাচ যা আট, ষোলো বা বত্ৰিশ জনে সম্মিলিতভাবে উপস্থাপনা করা যায়’। ‘পদ্মপুরাণে’ (৫২/১০৩-১০৫) ‘শারদরাস’ ও ‘বাসন্তীরাসের’ উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণে’ (ব্রহ্মখণ্ড, পঞ্চম অধ্যায়) ‘বাসন্তীরাস’ এবং ‘শ্ৰীমদ্ভাগবত’ ও ‘বিষ্ণুপুরাণে’ (৫/১৩/১৪-৬১) শুধুমাত্র ‘শারদরাসের বর্ণনা’ আছে। ‘হরিবংশে’ ও ‘ভাসের বালচরিতে’ উল্লেখ আছে যে, কৃষ্ণ গোপিনীদের সঙ্গে ‘হল্লীশনৃত্য’ করেছিলেন। ‘হল্লীশনৃত্য’ যদি ‘তালযুক্ত ও বিবিধ গতিভেদে বৈচিত্র্যপূর্ণ’ হয় তবে তাকে ‘রাস’ নামে অভিহিত করা হয়। ‘বিষ্ণুপুরাণের’ মতে, কৃষ্ণ রাস অনুষ্ঠান করেছিলেন গোপরমণীদের সঙ্গে। ‘শ্ৰীধর স্বামী’ বলেছেন, ‘বহু নৰ্তকীযুক্ত নৃত্য বিশেষের নাম রাস’ – “রাসো নাম বহু নৰ্ত্তকীযুক্তে নৃত্যবিশেষঃ।” ‘শ্ৰীমদ্ভাগবতের অন্যতম টিকাকার বিশ্বনাথ চক্রবর্তী’ বলেছেন, “নৃত্যগীতচুম্বনালিঙ্গনদীনাং রসানাং সমূহো রাসস্তন্ময়ী যা ক্রীড়া বা রাসক্রীড়া”। ‘শ্ৰীমদ্ভাগবতের’ মতে, কৃষ্ণ ‘যোগমায়া’কে সমীপে গ্রহণ করেই রাস অনুষ্ঠান করেছিলেন। ‘বস্ত্রহরণের দিন’ গোপিনীদের কাছে কৃষ্ণ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, পরবর্তী পূর্ণিমা তিথিতে তিনি ‘রাসলীলা’ করবেন –
‘‘যখন করেন হরি বস্ত্ৰহরণ।
গোপীদের কাছে তিনি করিলেন পণ।।
আগামী পূর্ণিমাকালে তাঁহাদের সনে।
করবেন রাসলীলা পুণ্য বৃন্দাবনে।।’’
‘উত্তরপ্রদেশের মথুরা ও বৃন্দাবনে’, ‘পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া’সহ অন্যান্য জায়গায়, ‘উড়িষ্যা’, ‘আসাম’ ও ‘মণিপুরে’ রাসযাত্রার উৎসব বিশেষভাবে উদযাপিত হয়। এই উৎসবের অংশ হিসেবে ‘গোপিনীবৃন্দ সহযোগে রাধা-কৃষ্ণের আরাধনা’ এবং অঞ্চলভেদে ‘কথথক’, ‘ভরতনাট্যম’, ‘ওড়িশি’, ‘মণিপুরি’ প্রভৃতি ঘরানার ‘শাস্ত্রীয় ও বিভিন্ন লোকায়ত নৃত্যসুষমায় রাসনৃত্য’ বিশেষ মর্যাদার অধিকারী।
এগুলি ‘পুরাণের কথা’। ‘রাসের ব্যাখ্যা’ পেতে চাইলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ‘বাংলার ভাবান্দোলনের সময়ে’ যার সূত্রপাত হয় মূলত দ্বাদশ শতকের কবি ‘জয়দেব’ ও তৎপরবর্তী ‘চন্ডীদাস’ (১৪শ শতক) ও ‘বিদ্যাপতি’র (আনু. ১৩৭৪-১৪৬০) ‘বৈষ্ণবপদ’ রচনার মধ্য দিয়ে। বৈষ্ণবরা কৃষ্ণকে দেখেছেন ‘স্রষ্টা’ আর রাধাকে দেখেছেন ‘সৃষ্টির প্রতিনিধি’ হিসাবে। স্রষ্টার কাছে পৌঁছানোর সহজতম পথ হল প্রেম৷ দীর্ঘকাল ধরে ‘সুফি সাধকরা’ বাংলায় ‘ইশক’ এর মাধ্যমে ‘খোদায় লীন হয়ে যাওয়ার ধারনা’টি প্রচার করছিলেন। ‘সুফি-সাধকরা’ বলতেন, ‘‘হক্ এর সঙ্গে জীবের মিলনের একটিই পথ, তা হল প্রেম বা ইশক’’৷ ‘নদীয়ার শ্রীচৈতন্যের রাধাভিত্তিক ভাবান্দোলনের সাথে’ এই দর্শনের গভীর যোগসূত্র পাওয়া যায়৷ চৈতন্যদেব রাধার মতো ‘পরমাত্মায় লীন হয়ে যাওয়ার কথা’ বলেছেন৷ মুলত শ্রীচৈতন্য ‘জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনের ধারনা’টি লাভ করেছিলেন বাংলার ‘সুফি-সাধকদের’ কাছ থেকেই।
মণিপুরিদের রাসলীলা’টি মুলত একটি ‘নাট্য আঙ্গিক’। বলা ভাল ‘ক্লাসিক্যাল নাট্য আঙ্গিক’। এমনিতে মণিপুরের ‘সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য’ সুপ্রাচীন। ধারণা করা হয় এদের ঐতিহ্যগত লোকনৃত্যই কালক্রমে ধ্রুপদী নৃত্যধারায় পরিণত হয়েছে। মণিপুরিদের রাস ও রাসের থিম ভারতবর্ষে প্রচলিত অন্যান্য রাসের চেয়ে আলাদা। মণিপুরি পুরাণ লেখকরা দাবি করেছেন, মিথলজি অনুসারে মণিপুর রাজ্যই হলো সেই স্থান যেখানে রাধাকৃষ্ণের অনুসরনে শিব পার্বতী রাসলীলা করেন। পুরাণের ভাষ্য অনুযায়ী মণিপুরের কৌব্রু পর্বতকে রাসলীলার উপযুক্ত করে তোলার জন্য শিব, সূর্য, চন্দ্র এবং পাঁচটি গ্রহকে আহ্বান করেছিলেন। মণিপুরি ভাষায় এদের নাম হলো নোঙমাইজিঙ (সূর্য), নিঙ্থোউকাপা (চন্দ্র), লেইপাক্পোকপা (মঙ্গল), য়ুমসাঙকেইসা (বুধ), সাগোলসেন (বৃহস্পতি), ইরাই (শুক্র) এবং থাঙজা (শনি)। সাতদিন সাতরাত শিব-পার্বতীর রাসলীলা অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানের সঙ্গীত সহযোগী ছিলেন গন্ধর্ব এবং অন্যান্য দেবতারা। রাত্রিবেলার অনুষ্ঠানের জন্য নাগরাজ অনন্তদেব তাঁর মাথার মণি দান করেন। নাগদেবের মণির নামানুসারে সেই স্থানের নাম হয় মণিপুর। পুরাণকাররা তাঁদের মতো করে ইতিহাস রচনা করেছেন। বস্তুতঃ এই পুরাণগুলি লেখা হয়েছে দ্বাদশ শতকের দিকে যখন শৈবধর্মের প্রকট প্রভাব ছিল। ১৭০৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পামহৈবা মণিপুরের রাজত্ব লাভের পর এই অঞ্চলে শৈবমতাদর্শের লোকেরা একরকম কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এই সময় রাজা পামহৈবা ভিন্নমতের গ্রন্থাদি ও নিদর্শন ধ্বংস করে দেন। এর ফলে মণিপুরের ইতিহাসও ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু মণিপুরের বৈষ্ণবরাও শিবকে শ্রদ্ধা এবং পূজা করতো ফলে শিব-পার্বতীর লীলাভিত্তিক গীত ও নৃত্য থেকে যায়। তারপর ইতিহাসের এক সময়ে বাংলার ভাবান্দোলন যখন মণিপুর গিয়ে পৌঁছে তখন বৈষ্ণব পদকর্তাদের রচনাবলী মণিপুরে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এগুলির উপর ভিত্তি করেই রচিত হয় মণিপুরি রাসলীলার আঙ্গিক। ভারতবর্ষের শাস্ত্রীয় নৃত্যকলার সাথে মণিপুরের লোকনৃত্যের ঐক্যতানে গড়ে উঠে এই নব্য ক্লাসিক্যাল শিল্পআঙ্গিক। রাধাকৃষ্ণের দর্শন গিয়েছিল বঙ্গ থেকেই। মণিপুরি রাসের গানগুলিও বাংলা ও ব্রজভাষায়, অধিকাংশই বাঙালি বৈষ্ণব কবি ও পদকর্তাদের লেখা।
তাহলে দেখা যাচ্ছে রাসলীলা যেটি ছিল দ্বাপর যুগের ঘটনা এবং যার সংঘটন স্থান ছিল শ্রীব্রজধাম, সেটাই এই যুগে এসে হয়েছে পূণ্যতিথি রাসপূর্ণিমা। ভারতবর্ষের নানান স্থানের কৃষ্ণভক্ত বৈষ্ণবরা নানানভাবে রাস উদযাপন করে থাকেন। শাক্তরা পূর্ণিমার এই দিনে দেবদেবীদের নানান মূর্তি বানিয়ে পুজা দিত। নবদ্বীপের রাস উৎসবে পটুয়াদের দিয়ে বড় বড় পট আঁকিয়ে মঠে-মন্দিরে প্রদর্শন করা হত। তাই রাসপূর্ণিমার আরেক নাম ‘পট পূর্ণিমা’। আর ওপরে গরুর গাড়ির চাকার থেকেও বড় বড় কাঠের চাকা তৈরি করে তার মাঝখানে রাধাকৃষ্ণকে বসিয়ে চারপাশে অষ্টসখীর মূর্তি বসানো হত। আর ধীরে ধীরে সেই চাকার সাথে অষ্টসখীদের ঘোরানো হত। এই ছিল রাস। এখনও অনেক অঞ্চলে তাই আছে।
ভারতবর্ষে নাট্যাভিনয় ও নৃত্যগীতনির্ভর রাস উৎসবের প্রবর্তন করেন মণিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্র সিংহ (১৭৪৮-১৭৯৯)। ভাগ্যচন্দ্র সিংহ রাসনৃত্যকে নাট্যাঙ্গিকে সাজান। তাঁর উদ্যোগে মণিপুর রাজ্যে প্রথম রাসলীলা মঞ্চস্থ হয় ১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দে। সেই রাসে তাঁর কন্যা রাজকন্যা বিম্ববতী রাধার ভূমিকায় অভিনয় করেন, তিনি নিজে মৃদঙ্গবাদকের দ্বায়িত্ব পালন করেন। জনশ্রুতি আছে, ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্নাদ্রিষ্ট হয়ে রাসলীলা করার তাগিদ পান। রাসের জাঁকজমকপূর্ণ ও শৈল্পিক কারুকার্যখচিত পোষাকগুলোও তিনি স্বপ্নে পেয়েছিলেন বলে মণিপুরি লেখকদের বয়ান থেকে জানা যায়। বিষয়টার এরকম ব্যাখ্যা হতে পারে যে, ভাগ্যচন্দ্র একজন বড় মাপের চিন্তাবিদ, দার্শনিক এবং শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী রাজা ছিলেন। রাসনৃত্যকে নাট্যাঙ্গিকে রূপ দিতে তিনি অহর্নিশ পরিশ্রম করেছেন। পঠনপাঠন ধ্যান করতে করতে তিনি মন্দিরেই ঘুমিয়ে পড়তেন। রাসের নাচ, গান, সুর, তাল ও মুদ্রাগুলোকে তিনি একটি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন যার নাম ‘গোবিন্দ সঙ্গীত লীলাবিলাস’। রাজা ভাগ্যচন্দ্রের পৌত্র চন্দ্রকীর্তি সিংহাসনে বসে ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর সময়ে রাসনৃত্য আরও সমৃদ্ধতর হয়ে উঠে। মণিপুরীদের রাসলীলার উৎসবের পোশাক-পরিচ্ছদে, নৃত্যে-গীতে এবং মঞ্চ-অলঙ্করণে যে রাজকীয় গাম্ভীর্য দেখা যায় তাতে অনেক সময় একে রাজদরবারের পরিবেশনা বলেই ভ্রম হয়। অবশ্য রাসের জন্ম হয়েছে রাজদরবারে এই সত্যটি মেনে নিলে এটা নিয়ে কিছু বলার থাকে না। রাসের কষ্টিউমটির নাম ‘পল্লই’। এটি কমপক্ষে ১০টি ভাগে বিভক্ত। যেমন মাথার উপরিভাগে থাকে ‘কোকতোম্বি’। মুখের ওপর পাতলা স্বচ্ছ উড়নাটির নাম ‘মেইখুম্বী’। গায়ে থাকে সোনালি ও রূপালি চুমকির কারুকাজের ঘন সবুজ ভেলভেটের ব্লাউজ যার নাম ফুরিৎ। কোমর পর্যন্ত বক্ষবন্ধরী যার নাম থাব্রেৎ। পল্লইয়ের মুল অংশের নাম ‘কুমিন’। অজস্র চুমকি ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আয়নার দ্বারা এই অংশটি কারুকাজ করা থাকে, যা সামান্য আলোতেও ঝলমল করে ওঠে। আছে জরির কারুকাজ করা পেশোয়ান, খোল, খাঙ্গই। সাথে মণিপুরি স্বর্নালঙ্কার তো আছেই। এই রাজসিক বিষয়টাকে অন্তর থেকে গ্রহণ করেছে সাধারণ মণিপুরি জনগণ। ধর্ম-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এমন ঘটনা খুব কমই আছে যেখানে রাজদরবারের বস্তু সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফুর্তভাবে গ্রহণ করে নিয়েছে। কিন্তু মণিপুরীদের রাসলীলার ক্ষেত্রে এমন ব্যপার ঘটেছে। রাসলীলা এখন আর রাজার সংস্কৃতি হয়ে নেই, তা হয়ে গেছে সাধারণের সংস্কৃতি। এই কারণে রাসের ঐ ভারী ‘পল্লই’টি মণিপুরি বিবাহের অত্যবশ্যকীয় অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। বিবাহের রাতে মণিপুরি মৈতৈ ও মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া কনেকে কারুকার্যখচিত এই পোশাকটি পড়তে হয়। আরো আশ্চর্যজনক যে মণিপুরি পাঙন যারা ধর্মে মুসলিম, তারাও বিবাহের দিনে রাসনৃত্যের এই পোশাকটি পরিধান করে।
কেন সাধারন একটি নাচগানের অনুষ্ঠান, একটি শিল্পআঙ্গিক একটা গোটা জনগোষ্ঠির কৃত্যে পরিণত হলো, তার পেছনে গুঢ় রাজনৈতিক সমাজবৈজ্ঞানিক কার্যকারণ লুকিয়ে আছে। মণিপুরি রাসের শুরুতে বলা হয়, ‘‘রাস আরম্ভিলা ভাগ্যচন্দ্র মনোহর’’, এটা মুলত মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র যিনি রাস প্রবর্তন করেছিলেন তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে করা হয়। এরপর থাকে বৃন্দা নর্তন ও কৃষ্ণ নর্তন৷ ভাগবত পুরাণের রাস-পঞ্চ-অধ্যায় অবলম্বনে কৃষ্ণ অভিসার, রাধা-গোপী অভিসার, মণ্ডলী সজ্জা, গোপীদের রাগালাপ, কৃষ্ণ-রাধা নর্তন, গোপিনীদের নর্তন, ভঙ্গি পারেং, রাধা কৃষ্ণের নৃত্যে কৃষ্ণের পরাজয় ও রাধার বাঁশি লাভ, কৃষ্ণের অন্তর্ধান, রাধা বিরহ, কৃষ্ণের পুণরাগমন ও যুগলমিলন এরকম কয়েকটি পর্বে থাকে মণিপুরি মহারাসে৷ টানা সাত থেকে আট ঘন্টা এই নৃত্যগীত চলে একটু সময়ও না থেমে৷ এখানে রাসের প্রণিক্ষক বা গুরু ছাড়াও সূত্রধারী ও মৃদঙ্গবাদকেরা বড় ভূমিকা রাখেন৷ রাসের ধারাবাহিকতা, এর সাথে সংশ্লিষ্ট কৃত্য এবং ভক্তসাধারনের ভাবভঙ্গি গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাষ মণিপুরি রাসলীলা কেবল একটি নৃত্যের অনুষ্ঠান বা নাটক নয়, এটা অন্য কিছু। রাস দেখতে দেখতে উপস্থিত ভক্ত ও দর্শকেরা রাধা, কৃষ্ণ ও গোপীদের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে, অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়ে, রাস দেখতে আসা স্বজনরা একে অন্যেকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করে। রাসের কয়েকটি অংশ বিশেষভাবে আবেগময় যেমন বিরহপর্বে কৃষ্ণের অন্তর্ধানের পর রাধার মূর্চ্ছা যাওয়া, গোপীদের বিলাপ ও পদচিহ্ন অনুসরন করে কৃষ্ণকে খুঁজতে যাওয়ার অংশটুকু বেশ মর্মস্পর্শী। মণিপুরি রাসের মুলভাব ভাগবৎ পুরাণ ও বৈষ্ণব কবিদের কাব্য থেকে নেওয়া হলেও এর কেন্দ্রে থাকেন বৃন্দা নামের এক চরিত্র। পুরাণ পাঠে বুঝা যায় বৃন্দা সম্পুর্ণ লোকমানসজাত এক চরিত্র৷ বৃন্দা রাধার একজন দূতী কিন্তু রাস শুরু হয় বৃন্দা নর্তন দিয়েই। বৃন্দা মণিপুরি রাসের ‘চিংপী’ বা সঞ্চালিকা। রাধাকৃষ্ণকে ছাপিয়ে তিনিই মণিপুরি রাসলীলার প্রধান চরিত্র হয়ে উঠেন। মণিপুরী রাসলীলা মুলত বৃন্দাদেবীরই রাসলীলা। তাকে অনুসরন করেই অন্য গোপিনীরা নৃত্যগীত করেন। নৃত্যগুরুর কড়া নির্দেশ থাকে ‘বৃন্দা’ ভুল করলে সেই ভুল ভঙ্গিতেই নাচতে হবে অন্যদের। ‘বৃন্দা’ শব্দটি ‘বৃন্দাবন’ থেকে এসেছে নাকি ‘বৃন্দাবন’ নামটিই ‘বৃন্দা’ থেকে এল বলা মুস্কিল। ইম্পেরিয়েল গেজেটিয়ার অফ ইন্ডিয়া (১৯০৯) অবশ্য বলছে সংস্কৃত ভাষায় ‘বৃন্দাবন’ কথাটি এসেছে ‘বৃন্দা’ (তুলসী) ও ‘বন’ (অরণ্য) শব্দদুটি থেকে। বৈষ্ণবরা বলেন বৃন্দাই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বর্ণিত তুলসীদেবী। তুলসী সব ধরনের পূজার্চনাতেই লাগে, তাহলে কি তুলসীবৃক্ষই যমুনাপাড়ের বৃন্দা? বিষ্ণুর পরম ভক্ত বলে বৃন্দার আরেক নাম বিষ্ণুপ্রিয়া৷ যাহোক মণিপুরি রাসের বৃন্দাকে দেখে মনে হয় খুব লৌকিক, যেন পাশের বাড়ির ভজন গাওয়া মেয়েটি যে কেবল কৃষ্ণানুরাগীই নয়, একই সাথে রাধাঅন্তপ্রাণ। যে কৃষ্ণের জন্য কুঞ্জ সাজায়, যে রাধার নিত্যসহচরী হয়ে পাশে পাশে থাকে। যে আকুল কন্ঠে সে গায়,
‘‘আমি কৃষ্ণের প্রেমে কাঙ্গালিনী
বৃন্দাবনে বৃন্দা দুর্ভাগিনী
আমি যুগলচরণ সেবা করিব
যুগলরূপ নেহারিব
জীবন সফল করিব …।’’
তার মানে দুর্ভাগিনী বৃন্দা নিজে কৃষ্ণকে পেতে চান না, যুগলচরণ পেলেই খুশি। এই যে পরমসত্তার প্রতি সমর্পন, এই কি তাহলে ভক্তির মূল কথা?
নিত্যরাস, বসন্তরাস, মহারাস, দিবারাস মণিপুরি রাসের এরকম অনেকগুলো ফর্মের মধ্যে মহারাসের স্থান সর্ব্বোচ্চ যেটি হয় কার্তিক পূর্ণিমায়। যেকেউ চাইলেই মহারাস আয়োজনের সৌভাগ্য অর্জন করে না, এটি পালা করে ন্যস্ত হয় একেকটি পরিবারের কাঁধে। রাস নৃত্যগীতের সাধারন কোন আয়োজন নয়, এটা হয়ে গেছে কৃত্য ও কঠিন সাধনার ব্রত। রাসের এক মাস আগ থেকে এই সাধনা শুরু হয়। মাসব্যাপী চলে রাসের প্রস্তুতি। বিশেষ দিনে নাচের প্রশিক্ষক বা অজাকে আনুষ্ঠানিক নিমন্ত্রন জানানো হয়। তিনি রাজী থাকলে শুভ কোন তিথিতে শুরু হয় নাচের চর্চা, নৃত্যকলা ও শিল্পরস উত্তীর্ন হবার কঠিন শর্ত নিয়ে। রাসের মূদ্রাগুলো শাস্ত্রীয়, নৃত্যভঙ্গি ধ্রুপদী। সঙ্গীতগুলো লেখা বৈষ্ণব পদাবলীর ভাষায়, কাব্যমানসম্পন্ন। সেগুলি শ্রুতিমধুর কণ্ঠে পরিবেশনের জন্য দুর দুরান্ত থেকে দক্ষ সূত্রধারী নিমন্ত্রণ করে আনা হয়। আনা হয় মৃদঙ্গবাদক। রাসের শিল্পীরা যে পোশাক পরবে তাও পবিত্র পোশাক, দেবতার কাছে রেখে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে তার পূজা দিতে হয়। রাসের আগের দিন ‘বার্তন চালানি’ বা গুরুকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাসে উপস্থিত থাকার নিমন্ত্রন। রাসের মঞ্চটি হতে হয় বাঁশ ও কাগজের তৈরী, তারও নিজস্ব ডিজাইন আছে। মঞ্চ বসাতে হয় মাঝখানে, দর্শকরা যাতে গোল হয়ে বসে দেখতে পারে। রাস শুরুর আগে আগে হয় নটপালা কীর্ত্তন, সেখানে রাসের সাফল্যের জন্য মঙ্গলকামনা করা হয়। এ এক বিশাল কান্ড। কেবল শিল্পের মাপকাঠি দিয়ে মেপে একটি জনপদের এই বিশাল কাণ্ডকে মাপা সম্ভব না । এই প্রযোজনাটির আড়ালে থাকে একটা গোটা জনগোষ্ঠির অস্তিত্ব ও পরিচয় নির্মাণের নিরবিচ্ছিন্ন উদ্যোগ। একটা জাতিসত্তা যারা এককালে নিজেদের ভূখন্ড হারিয়ে এদেশে এসে বাস করছে, সংখ্যাগুরুর চাপে নিজেদের ভাষা সংস্কৃতি ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে যে আপ্রাণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, ‘রাসলীলা’ সে লড়াইয়ের অন্যতম অনুষঙ্গ। রাসনৃত্যে সাধারণত রাধা ও কৃষ্ণের ভূমিকা দেয়া হয় শিশুদের, যাদের বয়স পাঁচের কম। মনিপুরীদের বিশ্বাস, এই বয়সের পর শিশুদের দৈবশক্তি লোপ পেয়ে যায়। তবে প্রকৃত নাটনৃত্য ও গীত পরিবেশন করে তরুণীরা, যারা রাধার সহচরী হিসাবে মঞ্চে আসে। রাসনৃত্যের কেন্দ্রবিন্দু ভঙ্গি পরেং অর্থাৎ নৃত্যমালিকা। রাসলীলা শুরু হয় নট সঙ্কীর্তন দিয়ে। গোবিন্দজীর মন্দিরের বিশাল মণ্ডপে আরাধ্য দেবতার মূর্তির সামনে শিল্পীরা মৃদঙ্গ ও করতাল সহযোগে সঙ্কীর্তন করে। বিশেষ পোশাকে সাজেন শিল্পীরা। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য বন্দনা দিয়ে শুরু হয়ে দীর্ঘ প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ব্যাপী রাসসঙ্গীত অনুষ্ঠিত হয়।
বৈষ্ণবদর্শনে রাসের যে ব্যাখ্যাই থাকুক না কেন, বৈষ্ণব আখড়ায় যে ভাবেই রাস পালিত হোক না কেন, শহর নবদ্বীপ, চৈতন্যজন্মভূমি নবদ্বীপে রাসের চেহারা ঠিক এর ‘বিপরীত’। পূর্ণিমার ভরা রাতে, বিশুদ্ধ তন্ত্রমতে শতাধিক শক্তিমূর্তির সাড়ম্বর পুজো, সঙ্গে আদ্যন্ত তামসিকতায় ভরা এক দামাল উৎসবের উদযাপন – সংক্ষেপে এটই হল নবদ্বীপের রাসের সংজ্ঞা। পূর্ণিমার রাতে দেড়শোর বেশি বিরাট বিরাট শক্তিমূর্তির পুজোর কারণে নবদ্বীপের রাসকে অনেকে ‘শাক্ত রাস’ বলেও অভিহিত করেন।
নবদ্বীপের রাসের উৎস ঠিক কবে, এর উত্তরে স্থানীয় ইতিহাসের গবেষক ও নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব জানান, নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালে (১৭২৮-৮২) রাসের বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়েছিল। রাজা হওয়ার পর থেকে ১৭৫০ পর্যন্ত কৃষ্ণচন্দ্র নানা সমস্যায় জর্জরিত থাকতেন। তার পর থেকে তিনি মঠমন্দির স্থাপন, মেলা উৎসবের সূচনা বা বহু জনকল্যাণমূলক কাজে মনোনিবেশন করেন। ১৭৫৩-৫৬-র মধ্যে তিনি জগদ্ধাত্রীপুজো, বারোদোলের সূচনা করেন। মনে করা হয় ওই একই সময়ে তিনি নবদ্বীপে বৈষ্ণবদের রাস উৎসবের খোলনলচে বদলে দেন। শান্তিরঞ্জনবাবু আরও বলেন, কৃষ্ণচন্দ্র নিজে ছিলেন শাক্ত। নদিয়া, অগ্রদ্বীপ, কুশদ্বীপ এবং উলা এই চারটি সমাজের সমাজপতি। তার রাজত্বে শুদ্ধাচারে শক্তিসাধনা হোক এটা তিনি মনেপ্রাণে চাইতেন। পাশাপাশি তিনি পছন্দ করতেন না চৈতন্যদেবকে মঠে-মন্দিরে পুজো করা হোক। তিনি বৈষ্ণববিদ্বেষী ছিলেন না, কিন্তু চৈতন্যদেবকে যাঁরা অবতার বলে পুজো করতেন তাঁদের তিনি ঘোর অপছন্দ করতেন। চৈতন্যদেবের অনুগামীরা বেদবিধি ও ব্রাহ্মণ্যস্মৃতি মানতেন, এটাও কৃষ্ণচন্দ্রের আপত্তির কারণ ছিল। তিনি রাসপূর্ণিমার রাতে নবদ্বীপে শক্তিমূর্তি পুজোয় উৎসাহ দেওয়া শুরু করেন। রাজানুগ্রহে অচিরেই সেই উৎসব ছাপিয়ে যায় বৈষ্ণবীয় রাসকে।
কৃষ্ণচন্দ্রের আগে নবদ্বীপের বৈষ্ণবীয় রাসের ছবিটা ছিল অন্য রকম। ১৫৩৩-এ চৈতন্যদেবের তিরোধানের একশো বছরের মধ্যে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে বহু গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়। নানা সম্প্রদায়, গোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ শেষ পর্যন্ত বিদ্বেষে পরিণত হয়। সে সময়ে সাধারণ মানুষকে বেশি করে আকৃষ্ট করার জন্য বৈষ্ণব মঠ-মন্দির-আখড়ায় নানা অনুষ্ঠান জাঁকজমক করে পালন করা শুরু হয়। তার মধ্যে রাস উৎসব অন্যতম। সে সময়ে রাসলীলার বিষয়ে পটুয়াদের দিয়ে বড় বড় পট আঁকিয়ে মঠে-মন্দিরে প্রদর্শন করা হত। তাই রাসপূর্ণিমার আর এক নাম ‘পট পূর্ণিমা’। আর ওপরে গরুর গাড়ির চাকার থেকেও বড় বড় কাঠের চাকা তৈরি করে তার মাঝখানে রাধাকৃষ্ণকে বসিয়ে চারপাশে অষ্টসখীর মূর্তি বসানো হত। আর ধীরে ধীরে সেই চাকাটি ঘোরানো হত। একে বলা হত ‘চক্ররাস’।
এ সময়ে নবদ্বীপে বৈষ্ণবদের থেকে সামাজিক ভাবে প্রতিপত্তি সম্পন্ন ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতেরা। স্মৃতি এবং নব্যন্যায়ের তাবড় তাবড় পণ্ডিতের বাস তখন নবদ্বীপে। তাদের অনেক ধনী শিষ্য ছিলেন। মহালয়ার সকালে পিতৃতর্পণ সেরে এই পণ্ডিতেরা নিজ নিজ যজমানের বাড়ি চলে যেতেন দুর্গাপুজো করতে। ফিরতেন দীপান্বিতার পর। বাড়ি ফেরার পর কার্তিকী পূর্ণিমার শুভ দিনে যে যার বাড়িতে ঘট স্থাপন করে নিজ নিজ ইষ্টদেবীর পুজো করতেন। কালী, শবশিবা, মুক্তকেশী প্রভৃতি দেবীর পুজো করতেন তাঁরা। পণ্ডিতমশাইদের বাড়ির ওই সব পুজোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মহল্লায় উৎসব লেগে যেত। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র এই পুজোগুলোকেই বেছে নিয়েছিলেন রাসের চরিত্র বদলানোর জন্য।
তিনি ঘোষণা করেন, যিনি ঘটের বদলে মাটির মূর্তি গড়ে পুজো করবেন তিনি রাজানুগ্রহ পাবেন। তাঁর এই ঘোষণায় প্রথম সাড়া দিয়েছিলেন ভারতবিখ্যাত নৈয়ায়িক শঙ্করনাথ তর্কবাগীশ। ইনি কৃষ্ণচন্দ্রের সভাপণ্ডিত ছিলেন। নবদ্বীপের দেয়ারা পাড়ায় তিনিই প্রথম আলোকনাথ কালীর মূর্তি নির্মাণ করে পুজো করেন। এটাই নবদ্বীপের রাসের প্রথম প্রতিমা। সময়টা ১৭৫২ থেকে ৫৬-র মধ্যবর্তী কোনও বছর। তার পরের বছরই শিতিকণ্ঠ বাচস্পতি নির্মাণ করেন ‘শবশিবা’ মূর্তি। সেই শুরু।
শাক্ত-বৈষ্ণব বিরোধ বহু যুগের। ইতিহাস বলে, শ্রীচৈতন্যের তিরোধানের পরে শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মের মানুষদের মধ্যে অসদ্ভাব দেখা দেয়। প্রচলিত কাহিনি অনুসারে, বৈষ্ণব ধর্মের অতিরিক্ত প্রভাব এবং জনপ্রিয়তার কারণে নবদ্বীপের শাক্ত ধর্মাবলম্বীরা নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে নানা অভিযোগ জানাতে থাকেন। কিছু কাল এমনটা চলতে থাকায় নবদ্বীপের পণ্ডিতদের ডেকে রাজা তাঁদের একটা প্রস্তাব দেন।
কী সেই প্রস্তাব? কার্তিক মাসের পূর্ণিমায় বাড়িতে তাঁরা যেন নিজ নিজ ইষ্ট দেব-দেবীর পুজো করেন। উল্লেখ্য, সেই সময় নবদ্বীপের বেশির ভাগ পণ্ডিত বিভিন্ন রাজবাড়ি কিংবা অভিজাত পরিবারে দুর্গা, লক্ষ্মী, কালীপুজো করতে নবদ্বীপের বাইরে যেতেন। পুজো শেষে বাড়ি ফিরতেন তাঁরা। শাক্ত-বৈষ্ণব কাউকে না চটিয়ে কৃষ্ণচন্দ্রের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হল রাস উৎসব। যে জায়গায় কালীর পুজো হয়, তার পাশেই কৃষ্ণের পুজো যে হতে পারে সেটা প্রচলনের উদ্দেশ্যই ছিল কৃষ্ণচন্দ্রের। গবেষকদের মতে, ১৭৫২ থেকে ১৭৫৭-র মধ্যে প্রচলন হয়েছিল এই শাক্ত রাস উৎসবের।
এই রাস উৎসব নবদ্বীপের মানুষের কাছে দুর্গাপুজোর চেয়েও আকর্ষণীয়। রাসপূর্ণিমার দুপুরে এখানে কালী, দুর্গা এবং অন্যান্য শক্তি মূর্তির পুজোয় আগে শ’য়ে শ’য়ে পাঁঠা বলি দেওয়া হত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পশুবলি এখন কমেছে। তবে একেবারে বন্ধ হয়নি।
এই সব মূর্তির উচ্চতা কম করে ২০-২২ হাত। শিল্পীরা আজও বিভিন্ন মণ্ডপে গিয়েই প্রতিমা নির্মাণ করেন। এখানকার প্রথা অনুসারে লক্ষ্মীপুজোর পর দিন থেকে কাঠামো তৈরি হয়। কালীপুজোর পর দিন মূর্তির খড় বাঁধার কাজ শুরু হয়। এরই মধ্যে কাটোয়া এবং মুর্শিদাবাদের শোলা শিল্পীরা এসে প্রতিমার সাজ তৈরির কাজ শুরু করেন। রাসের প্রতিমাগুলি মণ্ডপেও বসানো থাকে বড় বড় চাকা লাগানো লোহার গাড়ির উপর। কারণ রাসের পরের দিন প্রতিমা-সহ বেরোয় রাসের শোভাযাত্রা।
এখানে বেশির ভাগ মণ্ডপ সাধারণ মানের হলেও, রাসের প্রধান আকর্ষণ, বৃহৎ আকারের সুসজ্জিত সাবেক প্রতিমা। প্রাচীন পুজোগুলির মধ্যে ‘শবশিবা’, ‘অলোকনাথ কালী’ যা ‘এলানে কালী’ নামে পরিচিত, তেঘরিপাড়ার তিনটি কালীপ্রতিমা – বড়শ্যামা, মেজশ্যামা, ছোটশ্যামা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বৃহৎ আকারের এই সব প্রতিমা শোলার সাজে সজ্জিত। এ ছাড়াও পুরনো পুজোগুলির মধ্যে ভদ্রকালী, গৌরাঙ্গিনী, বিন্ধ্যবাসিনী, বুড়োকালী, মহিষমর্দিনী উল্লেখযোগ্য। জানা যায় যে, নবদ্বীপের বড় শ্যামার পুজো ১১২৫ বঙ্গাব্দে ভৃগুরাম সিদ্ধান্তবাগীশ শুরু করেছিলেন। আজও তান্ত্রিক পদ্ধতি মেনেই পুজো হয়। আগে ৬০-৭০টি পাঁঠা বলি হলেও বর্তমানে ৩০টির মতো বলি হয়। সকাল ৯টায় পুজো শুরু হলেও তা শেষ হতে হতে রাত ৯টা বেজে যায় অতিরিক্ত ভক্ত সমাগমের জন্য।
কিছু মূর্তিতে আজও তান্ত্রিক প্রভাব স্পষ্ট। যেমন, ব্যাদরাপাড়ার শবশিবা। দেবীর নীচে মৃত বা অচৈতন্য শিব, তার উপর জীবন্ত শিব। তেমনই রাধাবাজারের রণকালীর মূর্তি। অন্য দিকে কিছু শাক্ত মূর্তিতে রয়েছে বৈষ্ণব প্রভাব। যেমন, চারিচারাপাড়ার ভদ্রকালীর মূর্তিতে মহিষমর্দিনী-সহ লক্ষ্মী-সরস্বতীর নীচে হনুমান, দু’পাশে রাম ও লক্ষ্মণকে দেখা যায়। আবার, রামসীতাপাড়ার কৃষ্ণজননীর মূর্তিতে দেখা যায় দুর্গার কোলে শিশু কৃষ্ণকে। তবে পরবর্তী কালে বহু নতুন পুজো ও মূর্তির প্রচলন হয়েছে। যেমন, অকালবোধন, উমা-মহেশ্বর, ভারতমাতা ইত্যাদি।
তবে নবদ্বীপের শাক্ত রাস কি বৈষ্ণবধর্মের উপর শাক্তধর্মের প্রভাব বিস্তারের জন্যই শুরু হয়েছিল? উত্তরটা একদা সংবাদমাধ্যমে দিয়েছিলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের উত্তরপুরুষ সৌমীশচন্দ্র রায়। তিনি বলেছিলেন, “মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র শাক্ত হলেও বৈষ্ণববিরোধী ছিলেন না। তার উল্লেখযোগ্য প্রমাণ রাজবাড়ির বারো দোলের মেলা। এ ছাড়া সারা বছর ধরে রাজবাড়িতে হয় নানা বৈষ্ণব পার্বণ। আসল কথাটা হল, সেই সময় শাক্ত-বৈষ্ণব যে বিরোধ ছিল, কৃষ্ণচন্দ্র একই জায়গায় শ্যাম ও শ্যামার পুজোর মাধ্যমে বিরোধটা মেটাতে চেয়েছিলেন। তারই ফলস্বরূপ প্রচলিত হয় নবদ্বীপের রাস।”
রাসের পরের দিনের আকর্ষণ এই সব বড় বড় প্রতিমা নিয়ে শোভাযাত্রা, যা নবদ্বীপের বিভিন্ন রাস্তা পরিক্রমা করে পোড়ামাতলায় পৌঁছয়। কিছু প্রতিমা সে দিন বিসর্জন হলেও বেশির ভাগ প্রতিমা মণ্ডপে ফিরে গিয়ে পরের দিন বিসর্জন হয়।
শোনা যায়, রাস উৎসব প্রচলনের পরে কৃষ্ণচন্দ্র প্রতি বছর রাস পূর্ণিমার পরের দিন পোড়ামাতলায় উপস্থিত থেকে প্রতিমা এবং পুজোর শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করতেন। এমনকী পুরস্কৃতও করতেন। শুধু তাই নয় শ্রেষ্ঠ ঢাকিদেরও পুরস্কৃত করা হত। আজও কিছু প্রাচীন পুজোর সংকল্প হয়ে থাকে কৃষ্ণনগর রাজ পরিবারের সদস্যদের নামে।
এখন সময়ের সঙ্গে বেড়েছে পুজোর সংখ্যা। এসেছে পরিবর্তনও। সাবেক পুজোর পাশাপাশি, গত কয়েক বছরে নবদ্বীপের রাসে প্রবেশ করেছে থিম। এ ছাড়াও কিছু পুজোয় নজর কাড়ছে প্যান্ডেলও। সব মিলিয়ে ২০১৯ সালে প্রায় ৬০০টি পুজো হয়েছিল রাসে। ২০১৯ সালের রাসে নবদ্বীপের প্রতিমার সংখ্যা ছিল ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৩৫০টি। আর এই সব প্রতিমার সুবিশাল উচ্চতাই নবদ্বীপের রাসের বিশেষত্ব। তবে শুরু থেকেই নবদ্বীপের রাস প্রতিমার উচ্চতা আজকের মতো ২৫-৩০ ফুট ছিল না। ২০১৩ সালে জনজীবনকে স্তব্ধ করে, যাবতীয় নাগরিক পরিষেবা যেমন বিদ্যুৎ, টেলিফোন, কেবল টিভির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাসের পর দিন শোভাযাত্রায় বের হয়েছিল ৩০০ প্রতিমার। বিসর্জন হয়েছিল তার পর দিন। সব মিলিয়ে রাস উৎসবকে ঘিরে জনজীবনে নেমে এসেছিল ৪৮ থেকে ৫০ ঘণ্টার অন্ধকার। উদ্যোক্তাদের সাফ কথা ছিল, উচ্চতাই নবদ্বীপের রাসের প্রতিমার ঐতিহ্য। সুতরাং কোনও আপস সম্ভব নয়। অথচ, কৃষ্ণচন্দ্রের উৎসাহে রাসে মাটির প্রতিমা করে পুজো শুরুর সময় ৪-৫ ফুটের মতো উঁচু হত প্রতিমাগুলি। পরে কিছুটা উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে ৭-৮ ফুট হয়। কিন্তু আকাশছোঁয়া প্রতিমা নির্মাণের সূচনা হয়েছিল ১৮২৮-এ। আর সে প্রতিমার সঙ্গে রাসের কোনও সম্পর্ক ছিল না। তৎকালীন নদিয়ারাজ গিরীশচন্দ্রের দেওয়ান হরগোবিন্দ প্রামাণিক চৈত্রমাসের বাসন্তী পুজোর সময় ৩৬ ফুট উঁচু ‘হটহাটিকা’ বা ‘বাসন্তীমূর্তি’ পুজো করেন। তার পরের বছর থেকে রাসে প্রতিমার উচ্চতা বাড়তে শুরু করে।
ইতিমধ্যে নবদ্বীপে একটি-দুটি করে প্রতিমার সংখ্যাও বাড়তে শুরু করেছে। প্রথম দিকে রাজানুগ্রহে বাঁশের প্রতিমা গড়ে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা পুজো শুরু করলেও অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে জাতগত বা জীবিকাগত বারোয়ারি পোড়ামাতলায় কংসবণিকদের ‘শ্যামা’, চারিচারাপাড়ায় কর্মকারদের ‘ভদ্রাকালী’, তেব্বড়িপাড়ায় ‘ভয়’ বা মৎস্যজীবীদের শ্যামা, শ্রীবাসঅঙ্গন পাড়ায় খাড়ালদের বিন্ধ্যবাসিনী, মালঞ্চপাড়ায় ‘দাস’(মুচি)-দের শ্যামাপুজোর উদ্ভব এ ভাবেই।
ঊনবিংশ শতকের তিন-এর দশক থেকে শুরু হয় জাতপাতহীন বারোয়ারি। এখনকার তিনশোটি প্রতিমার মধ্যে বেশির ভাগই কোনও বারোয়ারি অথবা ক্লাবের পরিচালনায় হয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রাচীন বারোয়ারি পুজোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আমড়াতলার মহিষমর্দিনী, যোগনাথতলার গৌরাঙ্গিনী, পোড়ামাতলার চণ্ডী ও রণকালী, রামসীতাপাড়ার বামাকালী, ফাঁসিতলার কৃষ্ণকালী, কয়েতবেলতলার গজা, ব্যানার্জিপাড়ার দেবী গোষ্ঠ, তেঘরিপাড়ার নবদুর্গা, বুড়োশিবতলার বিন্ধ্যবাসিনী, বড়ালঘাটের ভুবনেশ্বরী প্রভৃতি। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে রাসের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে শহরের বিভিন্ন বড় বড় ক্লাব। আর সঙ্গে সঙ্গে রাসের চরিত্রেও আসে আধুনিকতার ছোঁয়া।
রয়েল ক্লাব, টাউন ক্লাব, জনপ্রিয় ক্লাব, দি নিউ ক্লাব, শ্রীমন্দির ক্লাব, বড়ালঘাট স্পোর্টিং ক্লাব বা স্বাধীন ভারত ক্লাবের হাত ধরে প্রতিমা, মণ্ডপ, আলোকসজ্জা এবং বাজনায় বিপুল বৈচিত্র এসে পড়ে রাসে। সঙ্গে বাড়তে থাকে প্রতিমার রকমফেরও। শক্তিমূর্তি দিয়ে রাসের শুরু হলেও পরবর্তী কালে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, তন্ত্র, ভাগবত, মঙ্গলকাব্য প্রভৃতি থেকে বিষয় অবলম্বন করে প্রতিমা তৈরি করে পুজো শুরু হয়। এমনকী বিভিন্ন ক্যালেন্ডার ও প্রত্রিকায় প্রকাশিত কোনও ছবিকে মূর্তিরূপ দিয়ে রাসে পুজো করা হয়। এক দিনের রাস এখন অবশ্য তিন দিনের পরিপূর্ণ বিনোদনের প্যাকেজ। কলকাতার মণ্ডপ, চন্দননগরের আলো, বাছাই করা বাজনায় আজকের নবদ্বীপের রাস জমজমাট। শোভাযাত্রায় ছেলেদের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে মেয়েদের অংশগ্রহণ রাসকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।
খুব অল্প সময়ের মধ্যে কয়েকশো সুবিশাল প্রতিমা নির্মাণ করার কৌশল ও দক্ষতা স্থানীয় মৃৎশিল্পীদের এক অনন্য প্রতিষ্ঠার জায়গা দিয়েছে রাজ্যের মধ্যে। সব চেয়ে বড় কথা, কাছাকাছি ঘূর্ণি নদী থাকা সত্ত্বেও নবদ্বীপের নির্মাণ শৈলীতে তার কোনও প্রভাব পড়েনি। শুধু তাই নয়, এত বিচিত্র ধরনের প্রতিমা আর কোথাও একসঙ্গে এ ভাবে দেখা যায় না। তাই বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে রাস উৎসবে ভিড় বাড়ছে বিদেশিদেরও। সব মিলিয়ে নবদ্বীপের আজকের রাস নিঃসন্দেহে এক বিরল উৎসবে রূপান্তরিত হয়েছে। আবহমান কালের স্রোতে নবদ্বীপের রাস আজ শাক্ত-বৈষ্ণবের মিলন উৎসব।
(তথ্যসূত্র:
১- বৈষ্ণব-রস-প্রকাশ, ডঃ ক্ষুদিরাম দাস, দে’জ পাবলিশিং।
২- রাঢ়ের বৈষ্ণব তীর্থ পরিক্রমা, বঙ্কিমচন্দ্র ঘোষ, প্রভা প্রকাশনী।
৩- Vaisnavism: Its Philosophy, Theology and Religious Discipline, S.M. Srinivasa Chari, Motilal Banarsidass (২০১৭)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত