তাঁর শরীরটা ঠিক যাচ্ছিল না সেবার। কিন্তু বাইরে সে অসুস্থতার কোনও প্রকাশ ছিল না। সকলের সঙ্গেই তাঁর ছিল একরকম সুন্দর ব্যবহার আর সেই হাসিমুখ। এক সময়ের ছাত্র ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের’ সঙ্গে গাড়িতে এক কবিতা পাঠের আসরে যাচ্ছিলেন। তখন তাঁর খ্যাতি গগনচুম্বী, তবু কুণ্ঠা ছিল। ‘সুনীল’কে বলেছিলেন, ‘‘আমার কবিতা বড্ড সেকেলে। তোমাদের মতো আধুনিক ভাষা আমার কই? পড়তে লজ্জা লাগে!’’ কথায় কথায় স্যারের শরীরের খবর নিয়েছিলেন ‘সুনীল’। জানতেন অসুস্থ, ‘‘এখন কেমন আছেন স্যার?’’ ‘‘হ্যাঁ ভালো আছি।’’ চোখের নীচে ক্লান্তি থাকলেও মুখের হাসিটি ছিল একইরকম। অনুষ্ঠান শেষে তিনি ‘সুনীল’কে বলেছিলেন, ‘‘একদিন আমার বাড়িতে এসো না, কাছেই তো থাকি।’’ ‘‘হ্যাঁ স্যার, এর মধ্যেই একদিন যাব।’’ সে যাওয়া আর হয়ে ওঠে নি ‘সুনীলের’।
১৯৭০ সালের ৫ই নভেম্বর। রাতের খাওয়া হয়েছিল সবেমাত্র। পুত্র ‘অরিজিৎ’ পাশের ঘরে বসে বাবারই দেওয়া শার্লক হোমসের গল্প পড়ছিলেন। এমন সময়ই মা আশাদেবীর চিৎকার, ‘‘বাবলু দ্যাখ, বাবা কেমন করছেন!’’ বাবার ঘরে দৌড়ে গিয়েছিলেন ছেলে। বাবাকে দেখেই ছুট দিয়েছিলেন কাছে থাকা ‘চিকিৎসক-সাহিত্যিক’ ‘নীহাররঞ্জন গুপ্তের’ ‘উল্কা’ বাড়িতে। গেঞ্জি গায়েই ছুটে এসেছিলেন ‘কিরীটির স্রষ্টা’। পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘‘এখনই হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।’’ বেশ কয়েকটা বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরেছিলেন অরিজিৎ। সব জায়গাতেই এক রা, ‘বেড নেই’। পরে ভর্তি করানো হয়েছিল ‘এসএসকেএম’-এ। মাত্র একটা দিন। ৬ই নভেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন বাঙালির প্রিয় ‘সুনন্দ’। বাঙালির কাছে খবরটা ছিল হাহাকারের মতো। কিন্তু সুনন্দ’র কাছেও কি এটা আকস্মিক ছিল? বোধ হয় না। তা না হলে কী ভাবে ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘সুনন্দর জার্নাল’-এর ‘শেষ জার্নাল’ ‘অসুস্থ শরীরের ভাবনা’য় ‘সুনন্দ’ লিখেছিলেন, ‘‘অসুস্থ শরীরে জার্নাল লিখতে লিখতে ভাবছি, পরের সংখ্যায় ‘সুনন্দের পাতাটি’ যদি না থাকে, তা হলে বুঝবেন, আর একটি কমন ম্যান বাঙালির অবলুপ্তি বা আত্মবিসর্জন ঘটল।’’ ফুলে ফুলে সাজানো ট্রাকে চড়ে নারায়ণ গিয়েছিলেন শেষ যাত্রায়। সঙ্গী হয়েছিলেন তাঁর অগণিত ছাত্রছাত্রী, সংবাদমাধ্যম, নানা পত্রিকা, সংস্কৃতি জগতের বহু বিশিষ্ট মানুষ। এমন মেঘলা আবহাওয়ায় আচমকা শোনা গিয়েছিল, ‘জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে …’ নিজেকে সামলে কখন দরাজ কণ্ঠে গেয়ে উঠেছিলেন ‘সুচিত্রা মিত্র’। ‘সুনীল’ও সেদিন শয়ে শয়ে মানুষের ভিড়ের সঙ্গে হেঁটে শ্মশানে পৌঁছেছিলেন। হয়তো সেদিন সেই ভিড়ের মধ্যে ‘ক্যাবলা’, ‘হাবুল’, ‘প্যালারাম’ও ছিল। কিশোর অবুঝ মন নিয়ে ভাবছিল এই এক্ষুনি বুঝি ‘ডি লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক’ বলে একমুখ হাসি নিয়ে পালঙ্ক থেকে উঠে দাঁড়াবেন তাঁদের বন্ধু। অপেক্ষা করছিল … তারপরে ‘শিলালিপি’-র নায়কের শেষ চিহ্নটুকু যখন ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছিল গঙ্গার বুকে, তখন ‘সুচিত্রা মিত্র’ ভিজে গলায় গেয়ে উঠেছিলেন – ‘তবু মনে রেখো …’।
লেখার সময় কখনই চেয়ার-টেবিল ব্যবহার করতেন না নারায়ণ বিছানায় বালিশ বুকে নীচে নিয়ে উপুড় হয়ে আধশোয়াভাবে বেশ আয়েশ করেই লিখতেন। বরাবরই এমন অভ্যাস ছিল তাঁর। ‘নরেন্দ্রনাথ মিত্রের’ সাথে বেশ কিছুকাল একই মেসে একই ঘরে কাটিয়েছিলেন। তখনও নারায়ণ লিখতেন তক্তপোশে উপুড় হয়ে শুয়ে আর নরেন্দ্র শিরদাঁড়া সোজা করে বসে। লম্বা ফুলস্কেপ কাগজের একপিঠে ছোট ছোট অণুবীক্ষণিক অক্ষরে লিখতেন। আয়েশ করে লিখতে বসলে কি হবে লেখার গতি ছিল দুরন্ত। ‘সুনন্দর জার্নাল’ লিখতে বড়জোর সময় লাগত ঘন্টা খানেক! ছোট গল্প লিখতে খুব বেশি হলে একদিন! আর মাঝারি মাপের উপন্যাস এক সপ্তাহের মধ্যে শেষ! তাঁর ছবি আঁকার হাতটিও ছিল চমৎকার। লেখায় মনোসংযোগ করার জন্য লেখার খাতার মলাটে যা খুশি স্কেচ করতেন।
তাঁর বাড়িতে ছিল বিশাল ‘বিড়ালবাহিনী’। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা নাম। রোজ নিজের হাতে তাদের পঙক্তিভোজন করাতেন নারায়ণ। আর তাঁর নিজের খাবার সময়ে পুষ্যিরা ভিড় করে বসে থাকত পায়ের সামনে। পিতার বিড়ালাসাক্তির ছোঁয়াচ লেগেছিল পুত্র ‘অরিজিতের’ মধ্যেও। মাঝেমাঝেই রাস্তা থেকে বাড়িতে তুলে নিয়ে আসতেন বিড়ালছানা। কাউকে নর্দমা থেকে কাদা মাখা অবস্থায় তুলে, তো কাউকে আবার অসুস্থ অবস্থায়। মা ‘আশাদেবী’র প্রবল আপত্তি কানেই তুলতেন না কিশোর ‘অরিজিৎ’। তিনি জানতেন বাবার বিপুল সায় রয়েছে। তারপর শুরু হত তাদের নাওয়ানো, প্রাথমিক চিকিৎসা ইত্যাদি। সে সব মিটলে ছাদে ইঁটের খুপরি বানিয়ে তার মধ্যে রেখে দিতেন ছানাদের। বাবা নারায়ণ বিকেলে বাড়ি ফেরার পরে তাদের বন্দিদশা থেকে মুক্তি মিলত আর বাকি জীবন জুটত ‘নারায়ণ-সেবা’।
সেবার উত্তরবঙ্গে প্রবল বন্যা হয়েছিল, ঠিক হয়েছিল কলকাতার সাহিত্যিকরা সকলে মিলে পদযাত্রা করবেন, সকলের কাছ থেকে অর্থসাহায্য ও জামাকাপড় সংগ্রহ করার জন্য। ‘শ্যামবাজারের মোড়’ থেকে যেদিন পদযাত্রা শুরু হবে, সেদিন সকাল থেকেই আকাশে ছিল প্রচন্ড রোদ। দেখা গিয়েছিল বেশিরভাগ সাহিত্যিকই অনুপস্থিত, কিন্তু নারায়ণ ঠিক এসে হাজির হয়েছিলেন। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী আশাদেবীকেও নিয়ে এসেছিলেন। তারপরে ওই রোদ মাথায় নিয়ে প্রায় চার ঘণ্টা হেঁটে দুর্গতদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ করায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।
‘সুনন্দর জার্নাল’ – এর দোসর ছিল ‘চন্ডী লাহিড়ীর কার্টুন’। সুনন্দ’য় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় যা লিখতেন ‘চন্ডী লাহিড়ী’ ছবি আঁকতেন ঠিক তার উল্টো। অর্থাৎ লেখা ও ছবি চূড়ান্ত পরস্পর বিরোধী হত। এটা ইচ্ছা করেই করতেন চন্ডী, যাতে নারায়ণ যে কথা বলে ওঠেন নি, চন্ডী তাঁর আঁকা ছবিতে সেইটুকুও বলে দিতেন। দু’জনের দারুন যুগলবন্দী জমে উঠেছিল। কিন্তু দু’জনেই পরস্পরের মুখোমুখি হতেন না। বিশেষ করে চন্ডী তো খুব সাবধানে এড়িয়েই চলতেন নারায়ণ কে। জানতেন তাঁর মতন মানুষের মুখোমুখি হলে প্রভাবিত হয়ে পড়বেন, আর যা ইচ্ছে ছবি আঁকতে পারবেন না। কিন্তু দু’জনেই ছিলেন দু’জনের গুণমুগ্ধ। শেষে একদিন আর পালিয়ে লুকোতে পারেননি চন্ডী, ধরা দিতেই হয়েছিল। আর নারায়ণও ছিলেন তেমনই মানুষ। তাঁর ও চন্ডী লাহিড়ীর প্রথম সাক্ষাতে দু’জনে অনেক গল্প করেছিলেন। কিন্তু নারায়ণ একবারের জন্যও ‘সুনন্দর জার্নাল ও তার ছবির প্রসঙ্গ’ তোলেন নি। চন্ডী বুঝেছিলেন যে নারায়ণ এটা ইচ্ছা করেই করেছিলেন, পাছে নারায়ণের কথায় চন্ডী প্রভাবিত হয়ে পড়েন। তবে এই আলাপের পরে নারায়ণ তাঁর এক সাংবাদিক বন্ধুকে বলেছিলেন, ‘‘চন্ডী আমার টাক দেখে ফেলেছে। এবারে আমার টাকের ছবি না এঁকে বসে।’’ সে কথা কানে গিয়েছিল চন্ডী লাহিড়ীর। কিন্তু নারায়ণের টাক মাথার ছবি কোনও দিন আঁকেন নি তিনি।
‘সুনন্দর জার্নাল’ তখন হই হই করে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছিল। বাঙালি পাঠক প্রতি সংখ্যার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকতেন কলামটি পড়বেন বলে।প্রতিটি কিস্তিই যেন ছিল নলেন গুড়ের রসে ডোবানো এক-একটি তীক্ষ্ণ তির। তেমনই একটি সংখ্যায় পাড়ার কালীপুজো নিয়ে অসুস্থ শরীরে ‘সুনন্দ’ লিখেছিলেন, ‘‘এই এক ঘণ্টার মধ্যে বার আষ্টেক শুনেছি, ‘আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল’। অকালমৃত পান্নালাল ভট্টাচার্যের দুর্ভাগ্য (না না আমারই), এমন দরদ দিয়ে গাওয়া গানটিও আমার যমযন্ত্রণা হয়ে উঠেছে। যত দূর খবর পেয়েছি শ্যামাপুজোয় পরম উৎসাহী যুবকবৃন্দের দু’দিনে আনন্দের বন্যার সাধও মেটেনি, আশাও পোরেনি। তাঁরা আরও দিন তিনেক প্রতিমা প্যান্ডেলে রেখে দেবেন এবং এই সঙ্গীতের মহোৎসব সমানে চালিয়ে যাবেন।’’ ব্যঙ্গরসের লেখাটির ‘শেষ লাইন’ পড়ে একটু চমকেই উঠেছিলেন পাঠক। নারায়ণ লিখেছিলেন, ‘‘সুতরাং অসুস্থ শরীরে জার্নাল লিখতে লিখতে ভাবছি পরের সংখ্যায় ‘দেশ’-এ সুনন্দর জার্নালের পাতাটি যদি অদৃশ্য হয় আশা করি তাহলে আপনারা কেউই বিস্মিত হবেন না। জানবেন আরেকটি কমনম্যান বাঙালীর অবলুপ্তি বা আত্মবিসর্জন ঘটল।’’ সেদিন অবশ্য সকলেই মুচকি হেসে ভেবেছিলেন, ধুস তাই আবার হয় নাকি! এও নিশ্চয়ই এক ‘নারায়ণী রস’। কিন্তু তারপর যখন আর সত্যিই প্রকাশ পেল না ‘সুনন্দ’, তত দিনে গোটা বাংলার মানুষ জেনে গিয়েছিলেন তাঁদের প্রিয় ‘জার্নাল’ আর সত্যিই কোনও দিন প্রকাশ পাবে না। ‘আজন্ম রসিক নারায়ণ’ সেবার বড় বাস্তব রসিকতা করেছিলেন তাঁর নিজের জীবনের সঙ্গেই! কী করে যে আগাম জেনে গিয়েছিলেন নিজের চলে যাওয়া!
তাঁর বাবা ‘প্রমথনাথ’ ছিলেন দুঁদে দারোগা। আরবি ঘোড়ায় চেপে তিরিশ মাইল দূরে ডাকাত ধরতে যেতেন। ডাকাত ধরে বাড়ি ফিরেই ছোট ‘তারকনাথ’কে (নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের আসল নাম) প্রথম প্রশ্ন করতেন, ‘‘যে বইগুলো ভিপিতে আসার ছিল এসেছে?’’ এমনই ছিল তাঁর বইয়ের নেশা। সময় পেলেই ডুবে যেতেন দেশ বিদেশের নানা বইয়ে। ওই সময়ে পুলিশে বই পড়ছে সেটাকে পুলিশমহলে ভারী অন্যায় এবং লজ্জাজনক ব্যাপার বলে ধরা হতো, কিন্তু তাঁর বাবা ছিলেন পুরো উল্টো। বই-অন্ত প্রাণ। বাড়িতে ছিল বিশাল একটা লাইব্রেরি, সেখানে ‘শেলি-মিলটন-শেক্সপিয়র’-এর পাশাপাশি থাকত বাংলাদেশের প্রায় সব সাহিত্যপত্রিকা। সেগুলি ‘প্রিয়নাথ’ নিজে যেমন গোগ্রাসে পড়তেন ছেলের মধ্যেও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন পড়ার নেশা। ফলে যে বয়েসে ‘খোকাখুকুর গল্প’ পড়ে তাঁর মন ভরার কথা ছিল, সেই বয়েসেই তিনি পড়ে ফেলেছিলেন ভারতবর্ষর পাতা থেকে ‘শ্রীকান্তর ভ্রমণ কাহিনী’, দেশবন্ধু দাশের ‘স্বামী’র মতো প্রাপ্তমনস্ক লেখা। সব যে বুঝতেন তা নয়, কিন্তু মনে এক অদ্ভুত দোলা লাগত। এইভাবে পড়তে পড়তে ইস্কুল জীবনেই একদিন শুরু হয়ে গেল তাঁর কবিতা লেখা। নিভৃতে কবিতা চর্চার জায়গা ছিল বাড়ির বারান্দার এক কোণে ভাঙাচোরা জিনিসে ভর্তি এক কাঠের স্তুপ। সেই স্তূপের ওপরেই বসে চলেছিল তাঁর অবিরাম কবিতাচর্চা। নীরব সাক্ষী ছিল শুধু অজস্র ইঁদুর। লিখতেন, ছিঁড়ে ফেলতেন আবার লিখতেন। এর মধ্যেই ‘আনন্দলহরী সিরিজের’ বেশ কিছু ক্রাইম থ্রিলার পরে বালক ‘তারকনাথের’ মনে হয়েছিল এইরকম গল্প লিখলে কেমন হয়? ভাবা মাত্র কাজ শুরু। কাব্যচর্চা বন্ধ করে আপাদমস্তক একটি সাহিত্য পত্রিকা করে ফেলেছিলেন। সে পত্রিকার তিনিই ছিলেন সম্পাদক, লেখক, প্রচ্ছদশিল্পী, মুদ্রক এবং পাঠক। নিজের পত্রিকাতেই প্রকাশ পেয়েছিল নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনের প্রথম উপন্যাস।
একবার ‘সিটি কলেজে’ রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসব হবে। ছাত্ররা নাটকের মহলা দিচ্ছিলেন। নারায়ণ তখন ওই কলেজেরই বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর লেখা ‘রামমোহন’ নাটকটি মঞ্চস্থ হবার কথা ছিল। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ছেলেদের মহলা দেখছিলেন নারায়ণ, প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছিলেন সকলকে। রামমোহনের চরিত্র করছিল যে ছেলেটি, সে তখন বি এ-র থার্ড ইয়ারের ছাত্র। চুটিয়ে ছাত্র ফেডারেশন করা ছেলে। বামপন্থী রাজনীতি করে বলে নারায়ণের একটু বেশিই প্রিয় ছিলেন তিনি। নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। সকলেই রামমোহনের অভিনয়ে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাতে ছেলেটির মন ভরে নি। পরের দিন সটান সে গিয়ে হাজির হয়েছিল তাঁর প্রিয় মাস্টারশমাইয়ের বাড়িতে। জিজ্ঞেস করেছিল – ‘‘কাল আমার অভিনয় কেমন হয়েছে স্যার?’’ শিক্ষক নারায়ণ তাঁর ছাত্রের দুই হাত নিজের মুঠোয় ধরে বলেছিলেন, ‘‘দেখবে, একদিন তুমি অনেক বড় অভিনেতা হবে। অনেক বড়। আর তখন আমি বসে বসে তোমার জীবনী লিখব।’’ বুকভর্তি আনন্দ নিয়ে সেদিন পটলডাঙার বাড়ি থেকে ফিরে এসেছিলেন সেই ছাত্র। মাস্টারমশায়ের সেই ভবিষ্যদ্বাবাণী ব্যর্থ হয়নি। সেদিনের ওই সদ্য তরুণটির নাম ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়’। ছাত্রদের যে কোনও ভাল কাজ মানেই ছিল শিক্ষক নারায়ণের বিপুল উৎসাহ। শিক্ষকমশাইকে নিয়েও ছাত্রদেরও ছিল একই রকম টান। কেউ কবিতা লিখে, সটান চলে যেতেন তাঁদের প্রিয় স্যারকে শোনাতে, কেউ আবার গল্প লিখেও তাই। স্যারকে না পড়ালেই নয়। স্যারের পটলডাঙার বাড়িতে যখন তখন ছাত্রদের আসা-যাওয়া ছিল। হত হই হই আড্ডা। সে-আড্ডায় ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়’, ‘অমিতাভ দাশগুপ্ত’, ‘নির্মাল্য আচার্য্য’র মতো তরুণ লেখকরা। আবার ছিলেন ম্যাট্রিকে প্রথম হওয়া ‘গৌরমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়’ও। যেতেন ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়’ও। অতি ব্যস্ততাতেও নারায়ণের সবসময় হাসিমুখ থাকত। ছাত্রদের লেখা পড়তেন। মতামত দিতেন। কোনও ছাত্র বেশ কিছু দিন লেখা না দেখালে নিজেই জিজ্ঞাসা করতেন, ‘‘লেখা হচ্ছে তো ঠিকঠাক? কী লিখছ দেখিয়ো।’’ কলেজের ছাত্ররা ছিল নারায়ণের প্রাণ। আর সেই ভালবাসা যে শুধু ছেলেদের সাহিত্য চর্চায় উৎসাহ কিংবা ক্লাসে সুন্দর করে পড়ানোর মধ্যেই আটকে ছিল, তা নয়।
এক বারের কথা যেমন। সিটি কলেজে সেদিন নাইট শিফট চলছিল। আকাশ মেঘে লালচে। হঠাৎই কলেজের মেন ইলেকট্রিক সুইচে আগুন লেগে গিয়েছিল। সবাই আতঙ্কে ছুটোছুটি করে কলেজ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। এ দিকে নারায়ণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। তা দেখে সহকর্মী অধ্যাপক ‘জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী’ তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আরে শিগগির চলুন নেমে যাই।’’ শুনে স্বভাবমিষ্ট নারায়ণ বেশ রেগে গিয়েই ধমক দিয়েছিলেন জাহ্নবীকে, ‘‘ছেলেগুলোকে ফেলে আমরা নামব আগে!’’ বলে পাঞ্জাবির পকেটে হাত পুরে অতন্দ্র প্রহরীর মতো উপরের সিড়ির মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একসময় ভিড় হালকা হয়েছিল। সব ছেলে নেমে গিয়েছিল। তারপর তিনি নেমেছিলেন।
ওদিকে, যে ‘সৌমিত্র’কে একদিন তিনি অনেক বড় অভিনেতা হবে বলে আশীর্বাদ করেছিলেন, সৌমিত্র’র জীবনের প্রথম সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনিই। একদিন মাস্টারমশায়ের বাড়িতে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন ছাত্র সৌমিত্র। সে দিনের আড্ডায় ছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের এক প্রিয় বন্ধু ‘চিত্র সাংবাদিক খগেন রায়’। ‘দুর্গেশনন্দিনী’ ছবিরও পরিচালক ছিলেন তিনি। কথায় কথায় তরুণ সৌমিত্রকে তিনি প্রস্তাব দিয়ে ফেলেছিলেন, ‘‘তুমি অভিনয় করবে? যদি চাও তো ব্যবস্থা করে দিতে পারি।’’ উত্তরে সৌমিত্র কিছু বলার আগেই হাঁ হাঁ করে উঠেছিলেন নারায়ণ – ‘‘না না খগেন, এ কী বলছ তুমি! ওর এখনও সিনেমায় নামার সময় হয়নি। আগে লেখাপড়া শেষ করুক, তার পরে না হয় ও সব হবে। পড়াশোনা থামিয়ে সিনেমায় যাওয়াটা ঠিক হবে না।’’ মাস্টারমশাইয়ের কথা একবাক্যে মেনে নিয়েছিলেন ছাত্রটিও। সুযোগ পেয়েও সিনেমায় অভিনয়ের ধারেকাছে ঘেঁষেনি। তার অনেক পরে, একসময়ে যখন তাঁর ছাত্রজীবন শেষ হয়েছিল। যখন পাকাপাকি ভাবে সিনেমায় নামবেন বলে তিনি স্থির করেছিলেন, প্রথমেই গিয়েছিলেন মাস্টারমশায়ের কাছে। প্রিয় ছাত্রকে জড়িয়ে ধরে নারায়ণ বলেছিলেন, ‘‘আমি তো বলেইছি তুমি অনেক বড় অভিনেতা হবে। আসলে কী জানো, সিনেমার অভিনয়কে বোঝার জন্য পড়াশোনা করতে হবে। যখন যে চরিত্রেই অভিনয় করবে যত্ন নিয়ে, প্রাণ দিয়ে অভিনয় করবে।’’ স্যরের আশীর্বাদ নিয়ে সেদিন ফিরে এসেছিলেন তাঁর ছাত্র।
তাঁর প্রথম সাহিত্যচর্চার প্রথম পাঠক হয়েছিলেন এক বাল্যবন্ধু। স্কুল জীবনেই দিনাজপুরের বাড়িতে আট পাতার ফুলস্কেপ কাগজে প্রকাশ করেছিলেন পত্রিকা। নাম দিয়েছিলেন ‘চিত্র-বৈচিত্র’। নিজেই গল্প, কবিতা লিখে, ছবি এঁকে পত্রিকা তৈরি করেছিলেন। শুধু তাই নয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের দরও ঠিক করেছিলেন নিজে। কিন্তু বিজ্ঞাপনদাতা তো দূরের কথা, পত্রিকার পাঠক ছিল কই? অথচ প্রকাশক কাম লেখক এতই লাজুক স্বভাবের ছিলেন যে কাউকেই নিজের এই কীর্তির কথা জানাতে পারছিলেন না। এ দিকে বারান্দার কোনে প্যাকিং বাক্সের ওপর বসে রোমহর্ষক সব কাহিনী নিয়ে হাতে গড়া পত্রিকার ওপর ইঁদুর আরশোলারা আক্রমণ চালাচ্ছিল। শেষে একদিন ধরাই পড়ে গিয়েছিলেন। তাঁর বাল্যবন্ধু ‘বেস্ত’ (সুধীন ঘোষ) তাঁকে এসে ডেকেছিলেন মার্বেল খেলার জন্য। নারায়ণ গম্ভীর হয়ে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘এখন যেতে পারব না গল্প লিখছি।’’ বন্ধু অবাক হয়ে তাঁকে বলেছিলেন – ‘‘কী গল্প? দেখি, পড় তো!’’ হত্যা, ডাকাতি, গুলি-গোলায় ভরা ধুন্ধুমার উপন্যাসের প্রথম কিস্তি শুনে তাঁর বন্ধু বেস্তর চোখ ছানা বড়া হয়েছিল। মার্বেল খেলা ভুলেটুলে তাঁর চোখমুখ তখন উত্তেজনায় জ্বলে উঠেছিল। বেস্ত জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘তারপর … তারপর কী হল?’’ নারায়ণ আবার সম্পাদকীয়-গাম্ভীর্য নিয়ে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘বাকিটা পরের সংখ্যায়। চাঁদা দিলে পরেরটা পাওয়া যাবে।’’ ‘‘তোর পত্রিকার বার্ষিক চাঁদা কত?’’ – জানতে চেয়েছিলেন বেস্ত। নারায়ণ বলেছিলেন, ‘‘নিয়মাবলি কাগজের পাতাতেই দেওয়া রয়েছে। বিজ্ঞাপন এক পৃষ্ঠা দু আনা, আধ পৃষ্ঠা এক আনা আর বার্ষিক গ্রাহকমূল্য সডাক চার পয়সা।’’ বন্ধু সঙ্গে সঙ্গে প্যান্টের পকেট থেকে হান্ডিভাজা খাওয়ার জন্য জমানো পয়সা বার করে বলেছিলেন, ‘‘আমি গ্রাহক হব।’’ তারপর থেকেই পুরো দুই কপি কাগজ বেরোনো শুরু হয়েছিল। এদিকে কাগজের একমাত্র গ্রাহকের কৌতূহলে পাগল-পাগল অবস্থা হয়েছিল। তিনদিন পরেই সে এসে বলেছিল, ‘‘বড্ড বেশি দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোর কাগজকে সাপ্তাহিক করে দে।’’ একমাত্র পাঠক বলে কথা! তাঁর আবদার কি অমান্য করা যায়? কাগজ হয়ে গিয়েছিল সাপ্তাহিক। কিন্তু কিছু দিন পরেই সুধীন পড়াশোনার জন্য কলকাতায় চলে যাওয়ায় সেই উপন্যাসও আর শেষ হয় নি, কাগজও গিয়েছিল বন্ধ হয়ে।
পত্রিকা বন্ধ হলেও নারায়ণের কাব্যচর্চা কিন্তু থামে নি। ইস্কুলে অঙ্ক ক্লাসে বসে অঙ্কখাতাতেও চলত তাঁর নিরন্তর কাব্যচর্চা। ‘মাস পয়লা’ কাগজে ছোটদের বিভাগে কবিতা পাঠিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। বুক আরও ফুলে গিয়েছিল। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে সরাসরি ‘দেশ’ পত্রিকায় কবিতা পাঠানো শুরু করেছিলেন। সেখানেও পর পর ছাপা হতে শুরু হয়েছিল তাঁর কবিতা। হঠাৎই একদিন ‘দেশ পত্রিকার সহ-সম্পাদক পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের চিঠি’ পেয়েছিলেন। চিঠিতে ছিল গল্প দেবার আর্জি। গল্প! মাথায় হাত পড়েছিল নারায়ণের। তিনি গল্প লিখবেন কী করে? কিন্তু ‘না’ বলার উপায় ছিল না। লিখেছিলেন ‘নিশীথের মায়া’। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র সতেরো, কী আঠেরো। পেয়েছিলেন প্রবল সুখ্যাতি। তারপরেই ‘বিচিত্রা’, ‘শনিবারের চিঠি’ … একের পর এক পত্রিকা থেকে ডাক আসা শুরু হয়েছিল। আর তাঁকে পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি।
একসময় দিব্যি বড়দের গল্প লিখছিলেন। নামও ছড়িয়েছিল বেশ। হঠাৎই একদিন বাড়িতে এসেছিলেন বন্ধু ‘বিশু মুখোপাধ্যায়’। এসেই ফরমাশ করেছিলেন, ‘‘অনেক বড়দের জন্য লেখা হয়েছে, এ বার ছোটদের জন্য লিখতে হবে। ‘মৌচাক’-এর জন্য লেখো। ছোটদের জন্য গল্প!’’ নারায়ণ তাঁকে জানিয়েছিলেন, ‘‘সেই কবে শৈশব পেরিয়ে এসেছি, আর কি তেমন মন আছে? ছেলেবেলার সেই খুশির জগৎকে আর কোথায় পাব?’’ ‘‘আরে ঠিক পারবে, লেখোই না,’’ উৎসাহ দিয়েছিলেন ‘বিশু মুখোপাধ্যায়’। তাঁর কথায় লিখেছিলেন বটে। গম্ভীর-গম্ভীর গল্পই। ছাপাও হয়েছিল সেই কিন্তু তাঁর নিজেরই মন তাতে ভরে নি। এর পর ‘বিশু মুখোপাধ্যায়’ আবার ফরমাশ করেছিলেন, ‘‘এবার তোমাকে বার্ষিক সংখ্যার জন্য একটা হাসির গল্প লিখতে হবে।’’ নারায়ণ আঁতকে উঠে বলেছিলেন, ‘‘হাসির গল্প? আমি! ক্লাসে ছাত্রদের হাসি বন্ধ করাই আমার একমাত্র কাজ, সেই আমি লিখব হাসির গল্প!’’ তারপর যা হয়েছিল, শোনা যাক নারায়ণের নিজের কথা থেকেই, ‘‘তখন নিজের ছোটবেলায় ফিরে এলাম। স্মৃতির ভেতর থেকে খুঁজে আনতে লাগলাম সেইসব ঘটনাকে – যাদের কথা ভাবলে এখনও তরল হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটের কোনায়। এমন একটি গল্প দিলাম বিশুদাকে। সেই যে মনের ভেতর হাসির স্রোত বইল আজও তা আর থামল না।’’ আর এভাবে বাংলা কিশোর সাহিত্যে জন্ম নিয়েছিল এক অদ্বিতীয় চরিত্র – ‘টেনিদা’।
‘টেনিদা’ – ভালো নাম ‘ভজহরি মুখার্জি’। পটলডাঙার চাটুজ্জেদের রোয়াকের আড্ডার মধ্যমণি। পুরো ছ’হাত লম্বা। গন্ডারের খাঁড়ার মতন নাক। খটখটে জোয়ান। গড়ের মাঠে গোরা ঠেঙিয়ে স্বনামধন্য। পাকস্থলী তে একটি বিয়ে বাড়ির সব খাবার ভরে ফেলতে পারে। কিন্তু পড়াশোনার ব্যাপারে স্কুলে ক্লাস টেনে একেবারে মনুমেন্ট হয়ে বসে আছে। সেখান থেকে তাঁকে নড়ায় কার সাধ্য! টেনিদার মতে, ‘পাশ তো যে কেউই করতে পারে, কিন্তু পরীক্ষায় সব উত্তর লিখেও পাশ না করতে পারাই নাকি সব থেকে কঠিন।’ কান ছিঁড়ে কানপুরে পাঠানো কিংবা নাক মুলে নাসিকে পাঠিয়ে দেওয়া অথবা দাঁত পাঠানো দাঁতনে টেনিদার বাঁ হাতের খেল। টেনিদার প্রিয় ধমক হল, ‘কুরুবকের মতন বকবক করিসনি’।
‘হাবুল’ – ভালো নাম ‘স্বর্ণেন্দু সেন’। কাঠ ঢাকাই বাঙাল যাকে বলে, হাবুল ঠিক তাই। তবে পড়াশোনায় মন্দ নয়।
‘ক্যাবলা’ – ভালো নাম ‘কুশলকুমার মিত্র’। চারজনের মধ্যে পড়াশোনায় খুব ভালো। প্রতিবছর পরীক্ষায় ভালো ফল করে। এই জন্য টেনিদা মাঝেমাঝেই ক্যাবলার ওপরে বেজায় ক্ষেপে যায়।
‘প্যালারাম’ – ভালো নাম ‘কমলেশ ব্যানার্জি’। পড়াশোনায় চলে যায় আর কি! দু’পা হাঁটলেই তাঁর পিলে খটখট করে জানান দেয়। পটল দিয়ে পাতলা শিঙ্গি মাছের ঝোল আর ভাত, এই হল তাঁর দুই বেলার আহার।
চিরকালের স্বভাব লাজুক এবং আদন্ত্য বিনয়ী ছিলেন নারায়ণ। বাংলা সাহিত্যে ‘এমএ’-তে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন, সে-কথাও যেমন তিনি মুখফুটে কাউকে বলতেন না, তেমনই ক’জনই বা জানে, তিনি ‘ডক্টরেট’ হয়েও জীবনে কখনও নিজের নামের আগে ‘ডক্টর’ শব্দটি বসাননি। এমনকী লেখক-জীবন শুরুর সময়েও তাঁর নিজের নাম প্রকাশেও ছিল সংকোচ। যে ‘তারকনাথ’ নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন, লেখা ছাপাতে দেওয়ার সময় নিজের নামটিও বদলে দিয়ে লিখেছিলেন – ‘নারায়ণ’। ঠিক একই ভাবে ‘টেনিদা’ যতই জনপ্রিয় হোক না কেন, ‘ঘনাদা’র প্রসঙ্গে ঠিক তিনি ‘টেনির’ মুখ দিয়ে বলিয়ে ছেড়েছিলেন, ‘কী বললি প্রেমেন মিত্তিরের ঘনাদা! কী যে বলিস! তাঁর পায়ের একটু ধুলো মাথায় দিতে পারলে বর্তে যেতুম রে।’ শুধু তাই নয়, ‘লেখক-পুত্র অরিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের’ কাছ থেকে জানা যায়, একবার তাঁকে ‘একাডেমি পুরস্কার’ দেওয়ার কথাও উঠেছিল। কিন্তু শুধুমাত্র ‘রাজনৈতিক মতবাদ’ ভিন্ন হওয়ার জন্য পুরস্কার কমিটিতে থাকা এক স্বনামধন্য সাহিত্যিক একপ্রকার জোর করেই নারায়ণের নাম খারিজ করে দিয়েছিলেন। পুরো বিষয়টাই পরে জানতে পেরেছিলেন নারায়ণ কিন্তু জীবনে একবারের জন্যও সেই সাহিত্যিকের প্রতি কারও কাছে উষ্মা প্রকাশ করেননি। আজীবন নিজেকে যেমন ‘কমনম্যান’ বলতেন, বিশ্বাসও করতেন তেমনই। ১৯৬৫ সালে ‘আকাশবাণী’তে স্বরচিত কবিতা পাঠে তিনি পড়েছিলেন –
‘‘আমার কীর্তিরে আমি করি না বিশ্বাস
নিয়ত তরঙ্গাঘাতে দিনে দিনে দিবে লুপ্ত করি
… এ বিশ্বেরে ভালবাসিয়াছি এ ভালোবাসাই সত্য এ জন্মের দান।’’
ছাত্ররা যেমন মাস্টারমশাই বলতে অজ্ঞান ছিলেন। ছাত্রদেরও যে কোনও সমস্যায় তাঁদের স্যার এগিয়ে আসতেন সবার আগে। সে কেমন? একবার ছাত্র রাজনীতি করা এক গরিব ঘরের ছেলের কলেজে ‘ফিজ’ বাকি পড়েছিল অনেক টাকা। সে টাকা দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না তাঁর। ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে গিয়ে জানাতে ইউনিয়ন সেক্রেটারি তাঁকে জানিয়েছিল, তারা মেরেকেটে সতেরো টাকা দিতে পারবে, তার বেশি সামর্থ্য নেই। ওতে কিছুই হবার ছিল না। ছাত্রটির শেষ উপায় ছিলেন ‘নারায়ণ স্যার’। তাঁর কাছে গিয়েই পুরো ঘটনা জানিয়েছিলেন ছাত্রটি। শোনামাত্র আর এতটুকু সময় নষ্ট না করে নারায়ণ ছেলেটিকে সঙ্গে করে সটান নিয়ে গিয়েছিলেন কলেজ রেজিস্ট্রারের কাছে। তাঁর অনুরোধে বকেয়া ‘ফিজ’ দুশো আটাত্তর থেকে নেমে এসেছিল সোজা আঠাশ টাকায়। ছাত্রটির ওই টাকা দেওয়ারও যে ক্ষমতা নেই সেটা জানতেন নারায়ণ। সুতরাং সে-টাকা নিজেই মিটিয়ে দিয়েছিলেন। ছাত্রটি পরীক্ষায় বসার সুযোগ পেয়েছিল। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে যাতে এমন সমস্যায় আবার না পড়ে তার জন্য ছাত্রটির একটি প্রাইভেট টিউশনও জুটিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ওই ছাত্র আর কেউ নয়, পরবর্তী কালে যাঁকে বাংলা সাহিত্যজগৎ যাঁকে চিনেছিল ‘কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত’ নামে।
ছাত্রদের সঙ্গে একেবারে বন্ধুদের মতো মিশতেন নারায়ণ। ‘অমিতাভ দাশগুপ্তের স্মৃতিচারণ’ থেকে এমনই আরেকটি ঘটনার কথা জানা যায়। এক বর্ষার দুপুরে অনার্স ক্লাসের ছেলেরা মিলে দরজা বন্ধ করে ‘আজি বরষণ মুখরিত’ গাইছিলেন। সবার ওপরে চড়া গলায় গাইছিলেন ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়‘। গান তো চলছিলই, সঙ্গে চলছিল কাঠের বেঞ্চে উদ্দাম তবলার ঠেকা। হঠাৎ দরজা খুলে ক্লাসে ঢুকেছিলেন মাস্টারমশাই নারায়ণ। সঙ্গে সঙ্গে গোটা ক্লাস পাথর হয়ে গিয়েছিল। সব চুপ। নারায়ণ বলেছিলেন, ‘‘কী হল? গান থামল কেন? চলুক।’’ ছাত্ররা তাতেও চুপ করে ছিলেন। নারায়ণ তখন তাঁদের সাফ জানিয়েছিলেন, গান শেষ না হলে তিনি কিছুতেই ক্লাস নেবেন না। অমিতাভ লিখছেন, ‘‘তাঁর নাছোড়বান্দা মেজাজ দেখে বহুকষ্টে ঠেলেঠুলে সৌমিত্রকে তুলে দিলাম। অমন স্মার্ট ছোকরা; প্রায় কনডেমড সেলের আসামির মতো কাঁপা গলায় শেষ করল গানটি।’’ তারপর ‘রক্তকরবী-র বিশুপাগল’কে নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলেন নারায়ণ।
পটলডাঙার বাড়িতে তখন সকলের অবাধ যাওয়া-আসা করতেন। সকলেই স্বাগতম করতেন নারায়ণ। সেখানে হত দেদার মজাদার আড্ডা, সঙ্গে চা, মুড়ি-ডালমুট। ছাত্ররা তো বটেই, অনেক নামী অনামী লেখকও চলে আসতেন আচমকা। এমনই একদিন মলিন ধুতি-পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক এসে হাজির হয়েছিলেন নারায়ণের বাড়িতে। তখন ঘড়িতে বেলা এগারোটা কী বারোটা। তাঁকে দেখে বেজায় আনন্দিত নারায়ণ বলেছিলেন, ‘‘দাদা এসেছেন! আসুন আসুন কী সৌভাগ্য আমার!’’ ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘‘এই তো পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম ভাবলাম একবার দেখা করে যাই। বেশিক্ষণ বসব না। এই আধঘণ্টার মতো বসে একটু গল্প করেই চলে যাব।’’ ভদ্রলোকের গলা শুনে পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন নারায়ণ ঘরণি ‘আশাদেবী’। বলেছিলেন, ‘‘দাদা এসেছেন যখন দুপুরে চাট্টি ভাত খেয়ে যাবেন।’’ ‘‘ভাত? আচ্ছা আপনি বলছেন যখন দুটি খেয়েই যাই। জমিয়ে রান্না করুন দেখি।’’ – বলেছিলেন সেই ভদ্রলোক। নারায়ণ ওই অবেলায় ছুটেছিলেন বাজারে। ইলিশ মাছ দিয়ে জমিয়ে ভাত খেয়ে তারপর শুরু হয়েছিল মজলিশি আড্ডা। পাশের ঘর থেকে কান খাড়া করে সেই গল্প শুনেছিলেন ‘নারায়ণ-পুত্র অরিজিৎ’। সেই ভদ্রলোক এমনভাবে ঘন বন-জঙ্গল, জোৎস্না রাতের পাহাড়, নির্জন টিলার বর্ণনা দিচ্ছিলেন যে চোখের সামনে সব যেন ছবি হয়ে ধরা পড়ছিল। বক্তা শ্রোতা সকলেই ছিলেন মোহিত। গল্পে গল্পে সেই বরাদ্দ আধঘণ্টা গড়িয়ে কখন বিকেল হয়ে গিয়েছিল, কেউ বুঝতে পারেন নি। হঠাৎই হুঁশ ফিরেছিল ভদ্রলোকের। ঘড়ি দেখে আঁতকে উঠে ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘‘সর্বনাশ! চারটে বেজে গেছে! আমি যে আধঘণ্টা থাকব ভেবেছিলাম। আমি বেরোলাম।’’ নারায়ণ বলেছিলেন, ‘‘একটু চা খেয়ে যান।’’ ‘‘না না আর চা নয়। আর দেরি হলে ফিরতে পারব না,’’ বলেই বেরিয়ে পড়লেন তিনি। নারায়ণ দেখেছিলেন তাড়াহুড়োয় যে দিকে যাবার কথা ঠিক তার উল্টো দিকের বাসে চড়ে বসেছিলেন ভদ্রলোক। পরে ‘অরিজিৎ’ জানতে পেরেছিলেন অমন সাধারণ দেখতে কিন্তু অলৌকিক প্রকৃতির বর্ণনা করতে পারা অন্যমনস্ক মানুষটির নাম ছিল ‘বিভূতিভুষণ বন্দ্যোপাধ্যায়’।
তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল ঈর্ষা করার মতো। এক নিঃশ্বাসে গড়গড় করে বলে যেতে পারতেন লম্বা লম্বা কবিতা, এমনকী গল্পও। ‘শেক্সপিয়র’, ‘মপাঁসা’, ‘রবীন্দ্রনাথ’ থেকে ‘জীবনানন্দ’ একেবারে কন্ঠস্থ ছিল তাঁর। একবারের কলেজে ক্লাস ভর্তি ছেলে। নারায়ণ তারাশঙ্করের ‘অগ্রদানী’ গল্পটি পড়াবেন বলে ঠিক করেছিলেন। কিন্তু সে দিনই ক্লাসে কারও কাছে টেক্সট বই ছিল না। কী উপায়? নারায়ণ বলেছিলেন, ‘‘দেখি একবার স্মৃতি থেকে চেষ্টা করে।’’ বলতে শুরু করেছিলেন গল্পটা। পুরো গল্পটার প্রথম লাইন থেকে শুরু করে একেবারে কমা সেমিকোলন পর্যন্ত উল্লেখ করে থেমেছিলেন ‘খাও হে চক্রবর্তী’তে। গোটা ক্লাস অভিভূত হয়ে পড়েছিল।
নারায়ণের স্মৃতিশক্তি নিয়ে এমন অনেক মজার ঘটনা রয়েছে। আরেকবার, নারায়ণ তখন ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক’। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের তেতলার ঘরে বসে কয়েকজন সহকর্মী মিলে চা সহযোগে আড্ডা চলছিল। সেই আড্ডায় ‘অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়’ও ছিলেন। আড্ডা চরমে। তখনই ঘরে ঢুকেছিলেন প্রধান শিক্ষক ‘প্রমথনাথ বিশী’। সেদিন নারায়ণ প্রমথনাথ-কে চা খাওয়াবেন এই ঘোষণা করার পরে পর প্রমথনাথ কথায় কথায় জানিয়েছিলেন, তিনি খুবই চিন্তিত। কারণ তাঁর নতুন কবিতার বই প্রকাশ হতে চলেছে। কিন্তু ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রিয় কবিতা তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। অথচ সেই কবিতাটি সংকলনে রাখার খুবই ইচ্ছে। শুনে নারায়ণ তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘কবিতাটির নাম জানতে পারি?’’ প্রমথনাথের কাছে নাম শুনে লাজুকভাবেই নারায়ণ তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আমার পুরো কবিতাটিই মনে রয়েছে। প্রয়োজনে আপনি লিখে নিতে পারেন।’’ শুনে প্রমথবাবু পুরো হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর মজার আড়ালে বেশ গম্ভীর হয়েই বলে উঠেছিলেন, ‘‘দেখুন এত স্মৃতি ভালো নয়, ভালমন্দ সবই আপনি মনে রাখতে পারেন দেখছি।’’ ঘরভর্তি সকলে হাসিতে ফেটে পড়েছিলেন।
নিজের জীবন থেকেই লেখার উপাদান সংগ্রহ করতেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। কী রকম? ‘প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়’, যাঁকে দেখে তিনি ‘টেনিদা’ চরিত্রের সৃষ্টি করেছিলেন, তিনিই জানিয়েছিলেন এমন কিছু কথা। একদিন আড্ডা চলছিল। উপস্থিত ছিলেন ‘প্রভাতকুমার’ ও নারায়ণ। এক সময় কথা প্রসঙ্গে ‘প্রভাতকুমার’ তাঁকে জানিয়েছিলেন, ছেলেবেলায় রোগা চেহারায় তিনি ইয়াব্বড় চ্যাং ঘুড়ি উড়িয়েছিলেন বিশ্বকর্মা পুজোয়। অমনি নারায়ণ তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘অ্যাঁ, ঘুড়ির সঙ্গে সঙ্গে আপনিও আকাশে উড়ে গেলেন!’’ এই প্রসঙ্গ নিয়েই তৈরি হয়েছিল ‘ঢাউস’। আড্ডা ছাড়াও নারায়ণের আরও এক নেশা ছিল ধর্মতলা আর শিয়ালদহ থেকে দুষ্প্রাপ্য নানা রেকর্ড সংগ্রহ করা। এই নেশাই হয়তো পরে কাজে লেগেছিল ‘রেকর্ড’ গল্পের বয়নে। আরেকবার ‘গরুমারার জঙ্গল’ দিয়ে গাড়িতে যাচ্ছিলেন নারায়ণ এবং দু’জন সংগীতশিল্পী। আলোচনা চলছিল – হঠাৎ যদি বাঘ সামনে পড়ে, তা হলে কী হবে? যেই না বলা, অমনি রাস্তার পাশের জঙ্গল থেকে এক লাফে অন্য দিকে চলে গিয়েছিল একটা বাঘ! নারায়ণের সঙ্গে সে দিনের দু’জন সংগীতশিল্পী ছিলেন ‘দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়’ ও ‘সুচিত্রা মিত্র’। এই প্রসঙ্গটাই খানিক অন্য ভাবে নারায়ণ এনেছিলেন ‘চারমূর্তির অভিযান’-এ। ব্যক্তিজীবনে নারায়ণের আরও একটি শখ ছিল। তা হল ‘ভাষাশিক্ষা’র। স্ত্রীর বই নিয়ে নিজেই অত্যন্ত ভাল ভাবে শিখেছিলেন ‘ফরাসি ভাষা’। ‘পর্তুগিজ ভাষা-সাহিত্য’ নিয়েও তাঁর আগ্রহ ছিল, যার ছাপ দেখা যায় তাঁর ‘পদসঞ্চার’ উপন্যাসটিতে।
‘নারায়ণের পদসঞ্চার’ কিন্তু ‘সমাজ-নিরপেক্ষ’ ছিল না। ‘মার্কসবাদে’ আমৃত্যু বিশ্বাসী নারায়ণকে তাই গিয়েছিল যায় ‘বাম-গণ আন্দোলনে’ও। আবার কখনও বা ‘জলপাইগুড়ির বন্যার সময়’ দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে শোভাযাত্রায় এগিয়ে এসেছিলেন সস্ত্রীক নারায়ণ। কনিষ্ঠ সাহিত্যিক ও ছাত্র ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়’ অবাক হয়ে চেয়ে দেখেছিলেন, কী ভাবে ‘গঙ্গোপাধ্যায় দম্পতি’ চার ঘণ্টা ধরে পায়ে হেঁটে সেই শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ‘সাহিত্য-সংস্কৃতি-সমাজের’ ত্রিসঙ্গমের এই শোভাযাত্রায় হাঁটতে হাঁটতেই হয়তো এসেছিল সেই অভিশপ্ত দিনটা – ১৯৭০ সালের ৬ই নভেম্বর।
(তথ্যসূত্র:
১- বাংলা ছোটগল্পের তিন নক্ষত্র: বনফুল-প্রেমেন্দ্র মিত্র-নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, শীতল চৌধুরী, প্রজ্ঞা বিকাশ (২০০৯)।
২- নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় শতবার্ষিকী সংকলন, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ।
৩- নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (২০১১)।
৪- টেনিদা সমগ্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স (১৯৯৬)।
৫- সুনন্দর জার্নাল, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (২০০১)।
৬- অগ্রন্থিত কিশোর রচনা, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, কিশলয় প্রকাশন।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত