জেলের মধ্যেই সন্তর্পণে কানাইলাল-সত্যেন্দ্রনাথের হাতে পিস্তল পৌঁছে দিয়েছিলেন ‘মতিলাল রায়’। হাঁপানি রোগী ‘সত্যেন্দ্রনাথ’ ভর্তি ছিলেন জেল হাসপাতালে। পেটে অসহ্য ব্যথা করছে বলে ভর্তি হয়ে ‘কানাইলাল’ও ভর্তি হয়ে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। হাঁপানির কষ্ট ভুগতে ভুগতে সত্যেন্দ্রনাথের ‘মনে হল’ তিনিও ‘রাজসাক্ষী’ হবেন। দেখা করতে চাইলেন নরেন গোসাঁইয়ের সঙ্গে, কিছু গোপন কথা আছে। কাজ হল এতে, টোপ গিললেন নরেন। বিশ্বাস করল ব্রিটিশ সরকার।
১৯০৮ সালের ৩১শে অগাস্ট … জেল হাসপাতালের সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলেন ‘নরেন গোস্বামী’, পাহারা ছিল ঢিলেঢালা, দুই অসুস্থ বন্দি কী আর করবে!
সিঁড়ির বাঁক ঘুরলেন নরেন গোসাঁই … এক‚ দুই‚ তিন …
গর্জে উঠল দুটি পিস্তল, বুলেট ফুঁড়ে দিল ‘বিশ্বাসঘাতক’ সহযোদ্ধার পিঠ। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পালাতে গিয়ে পড়ে গেলেন নর্দমায়। ঘটনার আকস্মিকতায় বেঞ্চের নিচে লুকিয়ে পড়েছিল ব্রিটিশ পুলিশ৷
লুকোলেন না কানাই বা সত্যেন, কর্তব্য সমাধা করে স্বস্তির শ্বাস ফেলেছিলেন দু’জনে। ঘটনাচক্রে দিনটা ছিল কানাইলালের জন্মদিনের ঠিক পরের দিন।
এর অনেক আগে একদিন … মাথাটা লজ্জায় অপমানে ক্ষোভে আত্মগ্লানিতে একেবারে বুকের কাছে নেমে এসেছিল কানাইয়ের। বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। না না এ হতে পারেনা। নরেন এরকম করতেই পারেনা। সে যে তাঁর কতো প্রিয়, কত আপনার, কত কাছের। একই অঞ্চল থেকে আসায় তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠতা অনেক বেশি। শ্রীরামপুরের জমিদার গোঁসাই বাড়ির টুকটুকে ছেলেটাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলেন ভালো লেগে গিয়েছিল কানাইলালের। বড় বাড়ির ছেলে হয়েও এই ঝুঁকির রাস্তায় এসেছে। অনেকেই বলেছিল, নরেন পারবে তো এই কষ্টের জীবন সহ্য করতে? কানাইলাল বার বার বলেছিলেন, পারবে পারবে। হুগলীর রক্ত বইছে।
আর নরেনের সাথে আলোচনায় কতো প্রসঙ্গই এসেছে। পুলিশের অত্যাচারের কথা, চরম নির্যাতনের প্রসঙ্গ,অসহনীয় সহ্য শক্তির কথা। এসেছে আদর্শের কথা। দেশ মা কে জীবন দিয়ে রক্ষা করার কথা। ম্যাৎসিনি, গ্যারিবল্ডির লড়াই, স্বামীজির আদর্শ। নরপন্থার দুর্বলতার কথা। আর এসেছে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে দেশের প্রতি দায়বদ্ধ থাকার কথা, বিপ্লবী ‘যুগান্তর’ দলের মন্ত্রগুপ্তি গোপনীয়তা রক্ষার কথা। সেই নরেন এইরকম বিশ্বাসঘাতকতা করলো!! ‘রাজসাক্ষী’ হয়ে সব ফাঁস করে দিলো। পুলিশি অত্যাচার? সে কার ওপর হয়নি? আর এই পথে তো কেউ টেনে আনেনি, নিজেই এসেছে। কী ভেবেছিল, পুলিশ আদর করবে? অত্যাচার সহ্য করতে না পারে, আত্মহত্যা করতে পারতো। ‘রাজসাক্ষী’ হয়ে গেল? ‘রাজসাক্ষী’!! যন্ত্রণায় মাথাটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছিল তাঁর। নরেনকে তিনি সাপোর্ট করেছিলেন। মনস্থির করেছিলেন, এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত তিনি নিজেই করবেন।
কে এই ‘কানাইলাল’? চন্দননগরের এক তরুণ বিপ্লবী।১৮৮৮ সালের ৩০শে আগস্ট জন্ম। সেদিন ছিল ‘জন্মাষ্টমী’। বাবা মা আদর করে নাম রেখেছিলেন ‘কানাইলাল’। জন্ম থেকেই অসুস্থ, দুর্বল। কিন্তু অদম্য ছিল তাঁর মনের জোর। তাঁর স্থির নির্ভীক দুই চোখ প্রমাণ করত তাঁর মানসিক দৃঢ়তা। চন্দননগরের ‘ডুপ্লে স্কুলে’ (বর্তমানে ‘কানাইলাল বিদ্যামন্দির’) পড়ার সময় থেকেই দেশের প্রতি তাঁর অনন্ত টান। একটাই চিন্তা ছিল, কিভাবে দেশমাতার মুক্তি আনা যায়। ‘মহসিন কলেজে’ পড়ার সময় ‘যুগান্তর’ দলের সদস্য অধ্যাপক ‘চারুচন্দ্র রায়ের’ সান্নিধ্যে এসে বিপ্লবী দলে যোগ দেন। অস্ত্র চালনা শিক্ষা করেন। দেশি পিস্তলে ছিল তাঁর অব্যর্থ লক্ষ্য। চারু বাবু এক এক করে টার্গেট দিতেন, আর অবলীলায় তাকে ভেদ করতেন কানাই। আর তেমনি ছিল সাহস। পুলিশের সামনে দিয়ে স্বদেশী দ্রব্য, বিপ্লবী পুস্তিকা পাচার করতেন। পুলিশ বুঝতেই পারতনা মুখ দেখে।
একদিন ‘গোন্দল পাড়া গোষ্ঠী’র সদস্য হয়েছিলেন তিনি। ডাক পড়েছিল কলকাতায়। গুরু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁকে – ‘কিংসফোর্ড’কে হত্যা করতে হবে। তিনি তখন টগবগ করে ফুটছেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাঁর সাংগঠনিক পারদর্শিতা দেখে তাঁকে মজোফফরপুর না পাঠিয়ে কলকাতায় রেখে দেওয়া হয়েছিল দল গঠনের কাজে। দলের শৃঙ্খলা মানতেই হবে। সিদ্ধান্ত মেনে নতুন ছেলেদের অস্ত্র শিক্ষা, বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার কাজে লেগে পড়েছিলেন তিনি। সেখানেই নরেন গোঁসাইয়ের সাথে তাঁর আলাপ ও বন্ধুত্ব হয়।
১৯০৮ সালের ৩০শে এপ্রিল … কিংসফোর্ডকে বোমা মারার ব্যর্থ চেষ্টা করে ১লা মে ধরা পড়লেন ক্ষুদিরাম। সেই সূত্র ধরে কলকাতার অরবিন্দ ঘোষের বাগান বাড়ি তল্লাশি করে ‘অরবিন্দ ঘোষ’, ‘বারিন্দ্র ঘোষ’ সহ বহু বিপ্লবীকে ধরলো পুলিশ। নরেন আর কানাইলাল ছিলেন তাঁদের মধ্যে। হাজতে চললো অকথ্য অত্যাচার। পুলিশের কাছে প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছিলনা যে। তাই কথা বের করতে হবে। এঁদের বাইরে আর কে কে জড়িত তার স্বীকারোক্তি করাতে হবে। বড়লাট স্বয়ং নির্দেশ দিয়েছিলেন বিপ্লবীদের পুরোপুরি বিনাশ করতে হবে।পুলিশ তাই কয়েক মাস ধরে অমানুষিক অত্যাচার যেমন করেছিল – ‘নখের নিচে উত্তপ্ত আলপিন ঢুকিয়ে দেওয়া’, ‘উল্টো করে ঝুলিয়ে প্রচণ্ড প্রহার’; তেমনি লোভ দেখিয়েছিল ‘রাজসাক্ষী’ হলেই মুক্তি! দুইয়ের ফাঁদে ধরা দিয়েছিলেন নরেন গোঁসাই। পুলিশকে জানিয়েছিলেন তিনি ‘রাজসাক্ষী’ হতে প্রস্তুত।
সেটা শোনার পর বিপ্লবীরা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছলেন। বিপ্লবীদের বহু ধনী ব্যক্তি সাহায্য করতেন আড়াল থেকে, বহু পরিবার গোপনে তাঁদের আশ্রয় দিতেন। অস্ত্র লুকিয়ে রাখতেন বহু বাড়ির মেয়েরা, গৃহবধূরা। সব ফাঁস করে দেবে নরেন! তাই স্থির হল আদালতে তোলার আগেই তাঁকে শেষ করতে হবে। কিন্তু তাঁকে পাওয়া যাবে কোথায়? সে তো ছিল আলাদা সেলে, নিশ্ছিদ্র প্রহরায়। শুরু হয়েছিল পরিকল্পনা। দায়িত্ব নিয়েছিলেন ‘কানাইলাল দত্ত’ আর ‘সত্যেন বোস’।
বিরাট ঝুঁকি নিয়েছিলেন ‘মতিলাল রায়’ আর ‘শ্রীশচন্দ্র ঘোষ’। অত্যন্ত সাবধানে সমস্ত পুলিশি প্রহরা তল্লাশি এড়িয়ে দুটো পিস্তল পৌঁছে দিয়েছিলেন সত্যেন বোস, কানাইলাল দত্তের কাছে। এরপর ফাইনাল প্ল্যানিং শুরু হয়েছিল। ক’দিন ধরেই ‘হাঁপানি’তে প্রচণ্ড কষ্ট পাচ্ছিলেন সত্যেন বোস। এরপরে এতো টান শুরু হয়েছিল যে, তাঁকে জেল হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। হাসপাতালের বেডে শুয়ে ধুঁকছিলেন তিনি। এমন সময় পাশের বেডে আনা হয়েছিল কানাইলালকে। তখন প্রচন্ড পেটের যন্ত্রনায় তিনি অচৈতন্য! তাঁরা ভর্তি হয়ে রইলেন ক’দিন। ৩০শে আগস্ট, কানাইলালের জন্মদিন। পুলিশকে বললেন, ‘‘আর পারছিনা এই কষ্ট সহ্য করতে, দু’জনেই রাজসাক্ষী হবো। তবে আগে জানতে চাই নরেন রাজসাক্ষী হয়ে কেমন আছে। ভালো খেতে পরতে পাচ্ছে?’’ পুলিশ তো হাতে চাঁদ পেল। ঠিক হল পরদিনই আনা হবে ‘নরেন গোঁসাই’কে।
৩১শে আগস্ট সকাল ১১ টা। বেডে শুয়ে দুই বিপ্লবী দেখেছিলেন পুলিশের গাড়ি এসে থামলো। চারজন বন্দুকধারী প্রহরী নরেন কে নিয়ে উঠে আসছেন। এতদিনের অসুস্থতার অভিনয় তো ছিল এই দিনটার জন্যই। অবশেষে সুযোগ এসেছিল। ঝটিতি দুই বিপ্লবী সিঁড়িতে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। যেন স্বাগত জানাতে এসেছেন। নরেন আসতেই মুহূর্তে দু’জনের হাতে উঠে এসেছিল পিস্তল। ফায়ার করেছিলেন কানাইলাল। তাঁর পিস্তলে ছিল একটিই গুলি। নরেন তখন সত্যেন বসুর দিকে ফিরে ছিলেন। পিঠের দিকে গুলি ভেদ করেছিল তাঁকে। ড্রেনের মধ্যে গিয়ে পড়েছিলেন নরেন। বিশ্বাসঘাতকের উপযুক্ত স্থানে। আচমকা আক্রমণে দিশেহারা পুলিশরা লুকিয়ে পড়েছিল বেঞ্চের তলায়। বিপ্লবী দু’জন পালাননি। তাঁরা তৃপ্ত কন্ঠে চিৎকার করে উঠেছিলেন – ‘বন্দেমাতরম’। ধরা দিয়েছিলেন পুলিশের কাছে।
নরেন ঘাতক দুই বিপ্লবীকে ফাঁসির শাস্তি শোনাতে ব্রিটিশ সরকার সময় নিয়েছিল আড়াই মাস। কিন্তু এতটাই প্রত্যয়ী ছিলেন কানাইলাল‚ কোনও আইনি সাহায্য নেননি। পরিশীলিত ইংরেজিতে স্পষ্ট নিষেধ করেছিলেন উচ্চতর আবেদনেও লিখেছিলেন,
“There shall be no appeal.”
‘Will’ এর পরিবর্তে ‘Shall’ ব্যবহার করেছিলেন ‘Imperative Sentence’ অর্থে। অর্থাৎ আদেশ বা আজ্ঞাবাচক বাক্যে বলছেন‚ কোনও উচ্চ আবেদন না করতে।
শেষ কদিন একমাত্র ভাই ছাড়া কারও সঙ্গে দেখা করেননি। তাঁকেই বলে গিয়েছিলেন শেষকৃত্যে যেন কোনও পুরোহিত আচার অনুষ্ঠান না করে ১০ই নভেম্বর‚ ১৯০৮‚ আলিপুর জেলে ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়ে গিয়েছিলেন কুড়ি বছর বয়সী তরতাজা তরুণ কানাইলাল দত্ত। তার ১১ দিন পর ২৬ বছরের যুবক সত্যেন্দ্রনাথ বোস।
১৯০৮ সালের ৯ই নভেম্বর, ব্রিটিশ জেল ওয়ার্ডেন ফাঁসির আসামি কানাইলালকে বলেছিলেন, “… এখন হাসছ‚ হেসে নাও। কাল সকালে সব হাসি মিলিয়ে যাবে মুখ থেকে।” কারণ, ফাঁসির আগের দিনও তাঁর মুখে ছিল অমলিন হাসি! পরের দিন ভোরে ফাঁসির মঞ্চে ওঠার আগে সেই ওয়ার্ডেনের মুখোমুখি হয়েছিলেন কানাইলাল। জিজ্ঞাসা করেছিলেন‚ “এখন কীরকম দেখছেন আমাকে?” মাথা নিচু করেছিলেন ওয়ার্ডেন। মৃত্যু থেকে কয়েক কদম দূরে তখনও সেই নিষ্পাপ হাসি মুখে লেগেছিল কানাইলালের। হাসিমুখেই ফাঁসির মঞ্চে উঠে গিয়েছিলেন। ব্রিটিশ ওয়ার্ডেন পরে চারুচন্দ্র রায়কে বলেছিলেন‚ “I am the sinner who has executed Kanailal. If you have a hundred men like him, your aim will be fulfilled.”
‘শিবনাথ শাস্ত্রী’কে ‘ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য’ হিসেবে ‘ব্রাহ্মধর্মী ‘সত্যেন বসু’র সাথে দেখা করার জন্য জেলের কন্ডেম সেলে যাবার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, তিনি যাতে তাঁকে ‘শেষ আশির্বাদ’ করতে পারেন। সাক্ষাৎকার অন্তে জেলের বাইরে এলে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল কানাইকেও তিনি আশির্বাদ করে এলেন কিনা? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘‘সে যেন পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহ। বহু তপস্যা করলে তবে যদি কেউ তাঁকে আশির্বাদ করার যোগ্যতা লাভ করতে পারে!’’
১০ই নভেম্বর ১৯০৮ … ‘‘নো নো, ডোন্ট ব্ল্যাকেন মাই ফেস, প্লীজ!’’ – ফাঁসির মঞ্চে উঠে আসতে আসতে মাথা থেকে গলা পর্যন্ত ঢাকবার কালো কাপড় হাতে ধরে রাখা লোকটির দিকে চেয়ে অনুরোধের সঙ্গে একটা ভুবনভোলানো হাসি ছুঁড়ে দিয়েছিলেন কানাইলাল দত্ত। সদ্য স্নান সেরে এসে তাঁকে আরও নির্মল, আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল কি? মঞ্চের পিছনে দাঁড়িয়ে এ-হেন শেষ অনুরোধ শুনে কিছুটা বিব্রতই হয়েছিলেন ‘ইংরেজ জেলার ইথান প্রাইস’। তাঁর নাতিদীর্ঘ কর্মজীবনে এর আগে যে ফাঁসি তিনি দেখেনি, তেমনটা নয়। তবে সেবারের সবকিছুই যেন নতুন ঠেকেছিল তাঁর কাছে। তার একটা প্রমাণ তিনি নিজেও অনুভব করেছিলেন নিজের স্নায়ুতে। ‘কমিশনার হ্যালিডে’ ইঙ্গিত করেছিলেন, আসামীর ইচ্ছাকে মান্যতা দেওয়ার। অগত্যা, ফাঁসুড়ে তাঁর হাতের দড়িটা মুখ-না-ঢাকা কানাইলালের গলায় দিতে এগিয়ে এসেছিল।
‘‘ইট ডাজন্ট ফীল রাইট!’’ … স্পষ্ট ইংরেজিতে উচ্চারিত কথাটা শুনে হ্যালিডে চমকে তাকিয়েছিলেন। হতবাক হয়ে দেখেছিলেন, ‘ম্যানিলা রজ্জু’টা কেমন করে যেন মাথা দিয়ে ঠিকঠাক গলানো হয়নি; সহাস্য আসামী ডান হাতের দুই আঙুলে সেটাকেই ঠিক করে নিজের গলায় পরে নিচ্ছেন!
‘‘মিস্টার প্রাইস, য়ু দেয়ার?’’ … পরিচিত হাসির সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নটা ভেসে এসেছিল কানাইলালের দিক থেকে। মাথা আর সোজা রাখতে পারেননি ইথান। মুখ নামিয়ে চোখ রেখেছিলেন মাটির দিকে। ‘‘য়ু ওয়ন্টেড টু সী মি, রাইট? হাউ ডু আই লুক নাউ?’’ … লিভার টানার চেনা শব্দটা ফুরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ‘ইথান প্রাইস’ এক মনে ভাববার চেষ্টা করেছিলেন, ওই কালো কাপড়টা দিয়ে তাঁরই মাথা-মুখ ঢেকে দেওয়া হল না কেন! তারপরে কুয়ো থেকে বের করা দেহটার দিকে না তাকিয়েই হাঁটা দিয়েছিলেন জেল অফিসের দিকে …
আর তারপর … জেলগেট দিয়ে দাদা আশুতোষ দত্ত ভাইয়ের মৃতদেহ নিয়ে বাইরে এসে দেখেছিলেন অত সকালেও সেখানে বহু মানুষ হাজির। দেহ তাঁরাই কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। শবযাত্রা যত এগিয়েছিল তত বেড়েছিল ভীড়।
সত্যেন্দ্রনাথের শবদেহ জেলের বাইরে আসে নি। জেলখানার উঁচু পাঁচিলের ঘেরাটোপের মধ্যে দাহ করা হয়। এমনকি হেমচন্দ্র কানুনগোরা কোনও স্মৃতিচিহ্ন পর্যন্ত সঙ্গে নিতে পারেননি। আসলে মাত্র দশ-বারো দিন আগের একটি ঘটনা পুলিশের পক্ষে বিড়ম্বনার হয়ে উঠেছিল; এই যাত্রায় তাই তাঁরা কোনও ভুলের সুযোগ রাখতে চায়নি। ১০ই নভেম্বর ১৯০৮ সত্যেন্দ্র-সঙ্গী কানাইলাল দত্তের ফাঁসি হয়। সে দিন তাঁর শবদেহ নিয়ে কলকাতা শহরের বুকে এক জনপ্লাবনের সাক্ষী থেকেছিল পুলিশ। লক্ষ লক্ষ মানুষ। তাঁরা একে অপরকে ধাক্কা দিয়ে এক বারের জন্য হলেও শববাহী খাটটি ছুঁতে চেয়েছিলেন। সর্বত্র ‘জয় কানাই’ ধ্বনিতে আন্দোলিত হয়েছিল। কেওড়াতলা শ্মশানে দাহকার্যের পর কানাইলালের ‘চিতাভস্ম’ কেনার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু হয়েছিল। আধ ছটাক চিতাভস্মের জন্য কোনও কোনও অত্যুৎসাহী পাঁচ টাকা পর্যন্ত দিয়েছিলেন। পুলিশের পদস্থ কর্মচারী ‘এফ সি ড্যালি’র বক্তব্য ছিল, “কানাইলাল দত্তের চিতাভস্ম বলে কলকাতায় যা বিক্রি হয়েছিল, অনুমান করা হচ্ছে তা চিতাভস্মের প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে অন্ততঃ পঞ্চাশ গুণ বেশি!”
আজও বাংলার ঘরে ঘরে পালিত হয় জন্মাষ্টমী। কৃষ্ণের মতন সন্তান কামনা করেন, কৃষ্ণের পূজা করেন অনেকেই। তবুও বিস্মৃতির অন্ধকারেই থেকে যান বাংলার এক দামাল কৃষ্ণ, কানাইলাল দত্ত। জন্মাষ্টমীতেই জন্ম হয়েছিল যাঁর। বাঙালি কি এখন কানাইলালের মতন কৃষ্ণকে সন্তানরূপে চায়?
তবুও তাঁর নাম উচ্চারিত হলে আজও অমোঘ হয়ে ওঠে গীতার সেই বাণী –
‘‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারতঃ। অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চতুষ্কৃতাম্। ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে॥”
কানাইলালের মৃত্যুর প্রায় পনেরো বছর পরে তাঁর শেষযাত্রা নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন মতিলাল রায়। প্রকাশ করেছিলেন ফরাসি শাসনের চন্দরনগর থেকে। লিখেছিলেন‚ কম্বল সরাতেই দেখা গেল শুয়ে আছেন কানাইলাল। তাঁর লম্বা চুল এসে পড়েছে কপালে। দুটি অর্ধনিমীলিত চোখ দেখে মনে হছে তিনি অমৃতসুধা পানের স্বাদ লাভ করেছেন। দৃঢ় বদ্ধ ওষ্ঠ এবং দুই হাত মনে করিয়ে দিচ্ছে জীবনপণ। নিথর দেহে কোথাও একটুও মৃত্যুকষ্ট নেই। ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল সেই বই।
শহিদ কানাইলাল দত্তর মৃতদেহ নিয়ে শোভাযাত্রায় কলকাতার রাজপথে জনজোয়ার দেখে ভীত হয়ে পড়েছিল ব্রিটিশ সরকার। এতটাই‚ যে পরে রাজবন্দি বা প্রাণদণ্ড পাওয়া বন্দির দেহ নিয়ে শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯০৮ সালের ২রা মে মোকামাঘাট স্টেশনে নিজেকে দুবার গুলি করে আত্মঘাতী হয়েছিলেন প্রফুল্ল চাকী। ১১ই অগাস্ট ফাঁসি হয় ক্ষুদিরাম বোসের। তাঁকেই প্রথম শহিদের মান্যতা দেওয়া হয়। প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসুর পরে তৃতীয় ও চতুর্থ শহিদ হলেন যথাক্রমে কানাইলাল দত্ত এবং সত্যেন্দ্রনাথ বোস। পরপর তরুণদের আত্মবলিদান গভীর প্রভাব ফেলেছিল জনমানসে। সূচিত হয়েছিল দেশব্যাপী সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলনের নান্দীমুখ।
ক্ষুদিরাম বসু প্রথম বাঙালি বিপ্লবী, ব্রিটিশের ফাঁসিকাঠে যাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। ১৯০৮-এর ১১ই অগস্ট তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। সেই থেকে ১৯৪৪-এর ২৪শে অগস্ট পর্যন্ত মোট একচল্লিশ জন বাঙালি বিপ্লবীকে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়াতে হয়েছে। ফাঁসি দেওয়া হয়েছে মজফফরপুর, আলিপুর, মেদিনীপুর, বরিশাল, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, ফরিদপুর, অম্বালা, বালেশ্বর, বরাবাঁকি, গোণ্ডা, মাদ্রাজ এবং দিল্লি জেলে। অনেকেরই পূর্ণপরিচয় জানা যায়নি, ছবিও অপ্রতুল। এঁদের মধ্যে সব থেকে বেশি বয়সে ফাঁসি হয়েছে মাস্টারদা সূর্য সেনের— চল্লিশ। বাকিদের বয়স সাতাশের ঊর্ধ্বে নয় – তবে এই পরিসংখ্যান নিয়ে চাপান-উতোর আছে। অন্তত ছয় জন বিপ্লবীর বয়স জানাই সম্ভব হয়নি।
চট্টগ্রাম থেকে নয়নতারা দেবী এসেছেন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে, ছেলেকে শেষ বার দেখতে। চট্টগ্রামের গণতান্ত্রিক রক্ষীবাহিনীর সদস্য তাঁর পুত্র রামকৃষ্ণ বিশ্বাস। সূর্য সেনের বিশ্বস্ত পার্ষদ। পুলিশের আইজি ক্রেগকে মারতে গিয়ে রামকৃষ্ণ ও কালীপদ চক্রবর্তী খুন করেছেন পুলিশ অফিসার তারিণী মুখোপাধ্যায়কে। রাতের অন্ধকারে চাঁদপুর রেল স্টেশনে এই ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁরা ধরা পড়ে গেলেন বাইশ মাইল দূরে মেহেরকালী স্টেশনে। ফাঁসির ঘোষণা হয়ে গেছে।
ছেলের সঙ্গে এক বার দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য নয়নতারা দেবীকে কলকাতায় নিয়ে এসেছেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। গত তিন মাসে প্রীতিলতা রামকৃষ্ণের সঙ্গে জেলে দেখা করে গিয়েছেন অন্তত চল্লিশ বার। মাসতুতো বোনের মিথ্যে পরিচয় দিয়ে। আজ নিয়ে এসেছেন মাকে, ‘‘আমি চট্টগ্রামে গিয়ে রামকৃষ্ণদা’র মা’কে কলকাতায় নিয়ে এসেছিলাম। আলিপুর জেলে রামকৃষ্ণদা’র সাথে তাঁর মায়ের শেষ দেখা করিয়ে দিয়েছি। তাঁর মায়ের হৃদয়বিদারক কান্নার করুণ দৃশ্য দেখে আমিও না কেঁদে পারিনি।’’
১৯৩১-এর ৪ঠা আগস্ট গুরুতর অসুস্থ রামকৃষ্ণকে রাত বারোটা নাগাদ অতি গোপনে ফাঁসি দেওয়া হয়।
“মা যদি এখানে এসে না কাঁদেন, তবেই আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারি, নচেৎ নয়।” – ফাঁসির কয়েক দিন আগে হেমচন্দ্র কানুনগোকে জেলের গরাদের ও পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তা-ই হল। আলিপুর জেলে মা ও ছেলে মুখোমুখি। বুকের কান্না চোখের জলে ধুয়ে যাওয়ার সুযোগ পেল না। সত্যেন্দ্রর ফাঁসির আগে প্রার্থনা করার জন্য জেলে গিয়েছিলেন পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী। আলিপুর বোমা মামলায় অভিযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ ও কানাইলাল দত্ত জেলের ভিতরে বিশ্বাসঘাতক নরেন গোঁসাইকে খুন করেছিলেন। অভিযুক্ত দু’জনেরই ফাঁসির সাজা ঘোষণা হল। সত্যেন্দ্রর ফাঁসি হয় ১৯০৮-এর ২১শে অথবা ২৩শে নভেম্বর। তখন তাঁর বয়স ছাব্বিশ।
১৯৩৪ এবং ১৯৪৩ সাল দু’টি বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সব থেকে দুর্ভাগ্যজনক বছর। দশ জন করে বিপ্লবী ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছেন এই বছর দু’টিতে। এর মধ্যে ১৯৪৩ সালের ইতিহাস এক কথায় নৃশংস, নারকীয়। এই বছরে যে দশ জনের ফাঁসি হয়েছিল তার মধ্যে নয় জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল একই দিনে, একই জেলে! নয় বাঙালি তরুণই পেশায় ছিলেন চতুর্থ মাদ্রাজ উপকূল রক্ষী বাহিনীর সেনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে থেকে তাঁরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন সে দিন। ধরা পড়ে গেলেন। শুরু হল বিচারের নামে প্রহসন। নয় জনের অন্যতম দুর্গাদাস রায়চৌধুরী মৃত্যুর কয়েক দিন আগে জেলখানায় বসে লিখেছিলেন একটি ‘খোলা চিঠি’, “আমাদের কেন ফাঁসি হইতেছে তাহা জানিবার জন্য আপনারা আগ্রহান্বিত। ব্রিটিশ সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাই ইহার কারণ। … আমরা বাঙালি সৈনিক। দেশের স্বাধীনতার আহ্বানে আমাদের নয়টি জীবনদীপ নির্বাপিত হইতে চলিয়াছে।”
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একই দিনে এক সঙ্গে নয় জনের ফাঁসির ঘটনা আর কখনওই ঘটেনি। দুর্গাদাস ছাড়া বাকি যে আট জনের ফাঁসি হয়েছিল তাঁরা হলেন কালীপদ আইচ, চিত্তরঞ্জন মুখোপাধ্যায়, নন্দকুমার দে, নিরঞ্জন বরুয়া, নীরেন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, মানকুমার বসু ঠাকুর, সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায় এবং ফণিভূষণ চক্রবর্তী। এঁদের মধ্যে মানকুমার ছিলেন প্রখ্যাত রসায়নবিদ প্রতুলচন্দ্র রক্ষিতের শ্যালক। ফাঁসির পাঁচ দিন আগে, ১৯৪৩-এর ২২শে সেপ্টেম্বর, মানকুমার জামাইবাবুকে লিখেছিলেন,
“আমার চলে যাওয়ার সেই চরম মুহূর্ত এসেছে। আমি আপনার কাছে আমার বন্ধনমুক্ত আত্মার জন্য শুধু আশীর্বাদ চাইবো। … আমার আত্মার শান্তির জন্য আমি আপনাদের সকলের প্রার্থনা কামনা করছি।”
২৭শে সেপ্টেম্বর ১৯৪৩ ভোরবেলায় এঁদের গলায় ফাঁসির দড়ি পরিয়ে দিয়েছিলেন ফাঁসুড়ে শিবু ডোম। পুরো নাম শিবলাল। তাঁর স্মৃতিচারণ,
“সেদিন তেনারা খুব গান গাইছিলেন সবাই মিলে। যখন শেষ সময় এসে গেল, জোর গলায় বলতে লাগলেন জয় হিন্দ-জয় হিন্দ-জয় হিন্দ।”
এই শিবলালই নয় বছর আগে, ১৯৩৪-এর ১২ই জানুয়ারি, চট্টগ্রাম জেলে ফাঁসির দড়ি পরিয়ে দিয়েছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন এবং তারকেশ্বর দস্তিদারের গলায়।
রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে গাইতে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েছিলেন কৃষ্ণগোপাল চৌধুরী। মেদিনীপুর জেলে ১৯৩৪ সালের ৫ই জুন তাঁর সঙ্গেই ফাঁসি হয়েছিল হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর। সূর্য সেনের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। তার বদলা নিতে হবে। ৭ই জানুয়ারি এঁরা দু’জন ইওরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করলেন। ধরাও পড়ে গেলেন। বিশৃঙ্খলার ভয়ে দণ্ড কার্যকর করতে দু’জনকে চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে আনা হয়েছিল মেদিনীপুরে। সেখানে তখন বন্দি ছিলেন যুগান্তর দলের সদস্য সীতাংশু দত্ত রায়। তাঁর স্মৃতিচারণ: কৃষ্ণগোপাল ফাঁসির আগের কয়েক দিন জেলে সারা দিন একটা গান মাঝে মাঝেই গেয়ে উঠতেন – ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা।’ অন্য রাজবন্দিদের ডেকে বলতেন, ‘‘এই গান গাইতে গাইতে ফাঁসির দিন বধ্যভূমিতে যাব। গান যখন আর শুনতে পাবেন না, বুঝতে পারবেন – সব শেষ।’’
রবীন্দ্রনাথের গানে আর কবিতায় অন্তরাত্মার মুক্তি খুঁজে পেয়েছিলেন আর এক ফাঁসির আসামি, বছর উনিশের প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্য। ডগলাস-হত্যার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হলেও তাঁর মনে কোনও ভাবান্তর দেখেননি সহবন্দিরা। বিপ্লবী ভূপাল পাণ্ডা প্রদ্যোতের সেল থেকে শুনতে পেতেন তাঁর মধুমাখা কণ্ঠে রবীন্দ্রবাণী,
‘‘তোর আপনজনে ছাড়বে তোরে
তা বলে ভাবনা করা চলবে না
আসবে পথে আঁধার নেমে,
তাই বলে কি রইবি থেমে …।’’
মৃত্যুর আগে মেদিনীপুর জেল থেকে বড় বৌদি বনকুসুম দেবীকে যে চিঠি লেখেন, তাতেও ছিল ‘গীতাঞ্জলি’ থেকে উদ্ধৃতি। ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায় জানাচ্ছেন, ফাঁসির আগে প্রদ্যোৎ জেল থেকে পরপর দু’টি চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে, ‘‘সম্ভবত জেলের কঠিন নিয়ম ভেদ করে সে চিঠি দু-খানি কবির হাতে পৌঁছায়নি।’’
হুগলির গোপীনাথ সাহাকে খুব ভালবাসতেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সুভাষচন্দ্র বসু, কাজি নজরুল ইসলাম। টেগার্ট সাহেবকে মারতে গিয়ে গোপীনাথ ভুল করে নিরপরাধ ডে সাহেবকে হত্যা করলেন। তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল প্রেসিডেন্সি জেলে। ফাঁসির আগের রাতেও গোপীনাথ দিব্যি ঘুমোচ্ছিলেন। মৃত্যুভয় তাঁর নিশ্চিন্ত নিদ্রাকে স্পর্শও করতে পারেনি। ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত লিখেছেন,
‘‘ফাঁসির জন্য ডাকতে গেছে, দেখে গোপী ঘুমুচ্ছে। এক কথাতেই উঠে সঙ্গে চলল। কী সে পা ফেলার ভঙ্গী! বুক ফুলিয়ে ফাঁসির কাঠে দাঁড়াল, নিজেই যেন সাহায্য করতে চায় ফাঁসির রশিটা গলায় বাঁধতে, কিন্তু ওর হাত দুটো তখন পেছনে বাঁধা।’’
ষোলো বছরের গোপীনাথের ফাঁসি হয়েছিল ১৯২৪-এর ১লা মার্চ। তাঁর শবদেহ বাইরে আনতে দেওয়া হবে না, জেলেই সৎকার করা হবে। প্রতিবাদে ছাত্র-যুবকেরা জেলের বাইরে পিকেটিং শুরু করল। আপসহীন চরমপন্থী সুভাষচন্দ্র বসু এই পিকেটিংয়ে যোগ দিলেন। তিনি যে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতিশীল তা পুলিশের অজানা ছিল না। এই ঘটনায় তাঁর নাম পুলিশের খাতায় পাকা হয়ে গিয়েছিল।
(তথ্যসূত্র:
১- অগ্নিযুগ, শৈলেশ দে।
২- ওরা আকাশে জাগাতো ঝড়, শৈলেশ দে, দে’জ পাবলিশিং।
৩- দি লেজেন্ড অব অগ্নিযুগ, জয়ন্ত কুমার ঘোষ, ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত